জহির রায়হান শুধু সাহিত্যিক হতে পারতেন, কিংবা শুধুই চলচ্চিত্রনির্মাতা।বরফ গলা নদী কিংবা হাজার বছর ধরে নামের উপন্যাস দুটি লিখলেই বাংলা সাহিত্য তাঁকে মনে রাখত। শুধু জীবন থেকে নেয়া ছবিটি নির্মাণ করলেই বাংলা চলচ্চিত্র জগতে তাঁর নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকত। কিন্তু তিনি কোনো এক জায়গায় স্থির না হয়ে হলেন একজন রাজনীতিসচেতন সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রনির্মাতা, সাংবাদিকও। মুক্তিযুদ্ধের পর পরই বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের শিকার আপন বড় ভাই শহীদুল্লা কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে নিহত না হলে বাংলা সাহিত্য ও চলচ্চিত্র তাঁর মাধ্যমে আরও ঋদ্ধ হতো।
এই গুণী মানুষটির গল্পই এবার বলব তোমাদের। তোমরা জানো, একাত্তরে আমাদের জীবনে নেমে এসেছিল ভয়ানক অমানিশা। পাকিস্তানি সৈন্যরা উড়ে এসে ছাই করে দিচ্ছিল গ্রামের পর গ্রাম। প্রতিরোধ থেকে শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ। সেই মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে যেমন যুদ্ধ করেছে মানুষ, তেমনি গান গেয়ে, খবর পড়ে, সেবা দিয়ে বিপর্যস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল মানুষ। জহির রায়হান দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর ক্যামেরা নিয়ে। ক্যামেরার ভাষায় তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন। স্টপ জেনোসাইড নামে যে প্রামাণ্যচিত্রটি তিনি তৈরি করেছিলেন, তা এককথায় অনবদ্য। সারা পৃথিবীকে তিনি এই ছবির মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছিলেন কেন আমরা লড়াই করছি। শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে কীভাবে আমরা প্রতিবাদ করেছি, কীভাবে এখন লড়ছি। তার আগে দেখিয়েছেন পশ্চিম পাকিস্তানিরা কীভাবে আমাদের শোষণ করেছে, তার ইতিবৃত্ত।
জহির রায়হান এ দেশের প্রগতিশীল চলচ্চিত্র আন্দোলনের পুরোধা। শুধু চলচ্চিত্রনির্মাতাই তিনি নন, একাধারে তিনি কাহিনিকার, চিত্রনাট্য রচয়িতা, চিত্রগ্রাহক এবং প্রযোজক। পাকিস্তানের প্রথম রঙিন ছবি সংগম, প্রথম সিনেমাস্কোপ ছবি বাহানা তিনিই নির্মাণ করেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এক বুক আশা নিয়ে দেশে ফেরেন জহির রায়হান। ফিরে এসেই শোনেন অগ্রজ শহীদুল্লা কায়সারের নিখোঁজ সংবাদ। পাগলের মতো ভাইকে খুঁজতে থাকেন তিনি। খবর পেয়েছিলেন, ঢাকার মিরপুরে অগ্রজকে আটকে রাখা হয়েছে। ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি একটি সার্চ পার্টির সঙ্গে জহির রায়হান মিরপুরে গিয়েছিলেন। কিন্তু এটা ছিল একটি ফাঁদ। তখনো মিরপুরের এই এলাকাটি মুক্ত হয়নি। জহির রায়হানসহ কয়েকজনকে সেখানে সেদিন হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী ও এ দেশের বিশ্বাসঘাতক বিহারিরা।
জহির রায়হানের জন্ম ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট। ফেনীর মজুপুর গ্রামে। তাঁর পারিবারিক নাম আবু আবদার মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ। ছেলেবেলায় তাঁকে জাফর নামে ডাকা হতো।
জহির রায়হান দুবার বিয়ে করেছিলেন। চিত্রনায়িকা সুমিতা দেবীর সঙ্গে তাঁর বিবাহিত জীবনে বিপুল রায়হান ও অনল রায়হানের জন্ম হয়। চিত্রনায়িকা সুচন্দাকে বিয়ের পর এ সংসারে অপু ও তপু নামে দুই ছেলে আছে তাঁর।