চলো শিখে ফেলি বাশাআপ

প্রতিকুল পরিস্থিতিতে নিজেকে রক্ষা করতে বাশাআপ শিখে ফেলতে পারো তুমিও।ছবি: খালেদ সরকার

‘ছোটবেলায় জুডো শেখা শুরু করেছিলাম। কিন্তু একদিকে পড়াশোনার চাপ, অন্যদিকে প্রশিক্ষণকেন্দ্রে আনা-নেওয়া কে করবে সেই ঝামেলায় বাধ্য হয়েই বন্ধ করে দিতে হয়েছিল শেখা। কিন্তু বাশাআপ শেখানো হয় আমাদের স্কুলেই, তাও আবার বিনা মূল্যে। ফলে মা-বাবা আর আপত্তি করেননি। তাই এখন শিখছি বাশাআপ।’ শারীরিক আত্মরক্ষামূলক কৌশল বাশাআপ শেখা শুরু করার গল্প এভাবেই শোনায় ঢাকার ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণীর আনিকা ইবনাত। তার সঙ্গে কণ্ঠ মেলায় সহপাঠী তানজুম রহমান, ‘স্কুল-কোচিংয়ে বেশির ভাগ সময়ই একা চলাফেরা করি। কখন কোন বিপদ সামনে আসে বলা তো যায় না। তাই বন্ধুদের দেখাদেখি বাশাআপ শেখা শুরু করেছি আমিও।’

কী এই বাশাআপ? উত্তর মিলল বাশাআপের উদ্ভাবক খালেদ মনসুর চৌধুরীর কাছ থেকে, ‘আমি কারাতেতে ব্ল্যাকবেল্ট পাই ১৬ বছর বয়সে। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া কিছু ছেলেকে প্রশিক্ষণ দিতাম এরপর। নিজস্ব সংস্কৃতির আত্মরক্ষামূলক পদ্ধতি তৈরির কথা মাথায় ছিল তখনই। একদিন ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ছেলে আ ফ ম শফিউল্লাহ ডেকে বললেন, বিদেশি জিনিস আর কত শেখাবেন, দেশি কিছু করেন! কথাটা নতুন করে মনে ধরল। এরপর দীর্ঘদিনের মেধা আর শ্রমের ফল হলো এই বাশাআপ।’

বাশাআপ মূলত শারীরিক এমন এক কৌশল, যেখানে একজন শিক্ষার্থীকে শেখানো হয় কী করে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজেকে রক্ষা করে আক্রমণকারীকে পাল্টা জবাব দিতে হয়। শরীর গঠনের ক্ষেত্রেও দারুণ ভূমিকা রাখে বাশাআপ প্রশিক্ষণ। কারাতে, জুডো, কুংফু, উশু, তায়কোয়ান্দো ইত্যাদি দেশীয় শারীরিক আত্মরক্ষামূলক পদ্ধতি। এগুলোর সংমিশ্রণ ঘটিয়ে ও কিছু নতুন কৌশল যোগ করে বাংলাদেশের সামাজিক অবস্থা, মানুষের শারীরিক অবকাঠামো ও পরিবেশের উপযোগী করে চালু করা হয় ‘বাংলাদেশি শারীরিক আত্মরক্ষামূলক পদ্ধতি’ সংক্ষেপে বাশাআপ।

হোয়াইট, ইয়েলো, অরো, অরেঞ্জ, গ্রিন, ব্লু, ব্রাউন ও ব্ল্যাক—বাশাআপে এই আটটি বেল্ট অর্জনের মাধ্যমে এক ধাপ থেকে আরেক ধাপে উত্তীর্ণ হয় শিক্ষার্থীরা। একেক ধাপে শিক্ষার্থীভেদে সময় লাগে ছয় থেকে নয় মাস। প্রাথমিক পর্যায়ে কয়েক দিন একজন শিক্ষার্থীকে কিছু শারীরিক কসরত শেখানো হয়, যাতে সে বাশাআপের কলাকৌশলগুলো অনুশীলনের জন্য মানসিক ও শারীরিকভাবে প্রস্তুত হতে পারে। একে বলা হয় ‘অকক’। অককের পরের ধাপ ‘হাকোস’ ও ‘পদা’। এতে যথাক্রমে হাত এবং পা চালনার কলাকৌশল শেখানো হয়। এর পরের ধাপের নাম ‘অনক’। একজন ব্যক্তি আঘাত করলে তা প্রতিরোধ করে কীভাবে পাল্টা আঘাত করা যায়, তা শেখানো হয় এ ধাপে।

আত্মরক্ষার পদ্ধতি হিসেবে জুডো আর কারাতেও জনপ্রিয়। চাইলে এগুলোও রপ্ত করতে পারো। যেমনটা করেছে সিদ্ধেশ্বরী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের দয়িতা বিনতে দীন। বাংলাদেশ কারাতে ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘চতুর্থ জাপান কাপ প্রতিযোগিতা’য় অনূর্ধ্ব-৮ গ্রুপে কারাতের কুমি বিভাগে রৌপ্যপদক পেয়েছে দ্বিতীয় শ্রেণীর এই ছাত্রী।

হাত ও পায়ের কৌশল পরিপূর্ণভাবে আয়ত্তে এলে লাঠি, ছুরি বা অন্য কোনো ধারালো বস্তুর আঘাত প্রতিরোধ ও প্রতিকারের কৌশল শেখানো হয় যথাক্রমে ‘ছঅক’ ও ‘লঅক’-এ। এর পরের কৌশলের নাম ‘উডা’। মূলত ফ্লাইং কিকের তালিম দেওয়া হয় এতে। বাশাআপের সর্বশেষ ধাপের নাম ‘প্যাঅক’-এ শেখানো হয় ছিনতাইকারী বা দুষ্কৃতকারীর পেছন থেকে জাপটে ধরা থেকে কীভাবে নিজেকে বাঁচানো যায়।

১৯৭৯ সালে মিরপুরের জান্নাত একাডেমিতে প্রথমবারের মতো চালু হয়েছিল স্কুলভিত্তিক বাশাআপ। বর্তমানে ঢাকার মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়াম, রংপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালী, নড়াইল ও কক্সবাজারের জেলা ক্রীড়া সংস্থা ছাড়াও সারা দেশে মোট ২৫টি বিদ্যালয়ে চালু আছে বাশাআপ। ২০১৩ সালে আয়োজিত বাংলাদেশ গেমসেও ছিল এ ইভেন্ট। এ ছাড়া বাশাআপকে জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যে প্রতিবছর আয়োজিত হয় বার্ষিক বাশাআপ ক্যাম্প।

(কিশোর আলোর মে ২০১৪ সংখ্যায় প্রকাশিত)