শিশু-কিশোর ও অন্য সবারই জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে জানা জরুরি। জলবায়ু পরিবর্তন কী, কেন, কীভাবে, আমাদের ভবিষ্যৎ কতটা হুমকির মুখে, ভবিষ্যৎকে বিপদমুক্ত করতে আমরা কী করতে পারি—এসবই জানা দরকার সবার।
তুমি যদি কিশোর হও, তোমার জীবনের প্রায় প্রতিবছরই একটা খবর দেখেছ। দেশের তাপমাত্রা আগের বছরের রেকর্ড ভেঙে ফেলছে। টিভিতে দেখেছ, বনে আগুন লেগেছে। হরিণ আর খরগোশের মতো প্রাণীগুলো প্রাণভয়ে ছুটছে! দেখেছ কোনো কোনো বছর একদমই বৃষ্টি হয়নি। আবার কোনো বছর এত এত বৃষ্টি হয়েছে, সারা দেশ ভেসে গেছে বন্যায়। তোমাদের রাস্তায় পানি জমেছে হাঁটু পরিমাণ। ঝড় এসে উপকূল এলাকার গাছপালা ভেঙেচুরে নিয়ে গেছে। ফসলের খেত আর মাছের ঘের ভেসে গেছে। এগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। ব্যাপারটা আমাদের জীবনের সঙ্গে একদম জড়িয়ে গেছে।
তোমার বাকি জীবনজুড়েই জলবায়ুর অনেক পরিবর্তন হবে। অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে। জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্তসরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) প্রতিবেদনের সূত্র ধরে প্রতিষ্ঠানটির মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও বলেছেন, পৃথিবী খুব দ্রুত জলবায়ু বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে আমরা যদি এখনই কাজ শুরু করি, তাহলে অবস্থার খানিকটা পরিবর্তন সম্ভব হবে। উদ্যোগ নিলে বাঁচানো যাবে মানুষকে। চলো দেখি, জলবায়ু পরিবর্তনের চিত্রটা কীভাবে পাল্টানো সম্ভব হবে।
তার আগে দেখি, কীভাবে আমাদের এত খারাপ অবস্থা হলো।
তোমার চারপাশে তাকাও। ঘরের বাতি, টিভি, ফ্রিজ—সবকিছু বিদ্যুৎ ব্যবহার করে চলছে। মানুষ যত দিন আছে পৃথিবীতে, তার বেশির ভাগ সময়ই বিদ্যুৎ ছাড়া কাটিয়েছে। উনিশ শতকের শেষে এসে বিদ্যুৎ আবিষ্কৃত হলো। তারপর এই বিদ্যুৎ আমাদের জীবনের সঙ্গে একদম জড়িয়ে গেছে। উদাহরণ হিসেবে বলি, ১৯৫০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ যত বিদ্যুৎ ব্যবহার করত, এখন তার চেয়ে ১৩ গুণ বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করে। আবার লন্ডনের রাস্তায় প্রতিদিন ২৮ লাখ বাতি জ্বলে!
তোমার বাসার বিদ্যুতের লাইন সম্ভবত রাস্তায় ঝোলানো বিদ্যুতের খুঁটি থেকে এসেছে। এই খুঁটির তার ধরে পেছনে (সত্যি সত্যি ধরতে যেয়ো না) গেলে দেখা যাবে, লাইনটি এসেছে কোনো একটা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। এ রকম অসংখ্য বিদ্যুৎকেন্দ্র আমাদের বাসাবাড়ি, কারখানা, স্কুলসহ সবখানে বিদ্যুৎ পাঠাচ্ছে। এসব বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে। জীবাশ্ম জ্বালানি হলো মাটির নিচে জমে থাকা কয়লা, তেল আর গ্যাস। শক্তির প্রয়োজন হয়, এমন প্রায় সব কাজেই জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হচ্ছে।
বর্তমানে জীবাশ্ম জ্বালানি একটা বড় ব্যবসা। মানুষ প্রতিবছর ৭০০ কোটি টন কয়লা ব্যবহার করে। প্রতিদিন প্রায় ১০ কোটি ব্যারেল তেল আর তরল জ্বালানির ব্যবহার হয়। সবটুকু আসে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে।
প্রাচীনকালে প্রাণী আর গাছপালা মাটির নিচে চাপা পড়ে হাজার বছরে পরিবর্তিত হয়ে তেল, গ্যাস আর কয়লা হয়েছে। এগুলো মাটির নিচ থেকে তুলে যখন ব্যবহার করি, তখন আমরা প্রাচীনকালের জমে থাকা কার্বন থেকে কার্বন ডাই–অক্সাইড আর মিথেন গ্যাস বাতাসে ছাড়ি। এগুলোকে গ্রিনহাউস গ্যাস বলে। এই গ্যাস বায়ুমণ্ডলের জন্য একটা চাদরের মতো। সূর্যশক্তি দিনের বেলায় পৃথিবীকে গরম করে। রাতের বেলায় পৃথিবী তাপ ছেড়ে ঠান্ডা হয়। কিন্তু গ্রিনহাউস গ্যাস কিছুটা তাপ ধরে রাখে। পৃথিবীর যতুটুকু তাপ ছেড়ে দেওয়ার কথা, তা ছাড়তে পারে না গ্রিনহাউস গ্যাসের কারণে। জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে করা কাজকর্মে পৃথিবী গরম হয়ে উঠেছে গত এক হাজার বছরের তুলনায়। তারপরও জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার দিন দিন বাড়িয়েই চলেছে মানুষ।
এই দূষণের প্রথম আঘাতটা পড়েছে বাংলাদেশের মতো নিম্নআয়ের দেশের দরিদ্র মানুষের ওপর। নিম্নআয়ের মানুষ শহুরে বস্তি এলাকায় বাস করে। যেখানে দূষণ আর বর্জ্য থাকে ঘরের লাগোয়া। বিশ্বজুড়ে করোনার কারণে যত মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তার চেয়ে বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে পরিবেশ দূষণে। করোনা মহামারিতে বিশ্বে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫৯ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আর প্রতিবছর দূষণে প্রায় ৯০ লাখ মানুষের অকালমৃত্যু হয়।
গ্রিনহাউস গ্যাসের বাইরেও কিছু দূষণের উৎস আছে। তোমাদের পাশে যে নতুন দালান উঠছে বা তোমার শহরের ফুটপাতগুলোর কথা ভাবো। যে সিমেন্ট দিয়ে এগুলো আটকে রাখা হয়েছে, সেগুলো লাইমস্টোন গুঁড়া করে তাপ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। এর ফলে পরিবেশ দূষণের ২০ শতাংশ সিমেন্ট, স্টিল আর অন্যান্য কারখানা থেকে আসছে। আমরা যা খাই, তা–ও পরিবেশ দূষণে ভূমিকা রাখে। গরু-ছাগল আর গৃহপালিত অন্য প্রাণীগুলো বায়ু ত্যাগ করে, ঢেকুর তোলে, মল ত্যাগ করে। ফসলের খেত থেকেও গ্যাস বের হয়। আমাজন জঙ্গল, আমাদের সুন্দরবন ও অন্যান্য বনের গাছ কেটে মানুষ ফসল ফলানোর জমি তৈরি করছে। গাছ কাটার ফলে গাছ ও মাটিতে জমে থাকা কার্বন বায়ুতে চলে যায়। ফসল ফলানো ও গাছ কাটার ফলে বিশ্বের চার ভাগের এক ভাগ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হয়।
এভাবে চলতে থাকলে জলবায়ু পরিবর্তনের অবস্থা আরও খারাপ হবে। চলো দেখি, কতটা খারাপ হবে! খারাপ ভবিষ্যৎ দেখতে কেমন হবে? অনেক মানুষ ও প্রাণীর জন্য জীবন কঠিন হয়ে যাবে।
ভবিষ্যতে পৃথিবীর বহু জায়গা আরও উত্তপ্ত হবে। তবে শীতকাল থাকবে। স্কুল ও খেলাধুলা হিট ওয়েভে বাতিল হবে (দূষণে ভারতের নয়াদিল্লির স্কুল বন্ধের কথা শুনে থাকবে)। বৃদ্ধ আর ঘরের বাইরে কাজ করা মানুষদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে অতি গরম। আবহাওয়ার পরিবর্তনে অনেক জায়গায় ফসল উৎপাদন করা কঠিন হবে। পানি শুকিয়ে যেতে পারে অসংখ্য পুকুর আর নদীনালায়। শুষ্ক আবহাওয়া বনে আরও ঘন ঘন আগুন লাগাবে। পুড়ে যেতে পারে অসংখ্য এলাকা। এমন হলে আমরা অস্বাস্থ্যকর ধোঁয়া আর বায়ু গ্রহণ করতে বাধ্য হব। অনেক প্রাণীর বেঁচে থাকার পরিবেশ আর খাবার থাকবে না। মানুষের কারণেই বিলুপ্ত হবে অনেক প্রাণী। মেরু অঞ্চলের বরফ গলে তলিয়ে যাবে অনেক উপকূলীয় এলাকা। এই শতক শেষ হওয়ার আগেই ঘর–বাড়িহারা হবে লাখ লাখ মানুষ, যাদের আমরা বলি জলবায়ু উদ্বাস্তু। বাতাস থেকে বেশি বেশি কার্বন ডাই–অক্সাইড মেশার কারণে সমুদ্রের পানি আরও অ্যাসিডিক হবে। সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা বাড়বে। অবশ্য কিছু প্রাণীর এতে সুবিধা হবে। কিন্তু আমরা খেয়ে বেঁচে থাকি—এমন সামুদ্রিক প্রাণীগুলোর ভীষণ ক্ষতি হবে। কোরাল রিফগুলো ‘নাই’ হয়ে যাবে।
শুনে নিশ্চয়ই খারাপ লাগছে। যদি আমরা কোনো উদ্যোগ না নিই, তাহলে এ রকম হবেই। বিজ্ঞানীরা এমনই বলছেন। তবে আইপিসিসির সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী বিজ্ঞানীরা এটাও বলেছেন যে আমরা যদি এখনই কাজ শুরু করি, তাহলে জলবায়ু বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব।
আমাদের জন্য এখনো পথ খোলা আছে। এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। না নিলে ভবিষ্যৎ আমাদের ছাড়বে না, যতই বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কার হোক। জলবায়ুর পরিবর্তন শুরু হয়ে গেছে। সব দেশের সরকার, শিল্পকোম্পানির মালিক আর সাধারণ মানুষেরা সবাই মিলে যদি উদ্যোগ নিতে পারি, তাহলে জলবায়ু পরিবর্তনের হাত থেকে মানুষ অনেকটা রক্ষা পাবে।
চলো এবার দেখি, ভালো ভবিষ্যৎ কী রকম হতে পারে?
ভালো ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ধীরগতির আর কম ভয়ংকর হতে পারে। এ রকম হলে পরিবেশ ও প্রকৃতি পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবে। যেমন সরকার উপকূলবাসীদের উঁচু এলাকায় সরিয়ে আনতে পারবে এলাকা তলিয়ে যাওয়ার আগেই। পৃথিবীর অধিকাংশ দূষণের জন্য দায়ী শিল্পোন্নত দেশগুলো। শিল্পোন্নত দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে পরিবর্তিত জলবায়ুতে টিকে থাকতে সাহায্য করতে পারবে।
ভালো ভবিষ্যতেও বনে আগুন লাগবে আর ফসল ফলাতে কষ্ট হবে। কিন্তু খারাপ ভবিষ্যতের মতো অতটা নয়। আমরা আরও গাছ লাগিয়ে বনকে রক্ষা করতে পারব, যেগুলো বড় হতে হতে অনেক কার্বন বাতাস থেকে শোষণ করে নেবে। ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিবাসী ও বনজীবীরা এই কার্যক্রমে আমাদের পথ দেখাতে পারে। আমরা আমাদের খাদ্যাভ্যাস বদলাতে পারি। মানুষ অতিরিক্ত মাংস খাওয়া বাদ দিতে পারে। কৃষিকাজ আর পশুপালনে আমরা প্রকৃতির ক্ষতি না করে সবুজ পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারি। সবুজ পদ্ধতি হলো পরিবেশের ক্ষতি না করে শস্য উৎপাদন।
পরিবর্তন সমাজের সবখানেই ছড়িয়ে দিতে হবে। বিশেষ করে শিল্পকারখানায়। কংক্রিট তৈরিতে কীভাবে আরও কম কার্বন ডাই–অক্সাইড বের হবে, তা নিয়ে গবেষণা করা যেতে পারে। প্রকৃতির জন্য ক্ষতিকর নয়, এমন ভবনে আমরা কাজ করতে পারি। কাঠ আর স্থানীয় পাথর দিয়ে তৈরি ভবনগুলোকে পরিবেশের জন্য ভালো অবকাঠামো বলা যায়। ভালো ভবিষ্যতে আমরা বৈদ্যুতিক গাড়ি ব্যবহার করতে পারি। ডিজেল আর গ্যাসোলিনে চলে—এমন গাড়ির পরিবর্তে বিশুদ্ধ জ্বালানি ব্যবহার করে চলে, এমন গাড়ি ব্যবহার করতে পারি। এভাবে অনেক এলাকার বায়ু পরিষ্কার হয়ে যাবে। শহরগুলো মানুষের পাবলিক পরিবহন ব্যবহার করার সুব্যবস্থা করতে পারে। সাইকেল লেন তৈরি করে সেখানে শুধু সাইকেল চলতে দিয়ে সাইকেল চালাতে উৎসাহ দিতে পারে। বিমান কিছু দূষণ করবে। আকাশপথে ভ্রমণ কমানো যেতে পারে। সূর্যের আলো, বায়ুর প্রবাহসহ অন্যান্য নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করতে হবে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে আনার জন্য। যখন আকাশ মেঘলা থাকবে বা বায়ুপ্রবাহ ধীর হবে, তখন ব্যবহার করার জন্য নবায়নযোগ্য শক্তি জমা করে রাখা যেতে পারে।
আশার কথা হলো, আমরা জানি কীভাবে এসব পরিবর্তন আনতে হবে। এমনকি অনেক জায়গায় এই পরিবর্তন শুরু হয়েছে। তবে পরিবর্তনের গতি খুব কম। এর কারণ, আমাদের বাধা বিজ্ঞান নয়, মানুষ। বিশ্বনেতা আর ব্যবসায়ীদের জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে গুরুত্ব দিতে হবে। আর আমরা বাদবাকিরা তাতে সাহায্য করব। এভাবেই ভালো ভবিষ্যৎ সত্যিকার ভবিষ্যৎ হবে। আমরা কি এগুলো করব? সিদ্ধান্ত আমাদেরই।