‘বাংলাদেশের একটি ছেলে বা একটি মেয়েকেও যদি আমি বিজ্ঞানের পথে নিয়ে আসতে পারি, যদি তার সামনে মহাবিশ্বের রহস্য অনুসন্ধানের একটি নতুন দরজা খুলে দিতে পারি, তাহলেই আমার দেশে ফেরা সার্থক হবে।’ ৩০ বছরের বিলেতি জীবনের অভ্যস্ততা, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রসর বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ, চমৎকার গবেষণার পরিবেশ, সর্বোপরি মাস শেষে বাংলাদেশের টাকায় লাখ টাকার বেতন—এ সবকিছু ছেড়ে নিজের দেশে ফিরে আসা প্রসঙ্গে আমাদের বিজ্ঞানী, বিশিষ্ট তাত্ত্বিক কসমোলজিস্ট প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম প্রায়ই ওপরের কথাগুলো বলতেন। কথাগুলো যে কেবল তাঁর সহধর্মিণী বা পরিবারের বন্ধুদের বলতেন তা নয়, জানাতেন বিলেতে তাঁর সতীর্থ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংকেও। স্টিফেন হকিংয়ের সঙ্গে তাঁর ছিল ভালো বন্ধুত্ব। হকিং চাইতেন জামাল নজরুল ইসলাম বিলেতেই থেকে যান। তাই প্রায়ই বলতেন, তুমি এখানে থেকেই তো দেশের জন্য অনেক কাজ করতে পারো।
বিলেতে থেকেও দেশের জন্য কাজ করা যায় জামাল নজরুল ইসলাম সেটি জানতেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার যেন বাংলাদেশের পক্ষে থাকে সে জন্য তিনি প্রায় সব ব্রিটিশ এমপির কাছে চিঠি লিখেছেন। এমনকি ব্রিটিশ এমপি লর্ড বাটলারের মাধ্যমে গণচীনের সেই সময়কার প্রধানমন্ত্রী চৌ এনলাইয়ের কাছে অনুরোধ করেন যেন চীন পাকিস্তানের পক্ষে না দাঁড়ায়। তবে হকিংয়ের কথামতো এ রকম কিছু করাটা বাংলাদেশের মতো নতুন একটি দেশের জন্য যথেষ্ট নয়। বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়াতে হলে বাংলাদেশের তরুণদেরও বিজ্ঞানের উচ্চতর শাখাগুলোতে অবাধ সন্তরণ শিখতে হবে। কেমব্রিজে নিজের গবেষণা করে বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীদের একটি নতুন, চ্যালেঞ্জিং জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। এ কারণে জামাল নজরুল ইসলাম দেশে ফেরেন। স্মর্তব্য যে মধ্য আশির দশকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর মূল বেতন নির্ধারণ করা হয় মাত্র তিন হাজার টাকা! সেই সময় অনেকেই তাঁর এ সিদ্ধান্তে অবাক হয়েছেন। কিন্তু জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি জানতেন তিনি ভুল করেননি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন গাণিতিক ও ভৌতবিজ্ঞান গবেষণাকেন্দ্র। নিজের কাজ দিয়ে জানতেন, তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান আর কসমোলজির আঙিনায় চড়ে বেড়ানোর মতো শিক্ষার্থী এ দেশেই আছে। দরকার কেবল তাঁদের পথ দেখিয়ে দেওয়া এবং রসদ জোগান দেওয়া। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই রিসার্চ সেন্টার ফর ম্যাথমেটিক্যাল ও ফিজিক্যাল সায়েন্সে তাঁর অধীনে ৫০ জন শিক্ষার্থী এমফিল ডিগ্রি লাভ করেছেন। আর ৩৩ জন পেয়েছেন পিএইচডি ডিগ্রি! তাঁদের প্রত্যেকের কাজই আন্তর্জাতিক মানের। মনে রাখতে হবে, যে সময়ে জামাল নজরুল ইসলাম তাঁর এসব শিক্ষার্থীকে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণায় অনুপ্রাণিত করেছেন তখন এমনকি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই অর্থে ভালো মানের ইন্টারনেট সংযোগই ছিল না। (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো উচ্চগতির ইন্টারনেট সংযোগ নেই!)
ছাত্রছাত্রীদের অনুপ্রাণিত করা, তাদের অভিভাবক হওয়ার পরও তিনি তাঁর নিজের গবেষণা এবং কাজের সময়টুকু ঠিকই বের করে নিতেন। ১৯৯২ সালে তাঁর অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু ম্যাথমেটিক্যাল কসমোলজি বইটি প্রকাশিত হয়। এরও পরে লিখেছেন ফার ফিউচার অব দি ইউনিভার্স। তবে জামাল নজরুল ইসলামের সবচেয়ে বিখ্যাত বই হলো দি আলটিমেট ফেট অব দি ইউনিভার্স। ১৯৮৩ সালে কেমব্রিজ প্রেস থেকে প্রকাশের পর এটি ফরাসি, পর্তুগিজ, যুগোস্লাভ ও জাপানি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বইটি তাঁর নিজের গবেষণার সারাংশ। গবেষণার সন্দর্ভ হাতে পাওয়ার পর বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রিম্যান ডাইসন তাঁর মতো দুনিয়ার শেষ পরিণতি সম্পর্কে আকৃষ্ট হন। জামাল নজরুল ইসলামের মৃত্যুর পর তিনি স্মরণ করেছেন, জামাল ইসলামের কাজ আমাকে দুনিয়ার শেষ পরিণতি সম্পর্কে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করেছে। জামাল নজরুল ইসলাম সেই কাজটাই করেছেন, যা কি না অনেকেই করতে চায় না। কারণ, কাজটা কঠিন।
দুনিয়ার শেষ পরিণতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য অনেক ঘটনা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। প্রোটন কণার লয় থেকে দুনিয়ার তাপীয় মৃত্যু। এখনো বিজ্ঞানীরা মহাবিস্ফোরণ থেকে এই দুনিয়ার সৃষ্টি হয়েছে বলে বিশ্বাস করলেও দুনিয়ার শেষ পরিণতি কী হবে, সেটা নিয়ে নিশ্চিত হতে পারেননি। প্রসারণ দিয়ে যার শুরু, সংকোচন দিয়ে তার শেষ কি না কে জানে? তবে জামাল নজরুল ইসলাম দেখিয়েছেন, শেষের দিকে এক মহাশূন্যতা সৃষ্টি হতে পারে।
যে গুটি কয়েক বিজ্ঞানী মহাবিস্ফোরণতত্ত্বের বিপরীতে স্টেডি স্টেট থিউরি মেনে চলেন, তাঁদের অন্যতম জয়ন্ত নারলিকর কেমব্রিজে জামাল নজরুলের সহপাঠী। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের আঙিনায় তখন একঝাঁক তরুণ-তরুণীর বিচরণ, যাঁদের অনেকেই পরে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। বিকেল হলে জামাল-সুরাইয়া দম্পতি তাঁদের দুই মেয়ে সাদাফ আর নার্গিসকে নিয়ে হাঁটতে চলে যান নদীর পাড়ে। কোনো কোনো দিন সঙ্গী হয় স্টিফেন আর জেন হকিং, সঙ্গে তাঁদের ছেলে রবার্ট আর মেয়ে লুসি। আলোচনায় সৃষ্টিতত্ত্ব যেমন আসে, তেমনি আসে প্রকৃতির কথাও। প্রকৃতির সত্য উদ্ঘাটন করতে হলে প্রকৃতিকে নিজের মতো করে জানা দরকার। এই বোধ থেকে প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম তাঁর মেয়েদের প্রকৃতিপাঠে উৎসাহ দিতেন।
দেশে ফিরবেন এ পরিকল্পনা তাঁর শুরু থেকেই ছিল। তাই ঠিক সময়ে মেয়েদের বাংলা শেখানো শুরু করেন। সঙ্গে গান-বাজনা। আইনস্টাইনের জগতের এই মানুষটি পিয়ানো এবং সেতার বাজাতে পারতেন চমৎকার। চট্টগ্রামে তাঁর বাসায় নিয়মিত হতো গানের আসর। কখনো কখনো জামাল নজরুল ইসলাম বসে পড়তেন হারমোনিয়াম নিয়ে। স্ত্রী সুরাইয়া ইসলামও গলা মেলাতেন তাঁর সঙ্গে।
বিজ্ঞানের গবেষণা ছাড়াও অর্থনীতি আর সমাজ সংস্কারের বিষয়কেও শেষ জীবনে প্রাধান্য দিয়েছেন জামাল নজরুল ইসলাম। তিনি বিশ্বাস করতেন, পশ্চিমাদের প্রেসক্রিপশনে আমাদের মুক্তি নেই। উন্নত বিশ্বের প্রতি তাঁর একটাই অনুরোধ ছিল, ‘তোমরা শুধু আমাদের পথ থেকে সরে দাঁড়াও, আমাদের ভালো-মন্দ আমাদেরই ভাবতে দাও।’
আর বিশ্বাস করতেন, নতুন প্রজন্ম ঠিকই পথ বের করে ফেলবে। সে কারণে নতুনদের প্রায় সবটাতেই তার সমর্থন থাকত। আমৃত্যু তিনি ছিলেন গণিত বাংলাদেশ অলিম্পিয়াড কমিটির সদস্য।
প্রতিভাধর এই বিজ্ঞানী মারা যান ২০১৩ সালের ১৬ মার্চ। দেশের শিক্ষার্থীরা যদি বেশি বেশি করে গণিত আর বিজ্ঞানের শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়, তাহলেই কেবল এই বড় মাপের বিশ্ববিজ্ঞানীর প্রতি আমাদের প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানো সম্পন্ন হবে।