মহাকাশ
চাঁদ–বিজয়ী ১২ অভিযাত্রী
চাঁদের বুকে আমাদের প্রথম পা রাখার পেরিয়ে গেছে প্রায় ৫২ বছর। ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই অ্যাপোলো মিশনের মধ্য দিয়ে চাঁদের বুকে প্রথমবারের মতো পদচিহ্ন আঁকেন নিল আর্মস্ট্রং। এরপর টানা তিন বছরে চাঁদের বুকে পা রাখার সুযোগ পান সৌভাগ্যবান ১২ জন। এবার চন্দ্রভ্রমণকারীর আদ্যোপান্ত থাকছে তোমাদের জন্য।
অ্যাপোলো–১১ | অবতরণ: ২০ জুলাই ১৯৬৯
নিল অ্যালডেন আর্মস্ট্রং, কমান্ডার
(৫ আগস্ট ১৯৩০–২৫ আগস্ট ২০১২)
চাঁদের বুকে প্রথমবারের মতো মানুষের পদচিহ্ন আঁকেন মানুষটি। ছোট থেকেই অসাধারণ মেধাবী ছিলেন তিনি। পেশায় তিনি ছিলেন অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ার, ন্যাভাল এভিয়েটর ও পাইলট। নভোচারী হওয়ার আগে তিনি কোরিয়ান যুদ্ধে অংশ নেন। এই মিশনের পর তিনি নভোচারী পেশা থেকে অবসর নেন। পরবর্তী সময়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। করোনারি বাইপাস সার্জারিসংক্রান্ত জটিলতায় ভুগে তিনি মারা যান।
এডউইন ইউজিন বাজ অলড্রিন জুনিয়র, লুনার মডিউল পাইলট
(২০ জানুয়ারি ১৯৩০–বর্তমান)
নীল আর্মস্ট্রংয়ের সঙ্গেই ছিলেন বাজ অলড্রিন। ১৯৬৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্যাল স্পেস এজেন্সিতে যোগদানের আগে অলড্রিন ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর পাইলট। কোরিয়ান যুদ্ধে তিনি ৬৬টির বেশি বিমান মিশন পরিচালনা করেন। ১৯৬৬ সালে নাসার জেমিনি ১২ মিশনেও তিনি যুক্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি নাসা থেকে অবসর নেন। বর্তমানে ৮৯ বছর বয়সী এই নভোচারী বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষকে চাঁদের অভিযানের গল্প শুনিয়ে বেড়ান।
অ্যাপোলো–১২ | অবতরণ: ১৯ নভেম্বর ১৯৬৯
চার্লস পেট কর্নাড, কমান্ডা
(২ জুন ১৯৩০–৮ জুলাই ১৯৯৯)
তৃতীয় মানুষ হিসেবে চাঁদের বুকে হাঁটেন চার্লস কর্নাড। নাসার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আগে কাজ করতেন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীতে। নাসার জেমিনি ৫ মিশনে টানা আট দিন তিনি মহাকাশে ছিলেন। অ্যাপোলো মিশনের পরে স্কাইল্যাব ২ মিশনেও কমান্ডার ছিলেন তিনি। ৬৯ বছর বয়সে ক্যালিফোর্নিয়ার ওজাই শহরে এক মর্মান্তিক মোটর দুর্ঘটনায় মারা যান চার্লস।
অ্যালান ল্যাভেন বিন, লুনার মডিউল পাইলট
(১৫ মার্চ ১৯৩২–২৬ মে ২০১৮)
কমান্ডার পেট কর্নাডের সঙ্গে চতুর্থ মানব হিসেবে চাঁদের বুকে পা রাখেন ল্যাভেন বিন। ৩৭ বছর বয়সে এই মিশনের মধ্য দিয়েই মহাকাশে প্রথম ভ্রমণ করেন এই নভোচারী। ১৯৭৩ সালে আমেরিকান স্পেস স্টেশনের স্কাইল্যাব ৩ মিশনে শেষবারের মতো নভোচারী হিসেবে কাজ করেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে ১৯৬৬ সালে তিনি নাসায় কর্মজীবন শুরু করেন। ল্যাভেন বিন ৮৬ বছর বয়সে মারা যান।
অ্যাপোলো–১৪ | অবতরণ: ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১
অ্যালান বার্টলেট আল শেপার্ড জুনিয়র, কমান্ডার
(১৮ নভেম্বর ১৯২৩–২১ জুলাই ১৯৯৮)
৪৭ বছর বয়সে সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তি হিসেবে চাঁদে পা রাখার কৃতিত্ব অর্জন করেছেন আল শেপার্ড। ১৯৬১ সালে প্রথমবারের মতো আমেরিকান নাগরিক হিসেবে মহাকাশ ভ্রমণ করেন তিনি। সব মিলিয়ে সারা জীবনে দুবার মহাকাশ ভ্রমণ করেন তিনি। লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান।
এডগার ডিন অ্যাড মিশেল, লুনার মডিউল পাইলট
(১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩০–৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬)
মিশনে আল শেপার্ডের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন তিনি। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। চাঁদের বুকে সবচেয়ে বেশি পথ হাঁটেন। তিনি প্রায় ৯ ঘণ্টা অবস্থান করেন সেখানে। চাঁদের মাটিতে তিনি প্রথম ভূমিকম্প পরীক্ষা করেন। যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা চাঁদে উড়িয়ে তিনি নিজের ছবি তোলেন, যা পরে ‘বেস্ট অ্যাস্ট্রোনাট সেলফি’-এর স্বীকৃতি পায়। ১৯৭২ সালে নাসা থেকে অবসর নেন তিনি। ৮৫ বছর বয়সে ফ্লোরিডায় মৃত্যুবরণ করেন অ্যাড মিশেল।
অ্যাপোলো–১৫ | অবতরণ: ৩১ জুলাই ১৯৭১
ডেভিড র্যানডফ ডেভ স্কট, কমান্ডার
(৬ জুন ১৯৩২–বর্তমান)
ওয়েস্ট পয়েন্ট মিলিটারি একাডেমি থেকে স্নাতক শেষে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীতে যোগ দেন তিনি। সপ্তম মানুষ হিসেবে এই মিশনে চাঁদের বুকে পা রাখেন ডেভ স্কট। জেমিনি ৮, অ্যাপোলো ৯–সহ তিনটি মহাকাশ মিশনে অংশ নেন তিনি। সহযাত্রী জেমস ইরউইনের সঙ্গে সাড়ে ১৮ ঘণ্টা ছিলেন তিনি। ৪২ বছর বয়সে তিনি দুই বছরের জন্য নাসার ফ্লাইট রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করেন।
জেমস বেনসন জিম আরউইন, লুনার মডিউল পাইলট
(১৭ মার্চ ১৯৩০–৮ আগস্ট ১৯৯১)
জিম আরউইন যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনী থেকে নাসায় যোগ দেন। চাঁদের বুকে নানা রকম বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা–নিরীক্ষা চালান তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের পতাকার পাশে দাঁড়িয়ে মিলিটারি স্যালুট দেন। তিনি চাঁদ থেকে ১৭০ পাউন্ড ওজনের পাথর সংগ্রহ করে আনেন। বিজ্ঞানীরা জানান যে এই পাথরের বয়স প্রায় ৪ বিলিয়ন বছর। মিশনের আগে তিনি ডেভ স্কটের সঙ্গে মোজাভ মরুভূমিতে পাথর নিয়ে পরীক্ষামূলক গবেষণা করেন। ৬১ বছর বয়সে হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি মারা যান।
অ্যাপোলো–১৬ | অবতরণ: ২১ এপ্রিল ১৯৭১
জন ওয়াট ইয়ং, কমান্ডার
(২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৩০–৫ জানুয়ারি ২০১৮)
অ্যাপোলো–১০ মিশনে শুধু চাঁদের কক্ষপথে ভ্রমণ করেন ওয়াট ইয়ং। অ্যাপোলো–১৬ মিশনে চাঁদের বুকেই পদচিহ্ন আঁকেন তিনি। নাসাতে ৪২ বছর ধরে কর্মরত ছিলেন তিনি। জেমিনি, অ্যাপোলো সার্ভিস মডিউল, অ্যাপোলো লুনার মডিউল ও স্পেস শাটলের মতো বড় বড় মিশনে যুক্ত ছিলেন তিনি। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ৮৭ বছর বয়সে মারা যান ওয়াট ইয়ং।
চার্লেস মস চার্লি ডিউক জুনিয়র, লুনার মডিউল পাইলট
(৩ অক্টোবর ১৯৩০–বর্তমান)
৩৬ বছর বয়সে সবচেয়ে কম বয়সী চাঁদে ভ্রমণকারীদের তালিকায় নাম লেখান মস চার্লি। তিনি ১৯৬৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনী ছেড়ে নাসায় যোগ দেন। মহাজাগতিক রশ্মি শনাক্তকরণ, অতিবেগুনি রশ্মি পরীক্ষা আর চাঁদের সবচেয়ে অমসৃণ তলে পরীক্ষা চালান তিনি। ১৯৭৫ সালে নাসা থেকে অবসর নিয়ে তিনি ব্যক্তিগত ব্যবসা শুরু করেন।
অ্যাপোলো–১৭ | অবতরণ: ১৯ ডিসেম্বর ১৯৭২
ইউজিন অ্যানড্রিউ জিন স্যারনান, কমান্ডার
(১৪ মার্চ ১৯৩৪–১৬ জানুয়ারি, ২০১৭)
১১তম মানুষ হিসেবে চাঁদের বুকে পা রাখলেও শেষ পদচিহ্নটি ছিল স্যারনানের। কারণ, তাঁর পাইলট জ্যাক স্মিথ আগে রকেটে উঠে রকেট চালু করেন। যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর অফিসার ছিলেন তিনি। ফাইটার পাইলট, ইলেকট্রিক্যাল ও অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করেন তিনি। জেমিনি ৯, অ্যাপোলো ১০ ও অ্যাপোলো ১৭ মিশনে যুক্ত ছিলেন তিনি। চাঁদের বুকে প্রতি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ২ মাইল রোভার চালান তিনি। ৮৩ বছর বয়সে টেক্সাসে মারা যান তিনি।
হ্যারিসন হ্যাগান জ্যাক স্মিথ, লুনার মডিউল পাইলট
(৩ জুলাই ১৯৩৫–বর্তমান)
একমাত্র বিজ্ঞানী হিসেবে চাঁদের বুকে পা রাখেন জ্যাক স্মিথ। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি একসময় যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর ছিলেন। ১৯৭৫ সালে নাসা থেকে অবসর নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকোর হয়ে ১৯৭৬ সালে নির্বাচনে দাঁড়ান তিনি। চাঁদের বুকে এখন পর্যন্ত শেষ পা রেখেছেন এই মানুষটিই।
অ্যাপোলো–১১ মিশনে কমান্ডার নিল আর্মস্ট্রং সহযাত্রী বাজ অলড্রিনের সঙ্গে মিলে চাঁদের বুকে বিশেষ আয়না বসান, যার থেকে প্রতিফলিত আলো ব্যবহার করে চাঁদ ও পৃথিবীর দূরত্ব মাপা হয়। এই আয়না এখনো বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করেন।
সপ্তম মানুষ হিসেবে চাঁদে পা রাখা ডেভ স্কটের হাতঘড়ি ২০১৫ সালে নিলামে ১ দশমিক ৬২৫ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়, যা পরে তিনি চাঁদে হাঁটাহাটি করেছিলেন।
মাত্র তিনজন নভোচারী দুবার করে চাঁদের অভিমুখে যাত্রা করেন।