এ মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে নিঃসঙ্গ প্রাণী একটি তিমি। এটুকুই জানা যায়। আর কিছুই প্রায় জানা যায় না। কেউ তাকে দেখেনি। কেউ জানে না সেটা কোন ধরনের তিমি—নীল তিমি, নাকি হাম্পব্যাক, নাকি হ্যামারহেড, নাকি অন্য কিছু।
না দেখা গেলেও সেই তিমির ডাক বা আওয়াজ শোনা যায়। সাগরের অতল থেকে উঠে আসা সেই আওয়াজ যন্ত্রপাতি দিয়ে রেকর্ড করা হয়েছে বহুবার। কিন্তু তা শুনে তিমিবিশারদদের কেউ এখনো এটির জাত বুঝে উঠতে পারেননি। না বোঝার কারণ, কোনো চেনা জাতের ডাকের সঙ্গে এটির মিল নেই।
তিমির ডাককে আমরা যদি তিমির ভাষা হিসেবে দেখি, তাহলে বলতে হবে এই তিমি ভিন্ন এক ভাষায় কথা বলছে। আর এটাই তার নিঃসঙ্গতার মূল কারণ। এটির ভাষা অন্য তিমিরা বুঝতে পারে না। তার ডাকে কেউ সাড়া দেয় না। কেউ তার কাছে আসে না। প্রায় ৩০ বছর ধরে প্রশান্ত মহাসাগরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে একা একা নিষ্ফল ডেকে যাচ্ছে বিশালদেহী প্রাণীটি।
বিজ্ঞানীরা তিমিটির একটি নাম দিয়েছেন। এটিকে বলা হচ্ছে ‘৫২ হার্টজ তিমি’। কেন এ রকম নাম? কারণ, এটির ডাকের তরঙ্গদৈর্ঘ্যে ৫২ হার্টজ। অন্য যেকোনো তিমির ডাকের চেয়ে এই তরঙ্গদৈর্ঘ্যটা অস্বাভাবিক বেশি। যেমন ধরা যাক, নীল তিমির ডাকের তরঙ্গদৈর্ঘ্য ১০ থেকে ৩৯ হার্টজের মধ্যে। ফিন হোয়েল ডাকে ২০ মেগাহার্টজে।
এই তিমির আওয়াজ আলাদা হলো কী করে? হয়তো এটা জন্মগত ত্রুটি। হয়তো পরিবর্তনের প্রাকৃতিক নিয়মেই এটা ভিন্ন রকম ভোকালকর্ড নিয়ে জন্মেছে। বিজ্ঞানের ভাষায় এটাকে বলে মিউটেশন।
এই বিশেষ তিমির কথা প্রথম জানা যায় ১৯৮৯ সালে। সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে কোনো শত্রুদেশের ডুবোজাহাজ সন্তর্পণে এগিয়ে আসছে কি না, সেটা শনাক্ত করার জন্য প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশে মার্কিন নৌবাহিনী এক সারি গোপন শব্দগ্রাহক যন্ত্র পেতে রেখেছে। এগুলোকে বলে ‘সোসাস’। ওই বছর যন্ত্রগুলোয় অদ্ভুত কিছু আওয়াজ রেকর্ড হলো। বিশ্লেষণ করে বোঝা গেল, এগুলো তিমির গান। নীল তিমির গান বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু একটা আওয়াজ বড়ই খটকা লাগল বিল ওয়াটকিন্স নামের এক গবেষকের কানে। বিল সাগরের তলের প্রাণীদের নাড়িনক্ষত্র জানেন। তিনি দেখলেন, একটি আওয়াজ কোনো পরিচিত তিমির গানের সঙ্গে মিলছে না। কেননা এই আওয়াজ ৫২ হার্টজের উঁচু তারে বাঁধা। যেন একটা চেনা কনসার্টের মধ্যে অচেনা একটা যন্ত্র বেজে চলেছে।
এই বিশেষ তিমিটাকে খুঁজে বের করা বিল ওয়াটকিন্সের নেশায় পরিণত হলো। সাগর থেকে সাগরে টোটো করে ঘুরেছেন তিনি। ২০০৪ সালে ৭৮ বছর বয়সে বিল মারা যান। এর কয়েক মাস আগে বের হয় তাঁর একটি গবেষণা নিবন্ধ। ১২ বছর ধরে তিনি ওই তিমির যেসব গান রেকর্ড করেছেন, সেগুলোর বিশ্লেষণ। ওয়াটকিন্সের সিদ্ধান্ত, ৫২ হার্টজের এই আওয়াজ শুধু যে অস্বাভাবিক তা-ই নয়, এটি অনন্য।
বিলের মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে আরও বহু সমুদ্রবিজ্ঞানীর নেশার বিষয়ে পরিণত হয়েছে এই রহস্যময় তিমি। একসময় সেটা একটা সাংস্কৃতিক আইকনে পরিণত হয়েছে। যোগাযোগবিচ্ছিন্ন একাকী লোকজনের মধ্যে একটা বন্ধনের যোগসূত্র হয়ে উঠেছে তিমি। অনেকে এ নিয়ে গান লিখেছেন, অনেকে হাতের মধ্যে ট্যাটু এঁকে লিখেছেন ‘৫২ ব্লু’।
মার্কিন চলচ্চিত্র নির্মাতা জশ জেমান এবং অভিনেতা আদ্রিয়ান গ্রেনিয়ার ঘোষণা দিয়েছেন, তাঁরা এই তিমিকে নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি ছবি বানাবেন। এর জন্য লোকজনের কাছে তাঁরা টাকাও তুলতে শুরু করেছেন।
কিন্তু এক সাগর থেকে আরেক সাগরে অভিবাসী জীবন যাপন করছে যে তিমি, প্রশান্ত মহাসাগরের বিস্তীর্ণ জলরাশির মধ্যে কোনো দিন তাকে কি খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে? আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রথম ডাক শোনার পর প্রায় ৩০ বছর কেটে গেছে। এটা যদি একটা নীল তিমি হয়, তাহলে ইতিমধ্যে এটা মধ্য বয়স পেরিয়ে গেছে।
অথবা যদি দীর্ঘ একাকিত্বের একঘেয়েমি কাটাতে তিমিটা অন্য তিমিদের মতো গান গাইতে শিখে নিয়ে থাকে? যদি সেটা তার ভাষা ত্যাগ করে? তাহলে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
কয়েক বছর ধরে নাকি তিমিটার ডাক আর রেকর্ড করা যাচ্ছে না।
নিঃসঙ্গ তিমির ডাকটি শুনতে পারো এই লিংকটিতে—
https://soundcloud.com/bbc_com/the-52hz-whale-recorded-by-bill-watkins