সাইকেল চালানোর জন্য ডাচদের খ্যাতি দুনিয়াজোড়া। তারা ছিপ দিয়ে মাছ না, সাইকেল ধরে এমন রসিকতাও চালু আছে। আমস্টারডামবাসীর জন্য এটা স্রেফ রসিকতা নয়। নিদারুণ সত্যি। শহরটায় লোক আছে ৭ লাখ ৮০ হাজার ৫৫৯ জন। সাইকেলের সংখ্যা আরও বেশি, ৮ লাখ ৮১ হাজার। আমস্টারডামের রাস্তায় সাইকেল চালাতে চালাতে যেকোনো সময় সাইকেল ও সাইক্লিস্ট দুজনই গোসল করে ফেলার সমূহ সম্ভাবনা আছে। কারণ, শহরটা খালে ভরা। ১৬৫টি খাল আছে গোটা শহরে। এগুলোকে জোড়া দেওয়া গেলে ১০০ কিলোমিটার লম্বা তো হতোই। এই এত এত খাল থেকে ফি বছর কম করে হলেও ১২ থেকে ১৫ হাজার সাইকেল তুলে আনতে হয় কর্তৃপক্ষকে। না, কেউ তার শখের সাইকেলখানা খালে ফেলে দেয় না, তা যতই পুরোনো হোক।
ধারণা করা হচ্ছে, হয় এগুলো চুরি যাওয়া সাইকেল। নয়তো ইস্পাতের এই ঘোড়াগুলো বর্বরতার শিকার। যাদের জীবনের সমাপ্তি ঘটে খালে ডুবে। তবে কিছু কিছু সাইকেল ওই পানির নিচ থেকে তোলার পরও যথেষ্ট ভালো থাকে। একটু মেরামত করলেই চলনসই করে নেওয়া যায়। কিন্তু তা আর হয় না। খাল থেকে তোলার পর এদের ঠাঁই হয় আস্তাকুঁড়ে।
পর্যটকদের জন্য ‘বাইসাইকেল ফিশিং’ চমকপ্রদ এক অভিজ্ঞতা। নৌকায় বসানো একধরনের ক্রেনে করে পানির তল থেকে হাজার হাজার সাইকেল তোলা হচ্ছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে মুগ্ধ বিস্ময়ে সেই দৃশ্য দেখে শত শত পর্যটক। শুধু কি ডাচ! ড্যানিশরাও কম কিসে! সাইকেল চালানোর দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে আছে তারা। ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেন ‘পৃথিবীর প্রথম সাইকেল নগরী’র তকমা পেয়েছে গেল বছর। শহরটায় সাইকেল লেনই আছে ৪০০ কিলোমিটার। এখানে গাড়ির চেয়ে বাইসাইকেল পাঁচ গুণ বেশি।
কোপেনহেগেনে মানুষ আছে ছয় লাখ, সাইকেল তার চেয়েও বেশি। এই শহরের বড় বড় কর্তাব্যক্তিরা দিব্যি সাইকেলে চেপে অফিসে যান। গৃহিণীরাও সাইকেলে চড়ে মুদি দোকানে যান। শুধু সাইকেল চালিয়ে কোপেনহেগেনের বাসিন্দারা বছরে ৯০ হাজার টন কার্বন নিঃসরণ থেকে তাদের শহরকে রক্ষা করছেন।
ছিমছাম, পরিচ্ছন্ন একটি নগরী পেতে কম দুর্ভোগ পোহাতে হয়নি কোপেনহেগেনবাসীকে। এখানকার বাসিন্দারা ১৮৮০ সাল থেকে সাইকেল চালায়। বিংশ শতকের মাঝামাঝি অবধি ভালোই কাটে তাদের সময়টা। বিপত্তি ঘটে ষাটের দশকে এসে। ড্যানিশদের নজর পড়ে চার চাকার গাড়ি আর গগনচুম্বী অট্টালিকার ওপর। ভোগবাদী হয়ে ওঠে ড্যানিশরাও। কিন্তু বেশি দিন না, এক দশকের মধ্যেই বড় রকমের ধাক্কা খেতে হয় তাদের। দেশজুড়ে তেল-সংকট দেখা দেয়। ভুল বুঝতে পারে ড্যানিশরা। আবার সাইকেলেই ফিরে যায়। আওয়াজ ওঠে ‘কার ফ্রি সানডে’র। অর্থাত্ রোববারে শহরে কোন গাড়ি চলবে না। এই দাবি আদায়ের পর শিগগিরই ‘কার ফ্রি কোপেনহেগেনে’র জন্য রাস্তায় নামে শহরের বাসিন্দারা। ভোটাভুটি অবধি গড়ায় বিষয়টি। কোপেনহেগেনবাসী মোটরগাড়ির বদলে সাইকেলকেই বেছে নেয়। এরপর নগরপিতা থেকে শুরু করে ড্যানিশ সরকার রাজধানীকে সাইকেলবান্ধব নগরী হিসেবে গড়ে তোলার কাজে হাত দেয়। পরিবেশবান্ধব, পরিচ্ছন্ন নগরী গড়ে তুলতে ইউরোপের অনেক শহরেই এখন ‘কার-ফ্রি ডে’-এর আওয়াজ উঠছে।