প্রিয় ছাত্রছাত্রীরা, এত দিনে তোমরা নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছ কেবল বই পড়াবার আর পুরস্কার দেবার জন্য আমরা তোমাদের এখানে ডাকিনি। তোমাদের আমরা ডেকে এনেছি তোমাদের শৈশবকে সুন্দর করার জন্য, যাতে তোমাদের গোটা জীবনটা সুন্দর হয়ে যায়। সে জন্য আমরা কেবল বই পড়াইনি। যা-কিছুর সংস্পর্শে এলে জীবন সত্যি সুন্দর হয়, সে-সবকিছুর সংস্পর্শে তোমাদের আনার চেষ্টা করেছি। হয়তো সেই চেষ্টা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়নি।
আজ এই ঘরে তোমরা যেভাবে জড়ো হয়েছ, ঠিক সেভাবেই তোমাদের আগে আরও ২০টি ব্যাচ নিজ নিজ বছরের কর্মসূচির শেষে জড়ো হয়েছিল। তোমাদের মতো তারাও এভাবেই পুরস্কার নিয়ে ফিরে গেছে। এবার তোমরা এসেছ। আগামীতেও হয়তো অন্যরা আসবে। একটা নিষ্ঠুর কাজ আজ আমাদের করতে হবে—তোমাদের পুরস্কার দিতে হবে। সত্যি সত্যি এটা আমরা দিতে চাই না। মূল্যায়ন পরীক্ষা দিয়ে কি প্রতিভার বিচার করা যায়? হয়তো ভুল বিচারের শিকার হয়ে অনেকেই আজ পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হবে। অনেকের হূদয় ভেঙে যাবে। কিন্তু না দিলেও তো আবার নয়, তোমাদের অনেকেই হয়তো পুরস্কারের জন্যই প্রতিযোগিতায় এসেছ। না দিলে তারা দুঃখ পাবে। তবু না বলে পারছি না যে পুরস্কারের কিছু ভালো দিক থাকলেও ছোট্ট একটা খারাপ দিক আছে। আমার এক ধনী বন্ধু ছিলেন, নাম বাদল ঘোষ। ঘটনাটা ১৯৮৮-৮৯ সালের। তখন কেন্দ্রের খুব আর্থিক দুর্দিন। বাদল ঘোষকে একদিন ফোনে বললাম, আমাদের কিছু টাকা দরকার, দিন না আমাদের জনাকয় মালদার আর দিলদার লোক জোগাড় করে। শুনে ফোনের ওধার থেকে তিনি অট্টহাসি করে উঠলেন। বললেন, বড় কঠিন দায়িত্ব দিলেন ভাইরে। এমন লোক কোথায় পাব! এই দুনিয়ায় যার ‘মাল’ থাকে তার যে ‘দিল’ থাকে না; আর যার ‘দিল’ থাকে তার যে ‘মাল’ হয় না। তোমরা ভুলো না যে পুরস্কার শেষ পর্যন্ত একটা বৈষয়িক ব্যাপার। মাল। এটা বাড়লে দিল কমে যায়। কাজেই যতই পারো পড়ো, গান গাও, ছবি আঁকো, রসগোল্লা খাও, ফিল্ম দেখো, আনন্দে-ফুর্তিতে থইথই করে তোলো জীবনকে, পুরস্কার চেয়ো না। জিনিসটা ভালো না। এতে হৃদয়ের শুদ্ধতা হারিয়ে যায়। স্থূল চাওয়ায় আত্মার আনন্দ নষ্ট হয়।
এত দিনে তোমরা নিশ্চয়ই টের পেয়েছ আমাদের জীবন দুটো। একটা মালের, একটা দিলের। একটা আসমানদারির, একটা দুনিয়াদারির। জীবনে এই দুটোকে মেলাতে হয়। তবেই তা হয়ে ওঠে উচ্চতর জীবন। এর কোনো একটা দিক খুব বেশি হলে জীবন এক পাশে হেলে পড়ে। অবশ্য এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে এটা বলব—যা করবে পুরো জীবন দিয়ে করবে। আমাদের সঙ্গে এক ভদ্রলোক পরিবেশ আন্দোলন করেন—নাম যশোধন প্রামাণিক। তিনি পাখিদের ভালোবাসেন। পাখিদের কেউ যাতে না মারতে পারে, তাদের কষ্ট না দেয় তার জন্য তাঁর উৎকণ্ঠা আর সংগ্রামের শেষ নেই। দেশের মানুষকে উদ্দেশ করে তিনি একটা কবিতা লিখেছেন।
সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি
মানুষের চাহিদা বিশাল,
পাখির চাহিদা শুধু
ছোট্ট একটি ডাল।
পাখিদের ছোট্ট এই ডালটুকুকে নিরাপদ করতে তাঁর যে কী অসীম চেষ্টা! গণ্ডগ্রামের মানুষ তিনি। লেখাপড়াও তেমন নেই। কিন্তু ঘর-সংসার ফেলে সচিব-মন্ত্রী থেকে দেশের প্রতিটি বিবেকমান মানুষের দুয়ারে দুয়ারে তিনি আবেদন করে বেড়াচ্ছেন—যাতে দেশের পাখিদের বাঁচতে দেওয়া হয়। সামান্য মানুষ তিনি, কে তাঁর কথায় কান দেবে? তবু সচিবালয় থেকে শুরু করে সরকারের দপ্তরে দপ্তরে ঘুরে অপরিসীম শ্রমে তিনি সরকারকে দিয়ে এয়ারগান নিষিদ্ধ করিয়েছেন। তিনি দেখেছিলেন, বন্দুকের গুলির দাম বেড়ে যাওয়ায় বন্দুক দিয়ে কেউ এখন আর পাখি শিকার করছে না, করছে এয়ারগান দিয়ে। তাই ওটা নিষিদ্ধ করতে হবে। পাখিদের নিশ্চিন্ত জীবন দেওয়ার জন্য স্কাউটদের সংগঠিত করে পাখি রক্ষার জন্য সারা দেশে আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। আনসার-ভিডিপির সাহায্য নিয়ে রাস্তাঘাটে পাখি বিক্রিও কমিয়ে এনেছেন। এখন তিনি তাবৎ প্রাণীদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য আন্দোলন করছেন। পুরান ঢাকায় ঘুরে ঘুরে মুমূর্ষু বানরদের সকাল-বিকেল খাবার দিচ্ছেন। কেন করছেন এসব? করছেন প্রাণীদের ভালোবাসেন বলে, তাদের জন্য বেদনা অনুভব করেন বলে। কে জাতীয় নায়ক আজ দেশে? কালোটাকার মালিক, দুর্নীতিপরায়ণ মন্ত্রী আর রাজনীতিবিদেরা, পরীক্ষায় ভালো ফল করা মোটা বেতনের চাকরি করা বড় সাহেবেরা, নাকি এই যশোধন প্রামাণিক? আমি যশোধন প্রামাণিকদেরই আজকের বাংলাদেশের নায়ক মনে করি। বাকিরা দেশকে ধ্বংস করবে, খুব জোর টিকিয়ে রাখবে, আর যশোধনেরা এগিয়ে দেবে।
যশোধন কি বৈষয়িক মানুষ? পৃথিবীতে যাঁদের আমরা স্মরণ করি তাঁরা কি বৈষয়িক? না, তাঁরা বৈষয়িক নন। কারণ, তাঁরা নেন না, দেন। যে দেবে সে বৈষয়িক হবে কী করে? তাই দুনিয়াদারি ভালো, কিন্তু আসমানদারি—প্রেম, ভালোবাসা, স্বার্থহীনতা, অবৈষয়িকতা, অন্যের জন্য আত্মোৎসর্গ—আরও ভালো। কী চান এই যশোধন? প্রাণীদের জন্য আরও একটু ভালো বাসযোগ্য জীবন তিনি শুধু চান। আরও একটু বাসযোগ্য, আরও একটু সুন্দর পৃথিবী। শ্রম দিয়ে, কষ্ট দিয়ে সে জগত্ তৈরি করতে তিনি চেষ্টা করেন। তাই লোকে তাঁকে পাগল বলে। কিন্তু ভেবে দেখো, পাগল বলেই-না তাঁর এত শক্তি। এঁরা না হলে পৃথিবীকে এগিয়ে নিত কারা? সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ হলে সে কি এতসব করতে পারত? সে তো দিনরাত টাকার পেছনে ছুটত!
একটা গল্প বলে কথা শেষ করি। আমার বয়স তখন বিশ-পঁচিশ। একদিন বাসায় ফিরতেই আব্বা বললেন, ‘তোর কাছে একজন লোক এসেছিল রে, তোদেরই বয়সের। সে বলল, সু-দূ-র বগুড়া থেকে সে শুধু তোর সঙ্গে দেখা করতেই ঢাকায় এসেছে।’
বগুড়া তখন সত্যি ছিল অনেক দূরে। ঢাকা থেকে যেতে প্রায় ১২ ঘণ্টা লাগে। এখন তোমরা যে মসৃণ রাস্তা দিয়ে গাড়ি চেপে চলে যাও, তখন রাস্তা সে রকম ছিল না। রাস্তার ওপর গাড়ির চাকা বরাবর দু-সারি ইট বসানো, মাঝখানে ঘাস। তার ওপর দিয়ে গাড়ি চলছে। একটু এদিক-ওদিক হলেই গাড়ি রাস্তা থেকে বেরিয়ে যেত। সেই রাস্তা দিয়ে বাসে চেপে সুদূর বগুড়া থেকে সে এসেছে।
আব্বার কাছে ঘটনা শুনেই আমি টের পেলাম কে এসেছিল। ষাটের দশকে আমরা তরুণদের যে সাহিত্য-আন্দোলন করছিলাম, সে তার একজন উদ্দীপ্ত কর্মী। চিঠি লিখে প্রায়ই এই আন্দোলনের ব্যাপারে তার শিহরণের কথা সে আমাকে জানাত।
আমি বললাম, ‘আব্বা, আপনি যখন ওর সঙ্গে কথা বলেছিলেন তখন কি কিছু টের পেয়েছিলেন?’ আব্বা বললেন, ‘কী’? বললাম: ‘ওর মাথায় কিছুটা ছিট আছে।’ শুনে আব্বা হো হো করে হেসে উঠে বললেন, ‘ছিট আছে বলেই তো এসেছে রে। তা না হলে তোর মতো মানুষের সঙ্গে দেখা করার জন্য সুদূর বগুড়া থেকে কোনো সুস্থ মানুষ কি ঢাকায় আসতে পারত?’
আমরা আজ এ দেশে এমনি ছিটওয়ালা মানুষ চাই, পাগল চাই—মহত্ পাগল। যারা নিজের জীবন অন্যের জন্য দিতে পারবে, সেই পাগল।
আমাদের সবারই মাথার খুলির ভেতর আরব্য উপন্যাসের দৈত্যের মতো এক মহাশক্তিধর দৈত্য আছে। স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালে সে পারে না এমন কিছু নেই। কিন্তু নানা স্বার্থবুদ্ধি, বৈষয়িক বিবেচনা, ভীরুতা, দ্বিধা, সংকোচ—এসবের কারণে আমাদের খুলির আবরণের ভেতর সে আটকা পড়ে থাকে। জীবনের শুরুর দিকের কোনো মানসিক বা শারীরিক অভিঘাত বা প্রচণ্ড আবেগের আঘাতে সেই খুলির কোথাও যদি ছোট এক-আধটু ছিদ্র হয়ে যেতে পারে তবে তার ভেতর দিয়ে সেই পরাক্রমশালী দৈত্য বেরিয়ে পৃথিবীজুড়ে দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড বাধিয়ে দেয়। তখন বগুড়া থেকে ঢাকা কি, মার্কোপোলো বা ইবনে বতুতার মতো পৃথিবী তোলপাড় করে ঘুরে বেড়ানো অসম্ভব নয়। এই অসীম পরাক্রমশালী দৈত্যটি বেরিয়ে এসেছিল বলেই না আলেকজান্ডার আলেকজান্ডার, কার্ল মার্ক্স কার্ল মার্ক্স, গৌতম বুদ্ধ গৌতম বুদ্ধ।
আবারও বলি, বই পড়ে, পুরস্কার নেওয়ার জন্য আসলে আমরা তোমাদের এখানে ডাকিনি। তোমাদের মধ্যে যাতে ওই মহত্ পাগলটা বিকশিত হয়, সে জন্য ডেকেছি। যাতে মাতালের মতো তোমরা বাঁচতে শেখো, বোকার মতো মরতে শেখো। যেন নিজের অজান্তে তুমি মানবজাতিকে ভালোবাসতে পারো, তাদের জন্য নিজেদের দিতে শেখো। আজকাল ছেলেমেয়েরা অসুস্থ মানুষের জন্য রক্ত দেয়, এই দেওয়াটা আমার অসম্ভব ভালো লাগে। ছেলেমেয়েরা যে অন্তত দিতে শিখছে, এতেই আমি খুশি হই। রক্ত তো মানুষের নিজের শ্রম-ত্যাগ-সংগ্রাম দিয়ে তৈরি না, নিজের জিনিসও না। মানুষের শরীরে এটা প্রকৃতি থেকেই আসে। তবু ভাবি, দিক না তা! দিতে শিখুক। বেশ কিছুদিন দেওয়া হলে বলব, এবার আরও বড় কিছু দাও, নিজের জিনিস দাও—নিজের কষ্ট দিয়ে, শ্রম দিয়ে, দুঃখ দিয়ে যা অর্জন করেছ, তা। এককথায় তোমার জীবনটাকে দাও।
আমি একটা ছেলেকে চিনতাম। নাম জীবন দে। নাম শুনলেই মনে হতো, নিজের জীবন দেওয়ার জন্য সে যেন মুখিয়ে আছে। রসিকতা করে তাকে
বলতাম, তোমার মা তোমার নাম রেখেছেন জীবন দে, আর সারাক্ষণ তুমি চেষ্টা করছ জীবন নিতে। এ কেমন কথা?
অন্যেরা যাই করুক, তুমি অন্তত ভালো হও। পৃথিবীর জন্য নিজেকে দাও, পৃথিবীর ভালো তোমাকে দিয়েই শুরু হোক না।
ধন্যবাদ।