রাজধানীর ইট-পাথরঘেরা পরিবেশে রমনা-সোহরাওয়ার্দী উদ্যান যেন এক টুকরো স্বর্গ। বসন্ত আসি আসি করছে। বাতাবিলেবু, জারুল, ছাতিম আর আমের মুকুলের সুবাসে ভরে উঠেছে বাতাস। ছায়া সুনিবিড় পরিবেশ, পাখির কলতান, ভ্রমরের গুঞ্জন— তারই মাঝে প্রাণের মেলা। বছর তিনেক ধরেই অমর একুশে বইমেলা জমছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। শত শত স্টল, লোকজনের জমাট ভিড়, ভেঁপু বাজিয়ে শিশুদের উল্লাস। স্টলে থরে-থরে সাজানো বই। ফুলের সুবাসের সঙ্গে নতুন বইয়ের গন্ধ মিলে এক অন্য রকম অনুভূতি! ছোটরা ছবি দেখে দেখে বই কেনে—কার্টুন, কমিকস, ছড়া-কবিতা, রূপকথার গল্প। কিশোরদের প্রিয় রহস্য আর অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি। বড়রা উপন্যাস, ইতিহাস প্রবন্ধের খটোমটো বইগুলো বেশি পছন্দ করেন। মোটকথা কাউকেই নিরাশ করে না বইমেলা। বই কেনা একরকম সুখ, উপহার পাওয়ার সুখ আরেক রকম, সবচেয়ে বেশি সুখ নতুন বইয়ের গন্ধ নিতে নিতে তার ভেতর ডুবে যাওয়া।
বইমেলার ধারণাটা খুব বেশি পুরোনো নয়। তবে বইয়ের ইতিহাস বহু পুরোনো। সেই মিসরীয় সভ্যতার যুগে। সেখানে প্যাপিরাস নামে একধরনের গাছ জন্মাত। প্যাপিরাসের বাকল ছেঁচে কাগজের মতো একটা জিনিস তৈরি করত মিসরীয়রা। হায়ারোগ্লিফিকস চিত্রলিপিতে লিখে রাখত সেকালের ইতিহাস। মিসরের বিখ্যাত পিরামিড আর কবরস্থানগুলো থেকে উদ্ধার করা হয়েছে শত শত প্যাপিরাসের স্ক্রল। সেগুলোই আসলে মানবসভ্যতার প্রথম বই ছিল।
পুস্তকশিল্পে সত্যিকারের প্রাণ আসে কাগজ আবিষ্কারের পর। সে গল্পও কিন্তু আজকালের নয়। খ্রিষ্টের জন্মের ২০০ বছর আগে চীনারা কাগজ আবিষ্কার করে। কিন্তু সে খবর জানত না বাইরের পৃথিবী। ১৫০০ বছর আগে আরবের একদল ব্যবসায়ী চীন থেকে কাগজ ছড়িয়ে দেন সারা বিশ্বে। এরপরই বদলে যায় লেখালেখির গল্প। প্রথম দিকে হাতে লিখে বই বানানো হতো। পরে ছাপা বইয়ের উদ্ভব। সেটাও চীনে, নবম খ্রিষ্টাব্দে। কাঠ খোদাই করে অক্ষর তৈরি করা হয়। সেই অক্ষরের ওপর কালির ছাপ দিয়ে লেখা হয় বইটি। লম্বায় ছয় ফুট আর এক ফুট প্রস্থের সেই বইটির নাম ছিল ‘হীরক সূত্র’। বৌদ্ধদের ধর্মীয় গ্রন্থ। বইটিতে পৃষ্ঠা ছিল মাত্র দুটি। কাঠ খোদাই করে তৈরি করা অক্ষরকে বলে ব্লক লেটার। বহু বছর পর্যন্ত ছাপাখানায় এই ব্লক লেটার পদ্ধতিই ব্যবহূত হতো। দ্বাদশ শতাব্দীতে চীনেই শুরু এর ব্যবহার। তারপর সেটা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে গোটা বিশ্বে।
ব্লক লেটারে আধুনিকতা আনেন জার্মানির জোহান গুটেনবার্গ। গুটেনবার্গ ছিলেন দরিদ্র ঘরের সন্তান। লেখাপড়াও বেশি করেননি। অল্প বয়সেই জুয়েলারির দোকানে কাজ নেন। সোনা-রুপার অলংকার তৈরি করতে হতো তাঁকে। ধাতু গলিয়ে তাতে নকশা করার নানা উপায় শিখেছিলেন তিনি। সেই কাজ করতে গিয়েই মনে আসে ধাতব অক্ষর তৈরির কথা। যেই ভাবা সেই কাজ। ধাতু গলিয়ে তৈরি করে ফেলেন ব্লক লেটার। তারপর ভাবেন, এই ব্লক লেটার ছাপাখানায় ব্যবহার করলে কেমন হয়? গুটেনবার্গের সেই ভাবনাতেই বদলে যায় মুদ্রণশিল্পের ইতিহাস। কাঠের বদলে দ্রুতই ধাতুর তৈরি ব্লক লেটার ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে গোটা ইউরোপে। অক্ষরগুলো ধাতুর হলেও গুটেনবার্গের ছাপার যন্ত্রটি ছিল কাঠের তৈরি। ১৫ শতাব্দীতে তাঁর ছাপাখানাতেই প্রথমবারের মতো বাইবেল ছাপা হয়। বইয়ের প্রচ্ছদেও ভিন্নমাত্রা আনেন মুদ্রণশিল্পের এই পথিকৃত্। এক রঙের সঙ্গে আরেক রং মিশিয়ে আবিষ্কার করেন রঙিন ছবি ছাপার পদ্ধতি। আজ যে তোমরা রঙিন কমিকস বই পড়তে গিয়ে নাওয়াখাওয়া ভুলে যাও, এর জন্য কিন্তু গুটেনবার্গের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।
গুটেনবার্গের ছাপাখানা আবিষ্কার করার পর ইউরোপের অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়ে ছাপাখানা। আমরাও পাই বিখ্যাত সব বই। সপ্তদশ শতাব্দীতে ইউরোপজুড়ে বাজছে যুদ্ধের দামামা। বিখ্যাত জার্মান বিজ্ঞানী জোহান কেপলার তাঁর বিখ্যাত বই রুদলফিন টেবিল ছাপানোর জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছেন জার্মানির এই শহর থেকে সেই শহরে। সব জায়গায় মারকাটারি সেনাদের উত্পাত। অবশেষে উলম নামের ছোট্ট এক শহরে ছাপা হয় প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বইটি।
আমাদের উপমহাদেশে ছাপাখানা আসে ইউরোপিয়ানদের হাত ধরে। ১৫৫৬ সালে গোয়ায় বসানো হয় প্রথম ছাপাখানাটি। পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বসায় প্রথম ছাপাখানা। গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের উদ্যোগে। ছাপাখানার জন্য ব্লক লেটার তৈরি করেন চার্লস উইলকিন্স আর হুগলির পঞ্চানন কর্মকার। ১৮০০ সালে হুগলি জেলার শ্রীরামপুরের মিশনারিতে বসানো হয় বাংলার ঐতিহাসিক ছাপাখানাটি। উদ্যোক্তা উইলিয়াম কেরি। পঞ্চানন কর্মকার এখানে চলে আসেন। এখান থেকেই বের হয় বাংলা ভাষার প্রথম বই মঙ্গল সমাচার ।উইলিয়াম কেরি বাইবেল অনুবাদ করে ছাপান ওই প্রেস থেকেই। ভারতীয় উপমহাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসেও জড়িয়ে আছে শ্রীরামপুরে মিশনারি প্রেসের নাম। প্রথম সংবাদপত্র সমাচার দর্পণ বের হয় কেরি আর পঞ্চানন ঘোষের উদ্যোগেই। সেখান থেকে বের হলো শিশু-কিশোর ম্যাগাজিন দিগদর্শন। দিগদর্শনের হাত ধরেই ভারতীয় তথা বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যের পথচলা শুরু। দিগদর্শনের প্রথম সংখ্যা ছাপা হয় ১৯১৮ সালে। গল্প-কবিতার পাশাপাশি ছিল ‘কম্পাসের গুণ’, ‘চুম্বক পাথরের প্রথম অনুভব’ শিরোনামের লেখা। সেই কালে রেডিও, টেলিভিশন, কম্পিউটার, ইন্টারনেট কিছুই ছিল না। জ্ঞানবিজ্ঞানের নাগাল পাওয়া সহজ ছিল না তখন। দিগদর্শন তাই শিশু-কিশোরদের জ্ঞানচর্চার পীঠস্থান হয়ে ওঠে।
ঢাকায় প্রথম ছাপাখানাটি বসানো হয় ১৮৪৮ সালে। সেই যন্ত্রটা এখনো রাখা আছে জাতীয় জাদুঘরে। সেকালে বাংলাদেশের সবচেয়ে বিখ্যাত ছাপাখানাটি ছিল কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে। কাঙাল হরিনাথের ছাপাখানা। এখান থেকেই বের হয় মীর মশাররফ হোসেনের কালজয়ী উপন্যাস বিষাদ সিন্ধু।
গুটেনবার্গের মতো কাঙাল হরিনাথও লেখাপড়া শেখেননি তেমন। বাবা-মাকে হারান শৈশবেই। দৈনিক দুপয়সা বেতনে চাকরি নেন একটা কাপড়ের দোকানে। পরে নীল কুঠিতে চাকরি করেন কিছুদিন। সাধারণ প্রজাদের প্রতি নীলকর আর জমিদারের অত্যাচার চরমে উঠেছিল। তার প্রতিবাদ করেই ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় লিখতেন হরিনাথ। তারপর তিনি নিজেই প্রকাশ করেন গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা নামের একটা মাসিক পত্রিকা। এই পত্রিকার জন্যই ছাপাখানা বসান হরিনাথ। পরে পত্রিকাটা পাক্ষিক, আরও পরে সাপ্তাহিকে নেমে আসে। কাঙাল হরিনাথের ছাপাখানার সঙ্গে জড়িয়ে আছে মীর মশাররফ হোসেন, জলধর সেন লালন ফকিরের মতো বিখ্যাত মানুষের স্মৃতি। কাঙাল হরিনাথ নীলকর-জমিদারদের অত্যাচারের কাহিনি লিখতেন। যেকোনো সময় লাঠিয়াল বাহিনীর আক্রমণের ভয় ছিল। লালন ফকির ছাপাখানা পাহারা দিতেন তাঁর দলবল নিয়ে আসর জমিয়ে।
বাংলা প্রকাশনা জগতে সত্যিকারে শিল্পের ছোঁয়া দেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’ নামে একটা ছাপাখানা গড়ে তোলেন কলকাতায়। মূল উদ্দেশ্য ছিল বিখ্যাত শিশু-কিশোর পত্রিকা সন্দেশ ছাপা। অন্য পত্রিকার চেয়ে সন্দেশ ছিল একদম ব্যতিক্রম। রঙিন বাহারি ছবিতে ভরপুর সন্দেশ-এর প্রতিটি পাতা। উপেন্দ্রকিশোর নিজ হাতে সেসব ছবি আঁকতেন। তারপর সেগুলোর উপযোগী করে ধাতব ব্লক লেটার ও ব্লক ছবি তৈরি করতেন। অক্লান্ত পরিশ্রম করে তিনি সন্দেশ-এ আনেন ইউরোপীয় শিল্পের আদল। তাঁর বিখ্যাত গুপি গাইন বাঘা বাইন গল্পটিও প্রকাশিত হয় সন্দেশ-এ। আজকের কিশোরেরা যেমন কিশোর আলোর জন্য গোটা মাস অপেক্ষা করে, তখন সন্দেশ পত্রিকার আবেদন ছিল এর চেয়েও বেশি।
আর এ দেশের প্রকাশনাশিল্পের আরেক দিকপাল চিত্তরঞ্জন সাহা। প্রথমে একটা বইয়ের দোকান চালাতেন চৌমুহনীতে। তারপর ‘বাসন্তী প্রেস’ নামে একটা ছাপাখানা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। পরে চলে আসেন ঢাকায়। গড়ে তোলেন ‘ঢাকা প্রেস’ নামে একটা মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় কলকাতা চলে যান। সেখানে বসেই তাঁর মাথায় আসে ঐতিহাসিক ভাবনা। গড়ে তোলেন স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ—মুক্তধারা। প্রচুর লেখক-সাহিত্যিক সে সময় শরণার্থী হিসেবে কলকাতায় আশ্রয় নিয়েছেন। চিত্তরঞ্জন সাহা কলকাতায় বসেই মুক্তধারা থেকে একে একে বের করলেন শরণার্থী বাংলাদেশি লেখকদের ৩২টি বই।
স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে আসেন চিত্তরঞ্জন সাহা। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেই ৩২টি বই নিয়ে তিনি বসে যান বাংলা একাডেমির বর্তমান বতলায়। পাটের বস্তা পেতে। কয়েক বছর এভাবেই চলে। তার দেখাদেখি আরও কিছু প্রকাশক ফেব্রুয়ারিতে বই নিয়ে জড়ো হন বাংলা একাডেমিতে। এভাবেই যাত্রা শুরু অমর একুশে বইমেলার। দিন যত গড়িয়েছে, বাংলাদেশের পুস্তক ও মুদ্রণশিল্পও সমৃদ্ধ হয়েছে। ঢাকার অলিগলিতে গড়ে উঠেছে ছাপাখানা ও বই বাঁধাইয়ের কারখানা। সৃজনশীল প্রকাশনা সংস্থাও এখন হাজারের ওপরে। অমর একুশে বইমেলা চলে টানা ২৮ দিন ধরে। এটা এখন পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী গ্রন্থমেলা। জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার পরেই সবচেয়ে বেশি লোকসমাগম হয় একুশে বইমেলায়। জোহান গুটেনবার্গের হাত ধরে প্রকাশনাশিল্পের পথচলা শুরু হয়েছিল, এ দেশে তার সার্থক রূপায়ণ করেন শ্রীরামপুরের মিশনারিরা। আর সেটিকেই বাঙালির জাতীয় উত্সবে পরিণত করেন চিত্তরঞ্জন সাহা। ভাষার মাসে বীর ভাষাসৈনিকদের পাশাপাশি গুটেনবার্গ, কাঙাল হরিনাথ, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী আর চিত্তরঞ্জন সাহার প্রতিও রইল বিনম্র শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা।
সূত্র : হিস্ট্রি ডট অরগ