কুড়িয়ে পাওয়া বিড়াল ও কুকুরছানা কী করবে?

স্কুল শেষে দৌড়ে বাসস্ট্যান্ডে গেল রাতুল। আজ ওর জন্মদিন। মন খুব ভালো। ক্লাসের সবাই মিলে শুভেচ্ছা জানিয়েছে। আবার কানমলা দিয়ে সবার কান লম্বা করার পেছনে যার কৃতিত্ব, সেই নির্মল স্যারের ক্লাসেও কোনো অঙ্ক ভুল হয়নি। হাসি হাসি মুখ নিয়ে যাত্রীছাউনিতে বসতে যাবে, অমনি শোনে ‘মিউ!’ নিচে তাকাতেই দেখল পায়ের কাছে গুটিসুটি মেরে বসে আছে ছোট্ট একটা বিড়ালছানা। দেখেই মায়া লেগে গেল। ঠান্ডায় কাতর বিড়ালটাকে কোলে তুলে নিল রাতুল। আরেকটু হলেই ওর জুতার আঘাত লাগত ভেবে সরিও বলল মনে মনে। কিন্তু বিড়ালটা এখানে কেন? ওর মা কোথায়? রাতুল ভাবল, হয়তো আশপাশেই আছে, মানুষের ভিড়ে কাছে আসতে পারছে না। ওর মা না আসা পর্যন্ত ওখানেই বসে থাকবে বলে ঠিক করে ফেলল সে। দেখতে দেখতে পার হয়ে গেল দুই ঘণ্টা। কিন্তু ওর মায়ের দেখা নেই। স্কুল তালা দিয়ে হেডস্যারও চলে এলেন বাসের জন্য। তাঁকে দেখে দৌড়ে গিয়ে ঘটনাটা বলল রাতুল। শুনে স্যার বললেন, ‘তুই ওকে বাসায় নিয়ে যা। ওর মা আর আসবে না মনে হচ্ছে। এখানে রাখলে কারও না কারও পায়ের নিচে পড়ে মারা যাবে।’

বাসায় নিয়ে যাওয়ার কথা ভেবেই রাতুল ফিক করে হেসে উঠল। বাহ্! কী মজাই না হবে! যেই ভাবা সেই কাজ। ওকে কোলে নিয়ে বাসে চড়ল রাতুল। পথে যেতে যেতে ভাবল, সারা দিন নিজের কাছে রাখবে ওকে। কোলেপিঠে করে ‘মানুষ’ করবে। একসঙ্গে খেলবে, খেতে দেবে। রাতুল একটা নামও ঠিক করে ফেলল বিড়ালটার, ‘অগি’। বাসার কাছে গিয়ে রাতুল দেখল কোলেই ঘুমিয়ে গেছে অগি। কিন্তু বাসায় ঢুকতেই যদি সবাই চিৎকার করে ‘হ্যাপি বার্থডে’ গায়! তাতে ওর ঘুম ভেঙে যেতে পারে—এসব ভাবতে ভাবতে কলবেল চাপল। ভেতরে এক পা দিতে না দিতে চিৎকার হলো ঠিকই। তবে উইশ না!

আম্মু চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘তোর কোলে এটা কী? খবরদার বাসায় এটা রাখবি না। বিড়াল পুষতে চাইলে তোকে আর বিড়ালকে একসঙ্গে বাইরে রেখে আসব।’ আম্মু মাঝেমধ্যে অদ্ভুত সব কথা বলেন। বাইরে রেখে আসব বললেই হলো নাকি? একটা বাচ্চা একা বাইরে থাকবে?

‘কী? মুখ বন্ধ করে আছিস কেন? এক্ষুনি বের হ। যেখানে পেয়েছিস, ওখানেই রেখে আয় এটাকে। কী ময়লা বিড়াল!’

‘ওর নাম অগি।’

‘অগি-বগি যাই হোক, এটা বাসায় থাকতে পারবে না’

‘কেন আম্মু, ওকে পুষলে কী হয়?’

‘পুষতে চাইলেই হবে না। আমিও ছোটবেলায় বিড়াল পুষতাম। যেকোনো প্রাণী পুষতে সঠিক যত্ন লাগে। তারা মুখ ফুটে তাদের প্রয়োজনের কথা বলতে পারে না। তাই ঠিকমতো না পুষলে তাদের কষ্ট দেওয়া হয়। আমাদের বাসায় একে দেখে রাখবে কে? আমি সারা দিন অফিসে থাকি, তুই স্কুলে। বিড়ালকে খাওয়াতে হবে, পটি করাতে হবে। তার ওপর, এসবের পশমে তোর বাবার অ্যালার্জি আছে। বাসায় একটা বিড়াল থাকলে সবখানে পশম উড়বে।’

‘তাহলে কি আমার বিড়াল পোষা হবে না?’

‘হবে। যেদিন তুই নিজে রেসপন্সিবল হবি, বাসায় বিড়াল এসে কষ্ট পাবে না, সেদিন হবে।’

ইশ্! আম্মুটা যে কেন এমন করে! বিড়ালটা নিয়ে এখন কী করি। পিউ আপু আসুক। একটা ব্যবস্থা নিশ্চয়ই হবে।

সন্ধ্যায় রুটিনমাফিক পড়াতে এলেন পিউ আপু। জন্মদিনে রাতুলের মন ভালো থাকার কথা। কিন্তু উনি দেখলেন রাতুল মুখ ভার করে বসে আছে। জিজ্ঞেস করতেই ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠল ও। কাঁদতে কাঁদতে খুলে বলল পুরো ঘটনা। রাতুলের প্রধান চিন্তা, কোথায় রাখবে অগিকে? আগের জায়গায় রেখে এলে সে তো মারাই যাবে। ওর কোনো বন্ধুও তো বিড়াল পোষে না।

‘আপু, তুমি ওকে তোমার কাছে রাখতে পারবে?’ রাতুল জিজ্ঞেস করল।

‘আমি তো হলে থাকি। সেখানে রাখা অসম্ভব। আমার মা অবশ্য বিড়াল পছন্দ করে। অনেকগুলো বিড়াল আছে তার। কিন্তু, সে তো দিনাজপুরে।’

‘তাহলে?’

একটু ভেবে পিউ আপু বললেন, ‘আমি একটা বুদ্ধি দিতে পারি। তবে কান্না থামাতে হবে।’

কান্না থামিয়ে নাক টানতে টানতে রাতুল বলল, ‘কী বুদ্ধি?’

‘বেশ কয়েকটা গ্রুপ আছে, যেখানে অনেকে বিড়াল বা কুকুর অ্যাডপ্ট করে। ফেসবুকে ওদের গ্রুপও আছে।’

‘সত্যিই?’ চোখ মুছতে মুছতে পিউ আপুর দিকে তাকাল রাতুল। অগিকে কাছে রাখতে পারবে না বলে ওর মন একটু খারাপ বটে। কিন্তু ওকে রাস্তায় রাখতে হবে না জেনে খুশি হয়ে গেল সে।

‘কী করতে হবে?’

‘তেমন কিছু না। দেশে যারা বিড়াল পোষে, তাদের একটা গ্রুপ আছে ফেসবুকে। ওখানে পোষার নিয়ম থেকে শুরু করে বিড়ালের কোন অসুখে কী করতে হবে এমন সব সমস্যার সমাধান আছে। কারও বিড়ালের বাচ্চা হলে সেটাও অন্য কেউ পুষতে নিতে পারে।’ রাতুল তো অবাক! দারুণ তো!

‘গ্রুপটায় ৫০ হাজারের বেশি সদস্য আছে। কারও কোনো দরকার হলে লিখতেও পারে সেখানে। বিড়াল পোষার প্রাথমিক নিয়মগুলো সেখান থেকেই শিখেছি আমি।’

‘আর কুকুর পুষতে চাইলে?’

‘তাদের জন্য এ রকমই আরেকটা গ্রুপ আছে। আমার বন্ধু একবার তিনটা কুকুরছানা পেয়েছিল। গ্রুপে সে খবরটা পোস্ট করার এক ঘণ্টার মধ্যেই তিনটা বাচ্চা বুক করে ফেলে তিনজন। ও এখন ফেসবুকে নিয়মিত ওই বাচ্চা তিনটার ছবি দেখে। নিজের কাছে নেই তো কী হয়েছে!’

রাতুল হা করে পিউ আপুর কথা শুনতে থাকল। ‘আর বিড়াল-কুকুরসহ সব প্রাণী নিয়ে কাজ করে অভয়ারণ্য বাংলাদেশ অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন। প্রাণীসংক্রান্ত যেকোনো সমস্যা তাদের ফেসবুক পেজে জানাতে পারো। তারা খুশিমনে সমাধান দেবে।’

রাতুল বলল, ‘তাহলে আমরা এক্ষুনি অগিকে কারও কাছে দেওয়ার ব্যবস্থা করি।’ ‘হ্যাঁ, করা যায়। চলো, তাই করি।’ আজ পড়তে হবে না।’ বলে পিউ আপু তার স্মার্টফোনটা দিয়ে অগির কয়েকটা ছবি তুললেন। এরপর ফেসবুকে ‘ক্যাট সোসাইটি অব বাংলাদেশ’ গ্রুপে পোস্ট করে দিলেন। সঙ্গে লিখেও দিলেন যে তিনি কোন এলাকায় আছেন। ১০ মিনিট যেতে না যেতেই প্রথম কমেন্ট এল। একটু পরে কমেন্ট করল আরেকজন। তারপর আরেকজন। এভাবে একের পর এক কমেন্ট আসতেই থাকল। রাতুল অবাক হয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে।

‘কী? দেখলে তো, এত কঠিন কিছু নয়।’ পিউ আপু রাতুলের মাথায় আলতো করে একটা টোকা দিলেন। এরপর সেখানেই একজনের সঙ্গে কথা হলো। রাতুলের বাসার কাছে তার বাসা। রাতুল ভাবল, তাকে দিলে মাঝেমধ্যে দেখে আসতে পারবে অগিকে। তা-ই ঠিক হলো। সকালে ছেলেটা নিজে এসে নিয়ে যাবে অগিকে। ছবিটার ক্যাপশনে লিখে দেওয়া হলো ‘অ্যাডপটেড’। ‘আজ আসি। শুভ জন্মদিন।’ বলে পিউ আপু উঠলেন। বাসা থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলেন তিনি। পেছনে তাকিয়ে দেখলেন অগিকে কোলে নিয়ে আদর করছে রাতুল।