২০২০ সালের গোড়াতেই করোনা আটকে দিয়েছিল পুরো পৃথিবীকে। এরপর পেরিয়ে গেছে প্রায় দুই বছর। নতুন পরিস্থিতি মেনে নিয়ে সবকিছুই ধীরে ধীরে ফিরছে পুরোনো ছন্দে। সবকিছুর মতো শহরে আবার ফিরেছে সাইক্লিং।
দেশের সবচেয়ে বড় সাইক্লিং সংগঠন ‘বিডিসাইক্লিস্টস’ও ফিরেছে। তাদের ফিরে আসাটা হয়েছে বেশ বড় করেই। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের নাম তো নিশ্চয়ই শুনেছ। ডিসেম্বর মাসে সেই গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস গড়ার প্রচেষ্টা করেছে বিডিসাইক্লিস্টের পেশাদার সাইক্লিং দল ‘টিম বিডিসি’। এই ডিসেম্বরেই আবারও ফিরেছে দেশের সবচেয়ে বড় সাইকেল রাইড ‘বিজয় রাইড’। কী নিয়ে ছিল গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস অ্যাটেম্প, কতটুকু সম্ভব হলো রেকর্ড তৈরি করা, কেমন গেল বিজয় রাইড—সবকিছুর গল্পই থাকছে আজ।
১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস প্রচেষ্টা
সাইকেল চালিয়ে ৪৮ ঘণ্টায় ১ হাজার ৫০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে হবে। চারজন সাইক্লিস্ট রিলে করে চালাবে সাইকেল। তবেই সেটা হবে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস। এমন লক্ষ্য সামনে নিয়েই রেকর্ড গড়ার উদ্যোগ নিয়েছিল টিম বিডিসি। এই রেকর্ড গড়ার আইডিয়া টিম বিডিসির মাথায় এসেছিল বেশ কিছুদিন আগেই। তবে এত লম্বা করোনাকাল পিছিয়ে দিয়েছিল সব। ২০২১ সালের মার্চে আশার আলো দেখা গেলেও করোনার নতুন ঢেউ আর এগোতে দেয়নি। তবে তাই বলে প্রস্তুতি কিন্তু আটকে ছিল না। এত বড় রেকর্ড গড়তে প্রয়োজন বিশাল প্রস্তুতি, আয়োজন ও পৃষ্ঠপোষক। করোনাকালে চলেছে প্রস্তুতি। পাওয়া গেছে পৃষ্ঠপোষক। বিজয়ের মাস আসতে আসতে অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে যায় করোনা পরিস্থিতি। বিজয়ের মাসে রেকর্ড গড়ার সিদ্ধান্ত নেয় টিম বিডিসি। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে সামনে রেখে লক্ষ্য দাঁড়ায় ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটারে।
রাজধানীর পূর্বাচলে জয়নুল আবেদীন চত্বরে ৮ ডিসেম্বর, বুধবার রাত ৮টা ৩৮ মিনিটে ঘন কুয়াশার মাঝে শুরু হয় ১৬০০ কিলোমিটার রাইড। রাইডের শুরুটা হয় টিম বিডিসির দ্রাবিড় আলমের পেডালে। চারজনের দলে বাকি তিনজন হলেন রাকিবুল ইসলাম, তানভীর আহমেদ ও মো. আলাউদ্দিন। প্রত্যেকেই টিম বিডিসির সাইক্লিস্ট। পরিকল্পনা অনুযায়ী একজনের পর একজন চালাতে থাকেন সাইকেল।
ডাবরের পৃষ্ঠপোষকতায় রেকর্ড গড়ার সময় পূর্বাচলে জয়নুল আবেদীন চত্বর ঘিরে সব ব্যবস্থাই করে নিয়েছিল টিম বিডিসির স্বেচ্ছাসেবকেরা। রেকর্ড গড়তে চারজন মিলে সাইকেল চালালেও তাঁদের সঙ্গে ছিল বড়সড় একটা দল। বিচারক, স্বেচ্ছাসেবক ও পেসারদের দলটা ছিল বেশ বড়। বিচারকদের কাজ ছিল পুরো রেকর্ডটি সঠিকভাবে হচ্ছে কি না, সেটা পর্যবেক্ষণ করা। পুরো আয়োজনের সবকিছুই করেছেন স্বেচ্ছাসেবকেরা। তাঁরাই ছিলেন এ রাইডের প্রাণ। আর সাইক্লিস্টদের গতি ধরে রাখতে পুরোটা সময় সাইক্লিস্টদের সঙ্গে লেগে ছিলেন পেসাররা।
অস্বাভাবিক শীত ও বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে টানা দুই দিন সাইকেল চালিয়েছেন সাইক্লিস্টরা। ১০ ডিসেম্বর, শুক্রবার ঠিক রাত ৮টা ৩৮ মিনিটে শেষ হয় রাইড। মজার ব্যাপার হলো ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটারের লক্ষ্যে সাইকেল চালালেও ৪৮ ঘণ্টায় ১ হাজার ৬৬৫ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়েছেন এই চার সাইক্লিং হিরো। পূর্বাচলের ১ দশমিক ৭ কিলোমিটার রাস্তার জয়নুল আবেদীন চত্বরটি দুই দিনে প্রায় ১ হাজার ৩ বার চক্কর দিয়েছেন তাঁরা। দুই দিনে গড়ে ৩৪.৬৮ কিলোমিটার/ঘণ্টা গতিতে সাইকেল চালিয়ে সফলভাবে বিশ্ব রেকর্ড গড়ার প্রচেষ্টা শেষ করে টিম বিডিসি।
বিশ্ব রেকর্ডের জন্য ভিডিও ফুটেজ, রাস্তার জরিপ প্রতিবেদন, অনেক হিসাব-নিকাশ, বিচারকদের প্রতিবেদনসহ আরও বেশ কিছু নথিপত্র জমা দিতে হয়। সেসব গুছিয়ে ইতিমধ্যেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে গিনেস কর্তৃপক্ষের কাছে। এখন শুধু স্বীকৃতির অপেক্ষা। আশা করা যায়, খুব শিগগিরই গিনেসের এই রেকর্ডের পাশে বসবে বাংলাদেশের নাম।
সর্বশেষ: প্রায় এক মাস পর মিলেছে বিশ্ব রেকর্ডের স্বীকৃতি। দেরির কারণ জানতে চাইলে ১৬০০ কিলোমিটার রাইডের রাইডার দ্রাবিড় বললেন, রেকর্ডের বিভিন্ন রকম তথ্যপ্রমাণ নিয়ে গিনেস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ চলছিল। ৪৮ ঘণ্টার ছয়টি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ, ১৩ জন সাক্ষীর দেওয়া প্রমাণপত্র, সার্ভেয়ারের দেওয়া প্রতিবেদন, অজস্র ছবি, জিপিএসে রাইডের ডেটা এবং আরও অনেক কিছু গিনেস কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাতে হয়েছিল। সেসব যাচাই-বাছাই শেষে গতকাল শুক্রবার গিনেস কর্তৃপক্ষ তাদের সিদ্ধান্ত জানায়। কিন্তু টিমবিডিসির পক্ষ থেকে আজ শনিবার জানানো হলো।
দুই বছর পর বিজয় রাইড
গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের সঙ্গে বিজয় রাইডের একটা সংযোগ কিন্তু আছে। বিডিসাইক্লিস্টস প্রথম গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস গড়েছিল ২০১৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে। বিজয় রাইডটাও প্রতিবছর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসেই হয়। ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার রেকর্ডের রাইডটাও ছিল বিজয় দিবসে অল্প কিছুদিন আগেই। করোনাকাল শুরু হওয়ার পর বিজয় রাইডই ছিল বিডিসাইক্লিস্টের প্রথম বড় কোনো রাইড।
সর্বশেষ বিজয় রাইড হয়েছিল ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে। তবে পরের বছর মার্চ মাসেই দেশে চলে আসে করোনাভাইরাস। আটকে যায় স্বাধীনতা রাইড। বন্ধ হয়ে যায় বিগিনারস লেসন, বাইক ফ্রাইডে, জোশিলা স্যাটারডে, নাইট রাইডের মতো সব রাইড। ঘরবন্দী হয়ে পড়েন সাইক্লিস্টরা।
২০২১ সালের শুরুতে দেশে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ছিল বলে স্বাধীনতা রাইডের ঘোষণা দিয়েছিল বিডিসাইক্লিস্টস। তবে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আবারও আটকে দেয় স্বাধীনতা রাইড। অবশেষে বিজয়ের ৫০ বছরে আবারও ফিরেছে বিজয় রাইড। একদম শেষ মুহূর্তে, রাইডের মাত্র দুই দিন আগে বিডিসাইক্লিস্টের ফেসবুক পেজ থেকে আসে বিজয় রাইডের ঘোষণা।
বিজয় দিবসে ভোর থেকে সাইক্লিস্টদের মিলনমেলায় ভরে উঠেছিল হাতিরঝিল। প্রতিবছর রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ থেকে বিজয় রাইড শুরু হলেও বিভিন্ন কারণে এবার রাইড শুরু হয় হাতিরঝিল থেকে। এ বছর বিজয় রাইডের পুরো রুটটাই ছিল নতুন। নতুন রুট কিংবা লম্বা বিরতি—কোনো কিছুই বিজয় রাইডের আনন্দ কমাতে পারেনি। শহরের বিভিন্ন রাস্তা ঘুরে আবার হাতিরঝিলে এসেই শেষ হয় বিজয় রাইড ২০২১। পুরো রাইড পরিণত হয়েছিল সাইক্লিস্টদের মিলনমেলায়। বছরের সবচেয়ে বড় রাইডে এসে প্রাণ ফিরে পেয়েছিলেন সাইক্লিস্টরা।