২০১৪ সালের মে মাসে দক্ষিণ আফ্রিকা বেড়াতে গিয়েছিলাম আমরা চার বন্ধু। জোহানেসবার্গ শহরের বিমানবন্দরে নেমেই ছয় দিনের জন্য ভাড়া করলাম একটা শেভ্রোলেট গাড়ি। তেল-পানি আমাদের, গাড়ি চালাব আমরাই, কোম্পানিটির কাজ হলো মজবুত, পরিষ্কার ও চালু একটা গাড়ির ব্যবস্থা করা। ভাড়া জোহানেসবার্গ থেকে নিলেও গাড়িটি ফেরত দিতে পারি যেকোনো স্থানে, এমনকি চাইলে এই কোম্পানির অন্য কোনো দেশের অফিসেও। পরিকল্পনা ছিল এই শহরে দুদিন থেকে কেপটাউনে যাব। অনেক কিছুর জন্য কেপটাউন আমাদের আকর্ষণের শহর। নেলসন ম্যান্ডেলা তাঁর ২৭ বছর বন্দিজীবনের ১৮ বছর কাটিয়েছেন জনবিচ্ছিন্ন রোবেন দ্বীপের এক কারাগারে। দ্বীপটা এই কেপটাউনেই। আরেকটা মজার বিষয় এখানে আছে, আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগর এখানে এসে মিলিত হয়েছে। দুই মহাসাগরের দুই রঙের পানির মিশে যাওয়ার রেখাটা এখানে খুব পরিষ্কারভাবে দেখা যায়।
জোহানেসবার্গ থেকে কেপটাউনের দূরত্ব প্রায় এক হাজার ৪০০ কিলোমিটার, যা কিনা ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের দূরত্বের তুলনায় প্রায় ছয় গুণ বেশি। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই হোটেল থেকে বেরিয়ে মালসামানা গাড়িতে তুলে গরম কফির গ্লাস হাতে নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম।
দুর্দান্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশে প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার পথ গাড়ি নিয়ে যাব আর আসব—ভাবতেই রোমাঞ্চিত হচ্ছিলাম। পথে অনেক জায়গায় থেমেছি, আফ্রিকার কফি খেয়েছি, হাত-পা ছড়িয়ে বিশ্রাম করেছি, বিচিত্র সব খাবার চেখে দেখেছি, রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখে বাগানে ঢুকে দুই হাত ভরে আঙুর নিয়ে খেয়েছি। জোহানেসবার্গ থেকে আগেই অনলাইনে কেপটাউনের হোটেল ঠিক করে রেখেছিলাম। সেই হোটেলে গিয়ে পৌঁছালাম রাত একটায়। ছোট্ট হোটেল। নেদারল্যান্ডস থেকে আসা এক ভদ্রমহিলার এটা। উনি নিজেই চালান। নিজ হাতে অতিথিদের সকালের নাশতা তৈরি করে দেন। দুদিন কেপটাউনে থেকে আবার জোহানেসবার্গের দিকে রওনা দিলাম খুব ভোরে। আমাদের খুব ইচ্ছা হচ্ছিল সকালের আলোয় দক্ষিণ আফ্রিকার গ্রামগুলো দেখে দেখে যাব। তাই যে পথে এসেছিলাম, ঠিক সে পথেই না ফিরে কিছু ঘুরপথ ধরেছিলাম। বাইপাস রাস্তা ব্যবহার না করে অনেকগুলো ছোট শহরের মাঝ দিয়ে পার হয়ে এসেছি। থেমেছি, কফি খেয়েছি।
একেকটা শহর নিজের মতো করে সাজানো। যখন কোলেসবার্গ শহরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। কোলেসবার্গ—জার্মান শহরের মতন নামটা। মনে হলো এই জায়গা একটু বেশি করেই ঘুরে দেখি। প্রধান রাস্তার দুপাশে এক বা দোতলা বাড়ি আর দোকান। লোকজন একেবারেই নেই। শহর যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু রেস্টুরেন্ট থেকে কিছু মানুষের শব্দ পাওয়া যায়। আমাদের গাড়িটা খুব ধীরে গড়িয়ে গড়িয়ে চলছিল আর আমরা দুপাশ দেখছিলাম। হঠাৎ আমাদের সবার চোখ একসঙ্গেই একতলা একটা সাদা বাড়ির দিকে গিয়ে পড়ল। দালানের গায়ে বড় ও গোটা গোটা করে ইংরেজি অক্ষরে লেখা: ‘বাংলাদেশ’। আমরা সবাই বিস্ময়ে প্রায় সমস্বরে বলে উঠলাম, ‘বাংলাদেশ’! মুহূর্তেই ঠিক করে ফেললাম আজ রাতে এ শহরে থেকে যাব।
সে রাতে ক্লান্তিতে কখন যে আমরা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই। পরদিন বেশ বেলা করে ঘুম ভাঙল। ছোট্ট ওই হোটেলে সকালের নাশতার কোনো আয়োজন নেই। ভাবলাম, আগে ‘বাংলাদেশ’ রহস্যটা খোলাসা করে নিই, তারপর ধোঁয়া ছড়ানো কফি দিয়ে ব্রেকফাস্ট করেই জোহানেসবার্গের দিকে রওনা দেব। কোলেসবার্গের ‘বাংলাদেশে’ এলাম। দেখলাম এটা তৈজসপত্র ও আসবাব বিক্রির একটা দোকান। চালু দোকান, অনেক ক্রেতা দেখলাম ঘুরে ঘুরে সদাই করছেন। দূর থেকে আমাদের দেশের মানুষের মতো দেখতে একজনকে দেখলাম। কাছে গিয়ে হইহুল্লোড় করে পরিচয় বিনিময় করে জানলাম ওনার নাম আলী। নোয়াখালীর ছেলে। এটা তাঁর দোকান। নাম দিয়েছেন দেশের নামে। বললেন, শুধুই দেশের কথা মনে পড়ে, তাই নামটা এভাবে রেখেছেন।
প্রায় ১৫ বছর ধরে এ দেশে আছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার বিভিন্ন শহরে এ রকম আরও চারটা দোকান রয়েছে। বাংলাদেশের ক্রেতা একেবারেই নেই। স্থানীয় অধিবাসীরাই হলেন ক্রেতা।
সেদিন নাশতা করেই আর চলে আসা হয়নি। সন্ধ্যার আগে আলী আমাদের ছাড়লেন না। তাই সাদা শেভ্রোলেট চালিয়ে জোহানেসবার্গে পৌঁছালাম একেবারে শেষ রাতের দিকে।