ব–হু কাল আগের কথা। কতকাল আগে? তা পাঁচ হাজার বছর তো হবেই। পৃথিবীর মানুষ তখন সভ্য হয়ে উঠতে শুরু করেছে। বর্তমান ইরাকের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকের সুমের এলাকার মানুষ গড়েছিল সেই সভ্যতা। গড়েছিল নতুন নতুন শহর আর কত্ত বড় সব দালানকোঠা! তো, অমন একটা শহরের নাম ছিল উরুক। প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে সেখানে রাজত্ব করতেন এক রাজা। নাম তাঁর গিলগামেশ। অবশ্য কেউ কেউ বিলগামেশও বলেন তাঁকে। সেই রাজাকে নিয়েই গল্পটা। গল্পটা সৃষ্টি হওয়ার পর বহুকাল পর্যন্ত তা মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত ছিল। প্রায় চার হাজার বছর আগে তা প্রথম লেখা হয়েছিল। এরপর বিভিন্ন সময়ে আবারও লেখা হয়েছে। সম্রাট আসুরবানিপালের লাইব্রেরি আবিষ্কারের পর আধুনিক পৃথিবীর মানুষ জানতে পারে এই গল্পের কথা।
১১টা কাদামাটির চৌকোর ওপরে কিউনিফর্ম লিপিতে আক্কাদীয় ভাষায় লেখা পাঁচটি কবিতায় এই কাহিনি প্রথমে পাওয়া গেছে। তাতে ছিল তিন হাজার চরণ। প্রাচীন এলামীয়, হিট্টাইট ও হুরিয়ান ভাষায়ও এই কাহিনির সন্ধান মিলেছে। পণ্ডিতেরা মত দিয়েছেন, এটাই হলো মানুষের লেখা প্রাচীনতম সাহিত্য-নিদর্শন। গিলগামেশের মহাকাব্য নামে এটি বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করেছে। মেসোপটেমীয়, মিসরীয়, গ্রিক ও রোমান পুরাণেরও অনেক আগে সৃষ্টি হয়েছিল এই পুরাণ–কাহিনি । সেই বিশ্বখ্যাত কাহিনিই শুনব আমরা এখন।
রাজা গিলগামেশের বাবা ছিলেন মানুষ, আর মা ছিলেন দেবী। ফলে তিনি পুরোপুরি দেবতা ছিলেন না। আবার পুরোপুরি মানুষও ছিলেন না। তিনি ছিলেন দুই ভাগ দেবতা ও এক ভাগ মানুষ। কেউ কেউ তাঁকে উপদেবতাও বলেছেন। এই রাজা ছিলেন খুব শক্তিধর, কিন্তু খামখেয়ালি। যা করাতে চাইতেন, প্রজাদের দিয়ে তা করিয়েই নিতেন। তাদের কষ্ট হলেও সেদিকে খেয়াল করতেন না। দেবতারা রাজাকে সাজা দেওয়ার জন্য ভয়ংকর এক জঙ্গলমানব এনকিডুকে পাঠালেন।
এনকিডুর বিশেষ এক বৈশিষ্ট্য ছিল। সে দেখতে মানুষের মতো হলেও মানুষের সমাজে বেড়ে ওঠেনি। গহিন অরণ্যে বুনো জানোয়ারদের সঙ্গে সে বেড়ে উঠেছিল। বুনো পশুদের সঙ্গেই ছিল তার চলাফেরা। পশুর মতোই বড় বড় লোমে ঢাকা ছিল পুরো শরীর। মাথায় ছিল পশুর মতো দুটি শিং। গায়েও তার ছিল প্রচণ্ড শক্তি। মানুষের সমাজের নিয়মকানুনের ধার সে ধারত না। দেবতার ইচ্ছায় সে গিলগামেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য হাজির হলো শহরে। তার দুঃসাহস দেখে রাজা ভীষণ রেগে গেলেন। তারপর দুজনের মধ্যে কঠিন যুদ্ধ হলো। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই বোঝা গেল, কেহ কারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান। রাজাও বুঝলেন ব্যাপারটা। এনকিডুরও তা বুঝতে বাকি রইল না। তখন দুজনেই হাত মেলালেন। শত্রু থেকে পরিণত হলেন বন্ধুতে। দেবমাতা নিনসন তাঁকে দ্বিতীয় পুত্র হিসেবে গ্রহণ করলেন।
গিলগামেশ আর এনকিডু মিলে দুনিয়ার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত কত অভিযানই যে চালালেন! একতাবদ্ধ হয়ে কত কাজে যে সফল হলেন তাঁরা। তবে এত সব অভিযানের মধ্যে একটা অভিযানের কথা ভোলা যায় না কখনোই। সে হলো সিডর বনে অভিযান। সেটা ছিল ভয়ংকর এক বন। যেমন গহিন, তেমনি বিপজ্জনক। তবে সেখানকার সবচেয়ে বড় বিপদ ছিলেন হুম্বাবা!
কে ছিলেন এই হুম্বাবা? তিনি এক ভয়ংকর অপদেবতা। জঙ্গলের দানব হিসেবেও জানত অনেকেই তাঁকে। তাঁর মুখটা ছিল সিংহের। গায়ে ছিল বড় বড় আঁশ। আর লেজটা ছিল সাপের মতো। তাঁর হুংকারে প্লাবনের সৃষ্টি হতো। কথা বলার সময় আগুনের হল্কা বের হতো। নিশ্বাস বয়ে আনত মৃত্যু। গহিন অরণ্যের মধ্যেও সে ৬০ লিগ দূরের আওয়াজ পর্যন্ত শুনতে পেত। কোনো মানুষের সাধ্যই ছিল না ওই বনে ঢোকার এবং হুম্বাবার কিছু করার। কিন্তু দুঃসাহসী গিলগামেশ এনকিডুকে সঙ্গে নিয়ে ঢুকলেন ওই বনে। বনপথে এগোনোর সময় হঠাৎ দেখা হয়ে গেল স্বয়ং হুম্বাবার! তখন যে কী অবস্থার সৃষ্টি হলো, তা আর বলব কী! পৃথিবী কেঁপে উঠল। আকাশ ছেয়ে গেল আঁধারে। আর দশটা মানুষ হলে তো হুম্বাবাকে দেখামাত্র ভয়েই অক্কা পেত। কিন্তু ভয় কাকে বলে, তা জানা ছিল না মহাবীর গিলগামেশের। সূর্যদেবতা শামাসের আশীর্বাদ ছিল তাঁর ওপর। সেই আশীর্বাদে ভর করে তিনি অস্ত্র ছুড়ে মারলেন। সামাশের আশীর্বাদে সেই অস্ত্রে ঘায়েল হয়ে হুম্বাবার ধড় থেকে আলাদা হয়ে মাথা লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। বিজয়ী গিলগামেশ আর এনকিডু বনের কাঠ দিয়ে বানানো ভেলায় চড়ে ফিরে চললেন প্রাসাদের দিকে। বিজয়চিহ্ন হিসেবে সঙ্গে নিলেন হুম্বাবার কাটা মাথা।
ঠিকঠাকমতো প্রাসাদে পৌঁছালেনও। আর তখনই স্বর্গের দেবী ইশতার আকাশ থেকে নেমে এলেন তাঁদের সামনে। হুম্বাবাকে হত্যা করায় গিলগামেশের বীরত্বের কথা ছড়িয়ে পড়েছিল ততক্ষণে। ইশতারেরও জানা ছিল সে কথা। তবে দেবী যে বন্ধুত্বের কথা বললেন, তাতে গিলগামেশ রাজি হলেন না। দেবী তখন রেগেই আগুন। গিলগামেশকে হত্যা করার জন্য তিনি স্বর্গের ষাঁড় নিয়ে এলেন। তবে তাঁকে হত্যার আগেই এনকিডুর সাহায্য নিয়ে গিলগামেশ হত্যা করে ফেললেন ষাঁড়টিকে। দেবীকেও আঘাত করে বসলেন এনকিডু। এনকিডুর আর বাঁচার উপায় রইল না। ইশতারের ক্রোধে জীবন দিতে হলো তাঁকে।
বন্ধুকে হারিয়ে গিলগামেশ শোকে পাগলপ্রায় হয়ে উঠলেন। তিনি এই মৃত্যুকে মেনে নিতে পারলেন না কিছুতেই। ভাবলেন, তাঁকেও কি তাহলে মরতে হবে? তখন মৃত্যুকে পরাজিত করার ইচ্ছা প্রবল হয়ে উঠল তাঁর মনে। কী করে মৃত্যুকে পরাজিত করা যায়, তার উপায় তিনি খুঁজতে শুরু করলেন। আর খুঁজতে খুঁজতে তিনি অতিক্রম করলেন বহু সাগর-মহাসাগর-পর্বতমালা। সে-ও ছিল মহা দুঃসাহসিক অভিযান।
যেতে যেতে জোড়া পাহাড়ের কাছে একটা ফটকের সামনে গিয়ে থামলেন তিনি। ফটকটা খুবই সুরক্ষিত। তার সামনে পাহারা দিচ্ছে ভয়ংকরদর্শন জীবেরা। তাদের শরীরের অর্ধেকটা মানুষের মতো হলেও বাকিটা ড্রাগনের। কোনো মানুষ সেই ফটক গলে ঢুকতে পারে না। কিন্তু গিলগামেশ যেহেতু দুই ভাগ দেবতা ও এক ভাগ মানুষ, তাই শেষ পর্যন্ত তিনি ভেতরে ঢুকতে পারলেন। তবে ঢুকতেই মহা অন্ধকারে ডুবে গেলেন তিনি। বহু কষ্টে পথ হাতড়ে একটা সুড়ঙ্গের সন্ধান পেলেন। সেই সুড়ঙ্গ পেরিয়ে আলোর দেখা পেলেন। কিন্তু আলোয় এসে দেখলেন, সামনে মহাসমুদ্র। কূলকিনারা নেই সেই সাগরের। কোনো মানুষ পার হতে পারে না সেই সমুদ্র। শুধু সূর্যদেবতা শামাস আকাশপথে আলোর রথে চড়ে পাড়ি দেন সেই সমুদ্র।
গিলগামেশ পড়লেন মহাচিন্তায়। কী করে যে সাগরপাড়ি দেবেন! এমন সময় সেখানে আবির্ভূত হলেন দেবী সিদুরি সাবিতু। তিনি গিলগামেশকে ফিরে যেতে বললেন। বললেন, ‘জন্মালে মরতে হবেই। তাই এত কষ্ট করে লাভ নেই। অমর হওয়ার চেষ্টা বৃথাই।’
কিন্তু গিলগামেশ নাছোড়বান্দা। সাগর তিনি পাড়ি দেবেনই। শেষমেশ দেবীর কৃপা হলো। তিনি উরশানবি নামের এক সাগরমাঝিকে ডেকে আনলেন। এইবারে মাঝি তাঁকে নিয়ে গেল পৃথিবীর অন্য প্রান্তের দ্বীপ ডিলমুনে। সেখানে উথনাপিশতিম ও তাঁর স্ত্রী বাস করতেন। গিলগামেশ তাঁদের কাছে গেলেন।
গিলগামেশ দেখলেন, তাঁরাও দেখতে সাধারণ মানুষের মতোই। তাঁর মনে প্রশ্ন আসায় তিনি তাঁদের কাছে এর রহস্য জানতে চাইলেন। উথনাপিশতিম জানালেন যে প্লাবনে রক্ষা পাওয়ার পর দেবতা এনলিলের আশীর্বাদে তাঁরা দেবতাদের মতোই অনন্ত জীবন লাভ করেছেন।
গিলগামেশের অমরত্বের আকাঙ্ক্ষার কথা শুনে তিনি জানালেন, সে বড় কঠিন কাজ। তারপর তাঁকে ছয় দিন সাত রাত না ঘুমিয়ে থাকতে বললেন। কিন্তু দীর্ঘ পথযাত্রায় গিলগামেশ খুব ক্লান্ত ছিলেন। তিনি জেগে থাকতে পারলেন না। তাই ঘুমিয়ে পড়লেন। তা দেখে উথনাপিশতিম অসন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে দেশে চলে যেতে বললেন। কিন্তু গিলগামেশ ছিলেন নাছোড়বান্দা। তিনি বারবার অনুরোধ করায় তাঁকে একটি কঠিন কাজ করার আদেশ দিয়ে উথনাপিশতিম জানালেন যে এতে ব্যর্থ হলে তাঁকে ফিরে যেতেই হবে উরুকে।
কাজটা ছিল গভীর সমুদ্র থেকে একটা উদ্ভিদ নিয়ে আসা। তিনি দুঃসাহসিক অভিযান চালিয়ে সাগরতল থেকে শিকড়সমেত উদ্ভিদটা সংগ্রহ করে আনলেন। কিন্তু সাগর থেকে উঠে যেই–না সেটাকে একটা হ্রদের তীরে রেখে জলে নামলেন, অমনি একটা বুড়ো সাপ কবজা করল সেটাকে। আর তিনি খুঁজে পেলেন না সেটা। ফলে অমর হওয়ার ঔষধি হাতে পেয়েও শেষ পর্যন্ত তা নিজের কাছে রাখতে পারলেন না। তাই এই কাজেও তিনি ব্যর্থ বলেই গণ্য হলেন৷ পরিণতিতে যা হওয়ার তা-ই হলো। তাঁকে শূন্য হাতে ফিরে আসতে হলো উরুকে। এই যাত্রায় কিছুই পেলেন না তিনি। উরুক শহরে ফিরে এসে তিনি আবার রাজত্ব করতে শুরু করলেন।
মরণজয়ের কঠিন অভিযানে তিনি ব্যর্থ হলেন। এবারে মরণশীল মানুষ হিসেবে নিজের শেষ পরিণতিকে তিনি মেনে নিলেন। তবে পুরো ঘটনা থেকে তিনি শিক্ষা নিলেন। প্রজাদের ওপর অত্যাচার বন্ধ করলেন। ইচ্ছেমতো যখন যা খুশি তা করাও বন্ধ করলেন। তিনি পরিণত হলেন প্রজাপালনকারী ভালো রাজায়। দেবতাদের মতো অমর তিনি হতে পারলেন না। নশ্বর মানুষ হয়েই রইলেন। মানুষের যেসব সীমাবদ্ধতা আছে, তা তিনি স্বীকার করে নিলেন।
গিলগামেশের গল্পের শিক্ষা: একতাবদ্ধ হয়ে অনেক বড় কাজ করা যায়। নিজের করা ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হয়। মানুষকে একসময় মৃত্যুবরণ করতে হয়। জীবনে অনেক সীমাবদ্ধতা থাকে। এর পরও হতাশ না হয়ে ভালো কাজ করে যেতে হয়।