বাগান করা যাদের শখ, তারা তো বাগান করছই, আরও যাদের মনে এমন শখটি উঁকিঝুঁকি মারছে, তারাও এবার সেই শখের বাস্তবায়নে নেমে পড়তে পারো। বাসার ছাদে, বারান্দায় কিংবা ঘরের ভেতরেই আনতে পারো সবুজের বসবাস। তো হয়ে যাক শুরু!
কোথায় কেমন গাছ লাগাব
রোদ পায়, এমন খোলা বারান্দায় বা ছাদে লাগাতে পারো বারোমাসি মরিচ, পেঁপে, পেয়ারা, লেবু, আতা, শরিফা, কুল বা বরই, ডালিম, করমচা, কামরাঙা, অড়বরই, ড্রাগন ফল, বিলিম্বি, মেহেদি। লাগাতে পারো বারোমাসিসহ উন্নত জাতের ফলের কলম চারা—আম, কাঁঠাল, আমড়া, কতবেল, জলপাই, জামরুল, মিষ্টি তেঁতুল, বিলেতি গাব, লিচু, সফেদা, আমলকী, জাম্বুরা, চালতা, বেল, ডেউয়া, মাল্টা, কমলা কিংবা তোমার পছন্দসই কোনো ফলের গাছ। যারা আখ খেতে পছন্দ করো, লাগাতে পারো আখও। যেখান থেকেই আখ কেনো, আখের মাথাটাও সঙ্গে করে নিয়ে এসো। এনে বড়সড় কোনো টবের মাটিতে লম্বালম্বিভাবে মানে শুইয়ে পুঁতে দাও। হালকা পানি দাও। দেখবে কদিনের মধ্যেই আখের মাথার প্রতিটি গিঁট থেকেই একটি করে চারা বের হবে। আর একবার আখ হয়ে গেলে সেই আখও যেমন বড় হবে, আখের মূল থেকে নতুন নতুন চারাও গজাবে। ফলে তুমিও তোমার টবের আখ খেতে পারবে বছরের পর বছর ধরে।
খুব কম সময়ের অল্প যত্নেই সহজে ফলানো যায় পুষ্টির ভান্ডার সব রকমের রঙিন সবজি। যেমন ধরো লালশাক, ডাঁটাশাক, কলমি শাক, পাটশাক, ঢ্যাঁড়স, বেগুন, চুকুর, ধনে (শীতকালে), বিলেতি ধনে (বছরজুড়ে), মিষ্টি আলু (গাছের মূলে আলু যেমন মেলে, মেলে গাছের পাতার সবুজ সবজিও)। পৃথক টবে যেমন চাষ করতে পারো, পারো বেড তৈরি করে কিংবা সাথি ফসল হিসেবে আম, জামরুল ইত্যাদি বড় সব ফল গাছের গোড়ায়ও। একই জায়গায় শীত এলে লাগাতে পারো পালংশাক, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ব্রকলি, গাজর, মুলা, টমেটো, লেটুস, পেঁয়াজ। একটু বড় টব বা ড্রামে লাগাতে পারো সবজি হিসেবে খাওয়া কাঁচকলা, শজনে ইত্যাদি।
মাচা করে লাগাতে পারো পুঁইশাক, শিম, বরবটি, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, লাউ, পটোল, ঝিঙা, ধুন্দুল, চিচিঙ্গা, কাঁকরোল, করলা, শসা, ক্ষীরা, তরমুজ, বাঙ্গিসহ লতানো সব রকমের সবজি। শহরে গ্রামের মতো বাঁশবেতের মাচা করার সুযোগ থাকে না। তবে মাচা বানানোর জন্য বাজারে নাইলনের সুতার অথবা তারের নেট বা জাল কিনতে পাওয়া যায়। তা দিয়ে সহজেই মাচা তৈরি সম্ভব। আর ছাদের এক অংশে একবার মজবুত করে মাচা তৈরি করে নিতে পারলে বছরের পর বছর লতানো সবজি তোলা যাবে। ফলের মধ্যে আঙুর, ট্যাং ফল, ব্ল্যাকবেরি, ব্লুবেরি, রাসবেরিও কিন্তু লতানো গাছ, লাগবে ওদের জন্যও মাচার ব্যবস্থা।
ফুলের মধ্যে লাগাতে পারো গোলাপ, জবা, রঙ্গন থেকে শুরু করে তোমার পছন্দসই সব দৃষ্টিনন্দন রঙিন ফুল। সুগন্ধি ফুলের মধ্যে লাগাতে পারো গন্ধরাজ, হাসনাহেনা, বকুল, বর্ষার কামিনী কিংবা শরতের শিউলি—একে তো ফুলে ফুলে ছেয়ে যাবে গাছতলা, তার ওপর চারপাশ করবে সুগন্ধে ম–ম! বারান্দায় যে গ্রিল বা লোহার বেষ্টনী থাকে, তাতে তুলতে পারো লতানো অপরাজিতা, মর্নিং গ্লোরি ও কুঞ্জলতা, অনন্তলতা, মাধবীলতা, বাগানবিলাস। ছাদে বড় টব বা ড্রামে লাগিয়ে ফুল পেতে পারো কদম, সোনালু, পলাশ কিংবা কৃষ্ণচূড়াও।
সিমেন্টের গোলাকার চারি, চৌবাচ্চা, হাফড্রাম বা স্রেফ বড় বোল বা বালতিতে লাগাতে পারো জলজ ফুল শাপলা, পদ্ম, মাখনা, চাঁদমালা, সোর্ড লিলি, জলগোলাপ। লাগাতে পারো সবুজ পয়সা পাতা, দেশি ও থাই টোপাপানা, কচুরিপানাও। এসব জলজ উদ্ভিদও মেলে এখন নার্সারিতে। খোঁজ নিয়ো। তবে পানি মানেই ‘ডেঙ্গু মশার ভয়’ আর নয়, আছে সমাধান। পানিতে ছেড়ে দেবে গাপ্পি মাছ। ওরাই মশার ডিম খেয়ে ঠেকাবে মশার বংশবিস্তার। খুব অল্প দামে গাপ্পি মাছ পেয়ে যাবে অ্যাকুয়ারিয়ামের দোকানে।
এখন যদি বলো, যেখানে তেমন রোদ পড়ে না, সেখানে কী উপায়? হ্যাঁ, তোমাদের কারও বাসার অবস্থান যদি হয় এমন—আশপাশে ঘিরে থাকা উঁচু ভবন ঠেলে রোদ আসতে পারে না ছাদে কিংবা বারান্দায়—সেই ছায়াযুক্ত স্থানেও কিছু কিছু আবাদ সম্ভব। কলমি শাক, ডাঁটাশাক, কচুশাক, মিষ্টি আলু, আদা, হলুদ, তুলসী, বাসক। ফলের মধ্যে দেশি ফল তুঁত ফল, আনারস, লটকনও লাগানো যায় ছায়াযুক্ত স্থানে। আবার ছায়াযুক্ত স্থানেই বছরজুড়ে ফুল পেতে পারো সন্ধ্যামালতী, নয়নতারা, পানিকা, অপরাজিতা। বর্ষার ফুল দোলনচাঁপা, এমারলিস লিলি, স্পাইডার লিলি—এরাও ফুল দেয় ছায়াতে। ফলে রোদ না এলেও বাগান করা আটকে থাকবে না তাতে।
কিন্তু যদি বারান্দা না থাকে, আবার ছাদে যাওয়ার সুযোগও না মেলে, সে ক্ষেত্রে সবুজের ছোঁয়া আনতে পারো ঘরের ভেতরেই। ঘরে সূয্যিমামার উঁকিঝুঁকি নেই বলে চাইলেও সব রকমের গাছ এনে হাজির করতে পারি না। ছায়ায় টিকে থাকে, এমন সব পাতাবাহার গাছই ঘরের ভেতরের শোভা বাড়ায়। এ ধরনের কিছু গাছের মধ্যে রয়েছে মানিপ্ল্যান্ট, লাকি ব্যাম্বো, অ্যারেকা পাম, ড্রাসিনা, ডাম্ব কেইন, স্নেক প্ল্যান্ট, স্পাইডার প্ল্যান্ট, পিকক প্ল্যান্ট, ব্রমিলিয়াড, চায়নিজ এভারগ্রিন, ইংলিশ আইভি লতা, বোস্টন ফার্ন, হার্টলিফ ফিলোডেনড্রন, পিস লিলি, পেপেরোমিয়া, অ্যান্থুরিয়াম ইত্যাদি। এ ছাড়া নানা রকম ক্যাকটাস আর বনসাইও রাখতে পারো ঘরে। পিস লিলি আর ক্যাকটাস ফুল দিতে পারে ঘরের ভেতরেও।
উপযুক্ত চারা নির্বাচন
নার্সারিতে অনেক গাছের ভিড়ে বেছে নিতে হবে ভালো জাতের সুস্থ–সবল চারা। চারা হবে রোগমুক্ত, সোজা, কাণ্ড কিছুটা মোটা আর শাখা–প্রশাখাবিশিষ্ট। ছাদে বা বারান্দায় লাগানোর জন্য ভালো জাতের ঝোপালো কলমচারা রোপণ করাই ভালো।
রোপণ পদ্ধতি ও যত্নআত্তি
নার্সারি থেকে চারা এনে অন্তত এক দিন ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে পারলে ভালো। এতে নার্সারি থেকে স্থানান্তরের ফলে চারার মরে যাওয়ার ঝুঁকি কম থাকে।
টব বা ড্রামের নিচে ছিদ্র থাকা আবশ্যক। না থাকলে ছিদ্র করে নিতে হবে। না হলে পানি জমে গাছের গোড়ায় পচন ধরে গাছ মারা যেতে পারে।
এবার টবের ছিদ্রটি ভাঙা ইটের টুকরা দিয়ে ঢেকে জৈব সার মিশ্রিত মাটি দিয়ে টব পূর্ণ করে চারা লাগাতে হবে ও পানি দিতে হবে। এখন মাটি থেকে শুরু করে প্যাকেটজাত জৈব সার সবই কিনতে পাওয়া যায়।
গাছে পানি দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে সব গাছের পানি শোষণক্ষমতা এক নয়। তাই প্রতিদিনই সব গাছে সমানতালে পানি দেওয়ার প্রয়োজন নেই। একবার পানি দেওয়ার পর টবের মাটি শুকিয়ে এলে তবেই পানি দিতে হবে। গাছে পানি দিতে হয় সকালে বা বিকেলে। দুপুরের তপ্ত রোদে নয়।
বাসায় ভাত রান্না করতে গেলে চাল ধুতে হয় আর ডাল রান্না হলে ডাল। এই চাল ধোয়া, ডাল ধোয়া পানি সংরক্ষণ করে টবের মাটিতে দিতে পারো, সারের মতো কাজ করবে।
তরকারির জন্য যে সবজি কাটা হয় রোজ, সেই কাটা সবজির উচ্ছিষ্ট অংশ একটা বদ্ধ পাত্রে সংরক্ষণ করো এবং পানি যোগ করে পাত্রের মুখ বন্ধ করে দাও। প্রতিদিন সবজির উচ্ছিষ্ট অংশ যোগ করতে পারো আর কাঠি দিয়ে নেড়ে দিতে পারো। কয়েক দিনের মধ্যে সবজি পচে পানির রং ঘোলাটে হয়ে তৈরি হবে তোমার বানানো ‘হোম মেড’ তরল জৈব সার। সেই তরল জৈব সার দিতে পারো সব গাছের টবে। ফলে বাড়তি সার কেনার হাত থেকে বেঁচে যাবে তুমি।
মানিপ্ল্যান্ট, লাকি ব্যাম্বো, ডাম্ব কেইন, স্নেক প্ল্যান্ট যেমন মাটিতে লাগানো যায়, যায় স্রেফ পানিতেও। কাচের জার বা পানির বোতলেও দিব্যি বেঁচে থাকে ঘরের ভেতর। পানিতে নুড়িপাথর বা ছোট ছোট ইটের টুকরা দেওয়া যায়। ফলে গাছগুলো শিকড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। পানি কমে এলে বাড়তি পানি যোগ করতে হবে। পানি ঘোলাটে হয়ে এলে পুরো পানি পরিবর্তন করে দিতে হবে।