১৯৮২ সালের মার্চ মাস। প্রতিদিনের মতো সেদিনও প্রচণ্ড গরম পড়েছে। কিন্তু রোদের তেজটা একটু বেশিই মনে হচ্ছে। দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষ করে ফ্রান্সিস জ্যাক পাটজের (Francis “Jack” Putz) চোখটা একটু বুজে আসছিল। সকাল থেকে কোস্টারিকার গুয়ানাকাস্ট ন্যাশনাল পার্কে ফিল্ড ট্রিপের কাজ করেছেন। বেশ ক্লান্ত। তবে গরমের কারণে ঠিক আরাম পাচ্ছিলেন না। শুয়ে পড়লেন পার্কের নরম ঘাসে।
আকাশের দিকে তাকিয়েই ফ্রান্সিসের মনে হলো, আরে, গাছগুলো তো অনেকটা ছাতার মতো পাতাগুলো ছড়িয়ে আছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, প্রতিটি গাছে ডালপালা আর পাতা নির্দিষ্ট সীমানা ঘিরে রয়েছে। কোনো গাছের পাতা কোনো গাছকে অতিক্রম করেনি। যেন একটি আরেকটিকে না ছোঁয়ার খেলা চলছে।
গাছের শীর্ষের এই আচরণকে বলা হয় ক্রাউন শাইনেস। পৃথিবীর বিভিন্ন বনাঞ্চলে তা লক্ষ করা যায়। কোস্টারিকার ম্যানগ্রোভ থেকে শুরু করে মালয়েশিয়ার বনভূমিতেও দেখা যায়। তবে বিজ্ঞানীরা এখনো সম্পূর্ণ নিশ্চিত নন, গাছগুলো কেন একে অন্যের সীমানা অতিক্রম করে না।
ফ্রান্সিসের গল্পে ফিরে আসি। জীববিজ্ঞানী ফ্রান্সিস জীবনের অনেকটা সময় অতিক্রম করেছেন বিভিন্ন উদ্ভিতের জীবন নিয়ে গবেষণা করে। তাঁর মতে, গাছেরও হয়তো ‘পার্সোনাল স্পেস’-এর প্রয়োজন। বিশ্রাম নেওয়ার সময় এভাবে কত কিছুই আবিষ্কার করে ফেলেছেন তিনি!
ফ্রান্সিস ও তাঁর দলের এই পর্যবেক্ষণ নিয়ে এখনো কাজ করে যাচ্ছেন অনেকে। অনেক সময় বাতাস এই দূরত্ব বজায় রাখতে সাহায্য করে। তবে এ ধরনের দূরত্ব থাকলে অনেকভাবেই গাছের উপকার হতে পারে। সূর্যের আলো ঠিকঠাকভাবে গাছ পায়। আবার অনেক সময় বিভিন্ন পরজীবী এক গাছ থেকে অন্য গাছে ছড়ায় না। বিভিন্ন রোগও কম ছড়ায়।
তোমরা কি ট্রি ফাউন্ডেশনের কথা জানো? গাছ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের গবেষণা চালায় দলটি। দলের পরিচালক মেগ লোম্যানও একজন জীববিজ্ঞানী। তাঁর মতে, গাছ যদি নিজের মতো বেড়ে ওঠে, মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে, তাহলে গাছের কার্যক্ষমতা বাড়ে। আলাদা থাকার এই গুণ অসাধারণ, গাছ নিজেই তার স্বাস্থ্যের যত্ন নেয়।
তবে ১৯২০ সাল থেকেই বিভিন্ন বিজ্ঞানভিত্তিক বইয়ে গাছের এই ক্রাউন শাইনেসের কথা এসেছে। গবেষকেরা যদিও এর অনেক পরে তা নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে তা নিয়ে অনেকেই অনেক ধারণা প্রকাশ করেছেন।
১৯৮৪ সালে ফ্রানসিস ও তাঁর দল একটি রিসার্চ পেপার প্রকাশ করে। সেখানে উল্লেখ করা হয়, ক্রাউন শাইনেস স্বাভাবিকভাবে দুই বাড়ন্ত গাছের মধ্যকার একধরনের প্রতিযোগিতা হতে পারে। প্রতিটি গাছই প্রতিযোগিতা করে নিজেদের পাতা গজাতে থাকে এবং নিজেদের সীমানা নির্ধারণ করে। আবার ম্যানগ্রোভ বনভূমির গাছগুলোও যত বেশি বাতাসের সংস্পর্শে আসে, ততটা ডালপালা ছড়িয়ে দিয়ে নিজের রাজত্ব তৈরি করে।
এর প্রায় দুই দশক পরের ঘটনা। মিশিগান টেকনোলজিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী মার্ক রুডনিকি কানাডার লজপোল পাইনগাছ নিয়ে গবেষণা করেন। লম্বা ও প্রায় সমপরিমাণ উচ্চতার গাছগুলোর ক্রাউন শাইনেসের আচরণ লক্ষণীয়।
অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, ক্রাউন শাইনেসের বিভিন্ন ধরনের পন্থা রয়েছে। রুডনিকির তথ্যানুযায়ী, গাছেরা নিজেদের নির্দিষ্ট সীমানার বাইরে নতুন করে পাতা গজায় না। কারণ, এভাবে বেকার পাতা গজিয়ে নিজেরই ক্ষতি। গাছের জন্য একটা নতুন টিস্যু বৃদ্ধি করাও অনেক মূল্যবান। কিছু কিছু গাছের আবার স্পেশালাইজড সেন্সরি সিস্টেম থাকে। অন্য গাছের সংস্পর্শে এলে তারা বুঝতে পারে। সে হিসাবে বলা যায়, গাছ যদি একে অন্যের উপস্থিতি বুঝতে পারে, তাহলে পাতার বাড়ন্ত অবস্থাও হয়তো আটকাতে পারে।
গাছের কাছে নিজের পাতা অনেকটা ডায়মন্ডের মতোই মূল্যবান। গাছ তাই চেষ্টাও করে নিজের সব পাতাকে রক্ষা করতে। যদি গাছের পুরো একটা ডাল ভেঙে যায়, তাহলে বলতে পারো তা গাছটির জন্য বিশাল ক্ষতির ব্যাপার। হালকা বা কম ঘন গাছের পাতা সূর্যের আলোকে বনের ভূমি পর্যন্ত পৌঁছে যেতে সাহায্য করে। সে ক্ষেত্রে মাটির সঙ্গে লেগে থাকা অনেক উদ্ভিদ ও প্রাণীরও উপকার হয়। ক্রাউন শাইনেসে গ্যাপ অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের আক্রমণ থেকে গাছকে বাঁচায়, আর সূর্যের আলো পৌঁছে দিতে সাহায্য তো করেই।
গাছেদের নিজের সুবিধার্থে এই পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়। করোনাভাইরাস আক্রমণের পর তা প্রতিরোধে আমাদেরও গাছের মতো প্রায় একই রকম নিয়ম অনুসরণ করতে হচ্ছে। তা হলো ‘সোশ্যাল ডিসটেন্সিং’ বা ‘সামাজিক দূরত্ব’ বজায় রাখা। কারণ, তা পালন করলে নিজে ভালো থাকতে পারব, অন্যদেরও ভালো রাখতে পারব।