
রবার্ট লুই স্টিভেনসনের বিখ্যাত অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস ট্রেজার আইল্যান্ড। আর সবার মতো উইলিয়াম হেনরি ডোভেটন হ্যাগার্ডেরও খুব প্রিয় ছিল সাড়া জাগানো এই বইটা। কিন্তু তাঁর ছোট ভাই বইটা পড়ে ভাবছিলেন, এর চেয়ে ভালো রহস্য-রোমাঞ্চ-অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস তো তিনিই লিখতে পারবেন। সাহস করে বলেও ফেললেন বড় ভাইকে। প্রিয় লেখক আর প্রিয় বই নিয়ে এ রকম মন্তব্য কে-বা পারে সহ্য করতে! চ্যালেঞ্জ করলেন উইলিয়াম। ‘পারলে এমন একটা বই লিখে দেখা। যদি তো তোকে আমি...’। ছোট ভাইও কম যান না। বাজিতে রাজি। বসে পড়লেন কাগজ-কলম নিয়ে।
টানা ছয় সপ্তাহ ধরে যেটা লিখলেন পরবর্তীতে সেটা হয়ে গেল পৃথিবীর সর্বাধিক বিক্রীত অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাসের একটা। কিং সলোমনস মাইন, বাংলা করলে দাঁড়ায় রাজা সলোমনের গুপ্তধন। বাজিতে তো জিতলেনই সেই সঙ্গে অন্য এক রহস্য-রোমাঞ্চ আর অ্যাডভেঞ্চার পেয়ে বসল ছোট ভাইকে। লেখার অ্যাডভেঞ্চার। একের পর এক লিখে গেলেন দুনিয়া কাঁপানো সব অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস। কোনোটা কোনোটার থেকে কম না। শি, রিটার্ন অব শি। এর মধ্যে শি উপন্যাসটি ছিল ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে বেশিবার ছাপা ও বিক্রি হওয়া বই। বিক্রি হয়েছিল ৮৩ মিলিয়ন কপি, মানে প্রায় ৮ কোটি ৩০ লাখ কপি! এখনো বিক্রি হচ্ছে। আর সেই ছোট ভাই এখনো সমান জনপ্রিয় পুরো পৃথিবীতে। নামটা নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছ—হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড। আঠারো শ শতকে জন্ম নেওয়া এক অসাধারণ রহস্য রোমাঞ্চ আর অ্যাডভেঞ্চার লেখক স্যার হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডকে বলা হয় হারানো পৃথিবীর লেখক। তার অধিকাংশ উপন্যাসের পটভূমি প্রাচীন আফ্রিকা। আফ্রিকার বিভিন্ন দুর্গম এলাকা আর রহস্যময় উপজাতিদের নিয়ে অসংখ্য রহস্যোপন্যাস লিখেছেন তিনি। একসময় ব্রিটিশ কলোনি ছিল আফ্রিকা। ১৮৭৫ থেকে ১৮৮২ সাল পর্যন্ত আফ্রিকাতেই কর্মরত ছিলেন ইংল্যান্ডে জন্ম নেওয়া হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড।

স্যার হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড জন্মেছিলেন ইংল্যান্ডের নরফোকের পশ্চিম ব্রাডেনহামের উডফার্ম-এ, ১৮৫৬ সালের ২২ জুন। কবি মা আর আইনজীবী বাবার দশ ছেলেমেয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন অষ্টম। বাবা উইলিয়াম মেইবম হ্যাগার্ড আর্থিকভাবে সচ্ছল ছিলেন না। ফলে খুব বেশি পড়াশোনা করা হয়নি তাঁর। তবে কিছুদূর পড়েছিলেন আইন বিষয়ে। বাবা চাইতেন তিনি চাকরি করবেন। তাই ১৯৭৫ সালে ১৯ বছর বয়সে আফ্রিকার নাটালে চলে যান হ্যাগার্ড। সেখানে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য রক্ষায় নিয়োজিত সরকারি অফিসে ছোট্ট একটা চাকরি করতেন তিনি। চাকরির সুবাদেই ঘুরে বেড়িয়েছেন আফ্রিকার বিভিন্ন জায়গায়, মিশেছেন জুলু উপজাতি থেকে শুরু করে অনেকের সঙ্গে, সেখানে ছিলেন ১৮৮২ সাল পর্যন্ত। যা পরবর্তী জীবনে তাঁর উপন্যাসের রসদ জুগিয়েছে।

কিং সলোমনস মাইন বই দিয়েই যাত্রা শুরু হ্যাগার্ডের। উপন্যাসের নায়ক বয়স্ক পরিব্রাজক অ্যালান কোয়াটারমেইন। যিনি আফ্রিকা শুধু যে ভালোবাসতেন তা নয়, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন সেখানেই। সাদা চামড়ার এই পর্যটককে আপন করে নিয়েছিল আফ্রিকাও। কোয়াটারমেইনের অভিযানগুলোর রহস্য রোমাঞ্চের অসাধারণ স্বাদ পাবে তুমিও। আসলে হ্যাগার্ডের লেখার বর্ণনা এতটাই জীবন্ত যে পড়তে পড়তে মনে হবে, তুমিও বুঝি বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছো আফ্রিকায়। চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে বর্শা হাতে দুর্ধর্ষ মাটাবেলি উপজাতির কোনো যোদ্ধা। কিংবা বনজঙ্গল কাঁপিয়ে চলে যাচ্ছে শত শত হাতি।

কোয়াটারমেইনকে নিয়ে অনেক উপন্যাস লিখেছেন হ্যাগার্ড। চরিত্রটি এতই জনপ্রিয় ছিল যে, মেরে ফেলার পর তাকে পুনর্জীবিত করতে বাধ্য হয়েছিলেন হ্যাগার্ড। অ্যালান কোয়াটারমেইন বইয়ের শেষ দিকে তাকে মেরে ফেলা হয়। কিন্তু বইটি প্রকাশিত হওয়ার পরপরই চারদিক থেকে এত এত অনুরোধ আর চাপ আসতে থাকে যে শেষ পর্যন্ত অ্যালানকে বাঁচিয়ে রাখতে হয় লেখককে।
তত দিনে অবশ্য হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের কল্পনার খনি থেকে বেরোতে শুরু করেছে একের পর এক ‘গুপ্তধন’। স্টেলা, মুন অব ইসরায়েল, দ্য আইভরি চাইল্ড, হার্ট অব দ্য ওয়ার্ল্ড, হিউ-হিউ অর দ্য মনস্টারসহ অসংখ্য উপন্যাস। হ্যাগার্ডও পেয়েছেন অন্য রকম গুপ্তধনের সন্ধান। তিনি দেখলেন চাকরি করে যে টাকা আয় হয়, তার চেয়ে বেশি আয় হয় উপন্যাস লিখে। প্রথম উপন্যাসের রয়্যালটি নিয়েও একটি মজার ঘটনা আছে। প্রকাশক চেয়েছিলেন তখনকার বাজারদরে ১০০ ডলারের বিনিময়ে উপন্যাসের স্বত্ব বিক্রি করে দেবেন। কিন্তু নিজের সৃষ্টির প্রতি হ্যাগার্ডের বিশ্বাস ছিল দারুণ। সেটাতে রাজি না হয়ে তিনি চুক্তি করলেন আজীবন রয়্যালটির। পরবর্তী সময়ে তাঁর সিদ্ধান্তই সঠিক প্রমাণিত হয়। শুধু লিখেই তিনি বেশ আরাম-আয়েশে সংসার চালিয়েছেন। বেশ সম্পত্তির মালিকও হয়েছিলেন।

মোট ৫৬টি উপন্যাস লিখেছেন হ্যাগার্ড। লেখার সমগ্র আছে ৩টি। নন ফিকশন লিখেছেন ১০টি। বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয়স্বজনকে লেখা তাঁর চিঠি পাওয়া গেছে ৯৮টি। মৃত্যুর ঠিক পরের বছরে দুই খণ্ডে ছাপা হয় তাঁর জীবনী।
হ্যাগার্ডের উপন্যাসগুলো পড়তে শুরু করলেই চলে যাওয়া যায় হারানো পৃথিবীর আফ্রিকায়। তোমরাও তৈরি হয়ে যাও, নেমে পড়ো অসাধারণ কিছু অভিযানে। আফ্রিকার পাহাড়ে, বনে-জঙ্গলে, ঘুরে এসো অ্যালান কোয়াটারমেইনের সঙ্গে। পড়তে পড়তে তুমিও সন্ধান পাবে এক অন্য রকম গুপ্তধনের! সেবা প্রকাশনী থেকে হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের অনেক অনুবাদ বেরিয়েছে। সেবার অনুবাদ মানেই সাবলীল ও প্রাঞ্জল অনুবাদ। পড়তে পড়তে মনে হবে লেখক হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড বুঝি বাংলাতেই লিখেছিলেন উপন্যাসগুলো।

উনিশ শতকের দিকে অ্যাডভেঞ্চার গল্প বলার রেনেসাঁয় হ্যাগার্ড ছিলেন অগ্রণী। তাঁর রহস্য আর অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ ছড়িয়ে পড়ে সারা পৃথিবীতে। ১৯২৫ সালের ১৪ মে ইংল্যান্ডের একটি নার্সিং হোমে মারা যান এই মহান লেখক। তবে এখনো পাঠক তাঁর উপন্যাস পড়ে হারিয়ে যায় এক-দেড় শ বছর আগের আফ্রিকার গহিন জঙ্গলে, মৃত্যুর হাতছানি দেওয়া আফ্রিকার মরুভূমিকে কিংবা ভয়ংকর খরস্রোতা আফ্রিকান নদীতে। মুখোমুখি হয় মাটাবেলি, জুলু উপজাতির। শুধু লেখকের কাল্পনিক ঘটনার জীবন্ত বর্ণনার কারণে। এই ক্ষমতা সব লেখকের থাকে না। হ্যাগার্ডের ছিল, অসাধারণভাবে ছিল।