জার্মানির মিউনিখের কাছের এক ছোট্ট শহর বাভারিয়া। সেখানকার একটি স্কুলে পড়ালেখা করত ৯ বছর বয়সী ফেলিক্স। তখন ২০০৭ সাল। চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র সে। স্কুলে ইংরেজিতে প্রেজেন্টেশন জমা দিতে হবে। বিষয় জলবায়ু পরিবর্তন। তা সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা না থাকলেও বড়দের সাহায্য নিয়ে কাজ শুরু করল ফেলিক্স ফিঙ্কবাইনার। রিসার্চ শুরুর পর প্রথমেই তার নজরে আসে কেনিয়ান পরিবেশবাদী ওয়াঙ্গারি মাথাইয়ের কাজগুলো। মাটির ক্ষয়রোধ ও বন নিধন রোধে এই নারীকর্মী আন্দোলন শুরু করেছিলেন। নিজের দেশের মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে ৩০ মিলিয়ন গাছ লাগিয়েছিলেন, তা–ও আবার ৩০ বছরে! এ কাজের জন্য প্রথম আফ্রিকান নারী হিসেবে ২০০৪ সালে তিনি পেয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার। জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক ক্যাম্পেইন বিলিয়ন ট্রি প্রোগ্রামও এখান থেকেই খানিকটা অনুপ্রাণিত।
মাথাইয়ের উদ্যোগ থেকে অনুপ্রাণিত হয় ফেলিক্স। নিজের প্রেজেন্টেশনে গাছ লাগানোর ভূমিকা জলবায়ু পরিবর্তনে কতটা সহায়ক হতে পারে, সেই বিষয়ে আলোচনা করে সে। শেষ অংশে সে উল্লেখ করে ‘চলো আমরা পৃথিবীর প্রতিটি দেশে এক মিলিয়ন গাছ লাগাই’।
অবাক করা এ ঘটনা দ্রুত ছড়িয়ে যায় চারদিকে। বিভিন্ন স্কুলে পাঠানো হয় ফেলিক্সকে। সেখানে গিয়ে গাছ লাগানোর বিষয়টি সম্পর্কে সবাইকে জানায় সে। দুই মাস পর ফেলিক্সের নিজের স্কুল, মিউনিখ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে আনুষ্ঠানিকভাবে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি নেওয়া হয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেই খবর দেখে অনেক স্কুলই নেয় এই কর্মসূচি। দ্রুত স্থানীয়ভাবে চালু হয়ে যায় ফেলিক্সের আইডিয়া। এর তিন বছর পর, জার্মানিতে এক মিলিয়নের শেষ চারাটি রোপণ করে ফেলিক্সরা। জন্ম হয় ‘প্ল্যান্ট ফর দ্য প্লানেট’ গ্রুপের। জার্মানির সবচেয়ে কম বয়সী পরিবেশবিষয়ক সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা খেতাব পায় ফেলিক্স।
ফেলিক্সের এই কাজে পাশে দাঁড়ায় বিশ্বের অনেকেই। যেমন নাইরোবির লেসেইন মিউটাকি। প্রতি ম্যাচে একটি করে গোলের জন্য একটি করে নতুন গাছ লাগানো শুরু করে ১৫ বছর বয়সী এই ফুটবলার। মিউটাকির এই অবদানও কেনিয়ার বনভূমির পরিমাণ বাড়াতে বিশাল ভূমিকা রাখে।
এর আগে ২০০৮ সালে জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির জুনিয়র বোর্ড মেম্বার হয় ফেলিক্স। ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টেও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে ভাষণ দেয় সে। ২০০৯ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার এক যুব কনফারেন্সে ভাষণ দেওয়ার সময় সারা পৃথিবীর ৮০০ ছেলেমেয়ে যুক্ত হয় তার সঙ্গে। ৫৬টি দেশের ছেলেমেয়েরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় যে নিজেদের দেশে এক মিলিয়ন গাছ লাগাবে। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। ‘স্টপ টকিং, স্টার্ট প্ল্যান্টিং’ ক্যাম্পেইনে ফেলিক্সের সঙ্গে যুক্ত হন হ্যারিসন ফোর্ড, প্রিন্স অ্যালবার্ট মোনাকোসহ আরও অনেক তারকা।
এরপরই নেওয়া হয় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ট্রিলিয়ন ট্রি ক্যাম্পেইন। ২০১১ সালে নেওয়া এই ক্যাম্পেইনের কাজ চলছে এখনো। লেখাটা যখন লিখছি, ততক্ষণ পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে ১৩.৪৮ বিলিয়ন গাছ লাগানো হয়েছে।
বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে স্নাতক শেষ করে জুরিখে পিএইচডি করছেন ফেলিক্স। সময়ের কাঁটা ঘুরে ফেলিক্সের বয়স এখন ২২ হলেও বুকে স্বপ্ন কিন্তু এখনো একই। সময় পেলেই ছুটে যায় ‘প্ল্যান্ট ফর দ্য প্লানেট’–এর সংগঠকদের কাছে। তাদের অনুপ্রেরণা দিতেই ফেলিক্স বলেন, ‘গান গেয়ে আনন্দ পেলে তোমার প্রতিটি সুরের জন্য গাছ লাগাও, পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেলে গাছ লাগাও। তোমার জীবনের প্রতিটি সফলতায় একটি করে গাছ লাগাও।’
জলবায়ু পরিবর্তনের ভোগান্তি পোহাতে হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে। আজকের শিশুরা ভবিষ্যতে বড় হয়ে যেন ভালোভাবে বাঁচতে পারে, সেটাই ফেলিক্সের লক্ষ্য। ছোট ছোট চারাই একসময় পরিণত হয় বিশাল বৃক্ষে। আমাদের অক্সিজেন দেয়। মাটির ক্ষয়রোধ করে। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বেশি বেশি গাছ লাগানো অভাবনীয় ভূমিকা রাখতে পারে। ফেলিক্সরা দিন দিন পৃথিবীর বুকে গাছ লাগিয়ে যাচ্ছেন। জলবায়ু পরিবর্তনে প্রতিটি গাছেরই ব্যাপক ভূমিকা আছে। তাঁরা স্বপ্ন দেখেন, ২০৫০ সালের মধ্যে আমরা যেন ১০০ শতাংশ নবায়নযোগ্য শক্তিনির্ভর হই। এই পদক্ষেপে তোমরাও কিন্তু যুক্ত হতে পারো।