বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে চাকমা, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, রাখাইন, খুমি, ত্রিপুরা, মুরং, বম, পাংখোয়াসহ ১৩টি আদিবাসী সম্প্রদায়ের বসবাস। এর মধ্যে সংখ্যায় সবচেয়ে ছোট ‘চাক’ সম্প্রদায়। অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষ সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসতি করলেও চাক সম্প্রদায়ের বসতি শুধু বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার দুর্গম কয়েকটি গ্রামে। একেবারেই ভিন্ন রকম এদের জীবনযাত্রা আর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।
বৈচিত্র্যময় চাক ও তাদের পল্লি
নাইক্ষ্যংছড়ি সদর থেকে দক্ষিণের আঁকাবাঁকা পথে ছয় কিলোমিটার গেলেই চোখে পড়বে চাক পল্লি ‘মধ্যম চাকপাড়া’। খুঁটির ওপর তৈরি ‘মাচাং ঘরে’ তাদের বসবাস। প্রত্যেক বাড়ির পেছনে থাকে বাঁশের তৈরি ‘জলঘর’। সামনে ঢেঁকিশালা।
চাকরা দেখতে মারমা ও চাকমাদের মতো হলেও তাদের পোশাকে কিছুটা পার্থক্য থাকে। চাক নারীরা কালো মোটা সুতার ফাঁকে ফাঁকে লাল সুতা দিয়ে তৈরি থামি পরেন। তাঁদের চেনার উপায় হচ্ছে বয়স্ক নারীরা কানে আদি যুগে ব্যবহৃত দুই ইঞ্চি ব্যাসের রৌপ্য কর্ণফুল (নাতংপ্র) ব্যবহার করেন।
চাকপল্লিতে ছেলেমেয়েরা ব্যস্ত থাকে ঘিলাখেলা, ডাংগুলি, কানামাছি, লাটিম, মল (দাঁড়িয়াবান্ধা) খেলা নিয়ে। আধুনিক বিশ্বের জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেট, ফুটবল এখানে নেই। স্বাস্থ্য-শিক্ষাসহ নানা কিছু থেকে বঞ্চিত এই পল্লির দরিদ্র শিশু কিশোরেরা।
গ্রামের প্রবেশমুখে খোলা মাঠ। মাঠের এক পাশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ের সামনে লাল ব্লাউজ আর কালো সবুজ থামি পরা কয়েকজন চাক তরুণীর জটলা। গলায় তাঁদের রুপার অলংকার, মাথায় খোঁপা আর পিঠে জুমচাষের ঐতিহ্যবাহী ঝুড়ি। আমাদের সৌজন্যে তাঁরা গেয়ে উঠলেন ‘সাব্বা নায়েমা-প্রেসামা’ নৃত্যগান। গানের অর্থ হলো ‘রাজাকে প্রণাম।’ অর্থাৎ গ্রামে কোনো অতিথি এলে চাকরা এই গান গেয়ে তাদের অভ্যর্থনা জানায়।
চাক মেয়েদের পরিবেশিত জুমের ফসল ঘরে তোলার আনন্দ নৃত্যগান (জুমের মেয়েরা জুমে যাচ্ছে, উম ধরে-কাঁচি ধরে...) অসাধারণ। মাঠে চলে মেয়েদের জনপ্রিয় ‘ঘিলাখেলা’। স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, পাড়ার আবালবৃদ্ধবনিতা দাঁড়িয়ে এসব নৃত্যগান ও খেলা উপভোগ করেন।
জীবন-জীবিকা
নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত এই চাকপল্লি। পল্লিতে ৬৪ পরিবারে ২৫৬ জনের বসবাস। উপজেলার দোছড়ি, বাইশারীতেও চাকদের দুটি পল্লি রয়েছে। সব মিলিয়ে চাকদের সংখ্যা সাড়ে তিন হাজার।
জুমচাষ চাকদের প্রধান পেশা হলেও এখন অনেকে বেকার। কারণ, জুমচাষের অধিকাংশ জমি বাঙালিদের দখলে চলে গেছে। নারীরা পরিত্যক্ত জমি কিংবা বসতবাড়ির আঙিনায় শাকসবজি, তরিতরকারি ও ফলমূলের চাষ করে আয়-রোজগার করেন। অনেকে ঘরের নিচে তাঁতে তৈরি করেন রকমারি কাপড়। কিন্তু এতে তাঁদের অভাব দূর হয় না।
এই পল্লির বাসিন্দা মং রি চাক (৪৪) বলেন, জুমচাষের জমি হারিয়ে কয়েক শ নারী-পুরুষ এখন বেকার জীবন কাটাচ্ছেন। চাকদের সমস্যা নিয়ে গণমাধ্যমে তেমন লেখালেখিও হয় না।
স্থানীয় হেডম্যান বাচা চিং চাক (৩৯) বলেন, আগে জুমচাষের ওপর ৯০ শতাংশ চাক পরিবার নির্ভরশীল ছিল। এখন ১০ শতাংশ। ভূমি বন্দোবস্তি বন্ধ থাকলেও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জমি ইজারা নিয়ে রাবার বাগান করছেন। সংখ্যায় অতি কম বলে প্রতিবাদও করা যাচ্ছে না।
পাড়াপ্রধান (কারবারি) অং থোয়াই চিং চাক বলেন, আর্থিকভাবে অসচ্ছল বলে বহু পরিবারের ছেলেমেয়েরা প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোতে পারছে না। ফলে চাকদের চাকরিও তেমন জুটছে না।
কলেজছাত্রী লা এ চিং চাক বলেন, ‘ঘরে বিনোদনের কিছু নেই। টেলিভিশনে খবরাখবরও দেখা যায় না। মুঠোফোনও ব্যবহার করা যায় না নেটওয়ার্ক নেই বলে। আমরা সব দিক থেকে পিছিয়ে।’
ভাষা ও সংস্কৃতি
চাকদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে। রয়েছে নিজস্ব ভাষার বর্ণমালাও। বই আছে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত। কিন্তু এই বই স্কুলে পড়ানো হয় না। ফটোকপি করা এই বই ঘরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
চাক ভাষায় ‘নৃত্য’কে বলা হয় ‘তু’, গানকে বলে ‘আছাগা’। এক হলো আ, দুই হলো নিঙ আর পাঁচ হলো ঙা। চাকরা বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। তারা দেবতা পূজাও করে থাকে।
নেই মামা
চাকদের জীবনে জন্ম-মৃত্যু ও বিবাহে গোত্রের ভূমিকা অনেক। চাকদের গোত্র দুটো। আন্দো ও ঙারেক। চাকদের একই গোত্রের ছেলেমেয়েদের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ। সে কারণে চাক সম্প্রদায়ের স্বগোত্রের মধ্যে ‘বেয়াই-বেয়াইনি’ কিংবা ‘মামা-ভাগিনা’ নেই।
জন্ম-মৃত্য-বিয়ে
সন্তান প্রসবের আগে থেকে সন্তানসম্ভাবা মহিলাকে ঘরের একটি আলাদা কক্ষে রাখা হয়। শিশু জন্মের পর ধাই নবজাতককে সুগন্ধিযুক্ত পানিতে স্নান করান। তারপর পাত্রে রাখা ভাতের সঙ্গে মেশানো মিষ্টিতে একটি জ্বলন্ত অঙ্গার ফেলে দেওয়া হয়। একজন বৃদ্ধা ওই পাত্রে আঙুল ডুবিয়ে নবজাতকের কপাল, হাত ও পা স্পর্শ করেন। এই আয়োজনকে বলা হয় ‘পুতরংবুওয়ে’।
এরপর সাত টুকরা কাঁচা হলুদ কেটে নবজাতকের পা ধোয়া হয়। শিশু জন্মের পরও মাকে ওই বিশেষ কক্ষে সাত দিন থাকতে হয়। এরপর প্রথম যেদিন শিশু নিয়ে মা কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন, তখন শাশুড়ি নবজাতক ও মাকে সুগন্ধিযুক্ত পানি ছিটিয়ে আশীর্বাদ করেন। নবজাতক তার পূর্বপুরুষদের কেউ না কেউ, এমন ধারণা থেকে পূর্বপুরুষদের নামের সঙ্গে মিল রেখে শিশুর নাম রাখা হয়।
আগে চাক ছেলেমেয়েদের বিয়ে ছোটবেলায় ঠিক করা হতো। বরপক্ষকে কনেপক্ষের কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে কমপক্ষে তিনবার যেতে হয়। বর ও কনের কোষ্টির রাশিচক্র মিলতে হয়। না মিললে বিয়ে হবে না।
বউকে ঘরে আনার সময় পথে পথে বউকে ভাত খাওয়ানো হয়। বরের বাড়িতে পৌঁছালে বউকে কাছারিঘরে রাখা হয়। গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা এসে বউকে নানা কথা জিজ্ঞেস করেন। এরপর বউকে ঘরে তুলে দেওয়া হয়।
ঘরে তরুণেরা দুটি মোরক ও মুরগি রান্না করে ‘পৈদাং’ টেবিলে রাখে। দুটি কলসিতে সুতা বেঁধে পরিষ্কার পানি রাখা হয় এবং মিলনমন্ত্র পাঠ করে ওই কলসির পানি দিয়ে বর ও কনেকে পা ও মাথায় ছিটিয়ে মিলন অনুষ্ঠান ঘটানো হয়। বিয়ের পর বর ও কনে কমপক্ষে সাত দিন কোনো চাক গ্রামে প্রবেশ বা যেতে পারে না। গেলে একটি শূকর বা মুরগি জরিমানা দিতে হয়। বিয়ের এক মাস পর বউকে নিয়ে বরপক্ষকে কনের বাড়িতে যেতে হয়। সঙ্গে নিতে হয় বিশেষ পানীয় ও মুরগি।
সন্তান জন্ম নিলেও একইভাবে এক কলসি পানীয় ও পিঠা নিয়ে কনের বাড়িতে যেতে হয়। বাবা মার কাছে মেয়ে এ সময় নিজের অংশের সম্পত্তি দাবি করেন। এ সময় বাবা-মা সামাজিক রীতি অনুযায়ী নগদ টাকা-গরু, মহিষ, ছাগল, শূকর, অলংকার প্রদান করেন।
চাকদের মধ্যে কেউ মারা গেলে চিতায় দাহ করা হয়। এর আগে বৌদ্ধভিক্ষুর কাছে পঞ্চশীল গ্রহণ করা হয় এবং মৃতের উদ্দেশে দান-দক্ষিণা করা হয়।
তবে হাসপাতালে কিংবা অন্য কোথাও চাকদের মৃত্যু হলে ওই লাশ নিয়ে গ্রামে ঢুকতে দেওয়া হয় না। কারণটা অজানা। চাক নেতারা বলেন, ৩০০ বছর ধরে এই নীতি অনুসরণ করে আসছে তারা।