কিরীটী

বইয়ের প্রচ্ছদ একদম কুচকুচে কালো, তাতে হলুদ রঙে আঁকা মুখের একপেশে ছায়াচিত্র। ছায়াচিত্রের মাথায় বাঁকানো সাহেবি টুপি আর ঠোঁটে জ্বলন্ত চুরুট। প্রচ্ছদ থেকেই যেন লেখক নীহাররঞ্জন গুপ্ত গতানুগতিক বাঙালি গোয়েন্দা কাহিনির বাইরের কোনো গল্প শোনানোর আশ্বাস দিলেন।

সে আশ্বাস মিথ্যে হয়নি। প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়, পাঁচকড়ি দে, হেমেন্দ্র কুমারের জয়ন্ত-মানিক, দেবেন্দ্র বিজয়-অরিন্দম বাঙালি পাঠককে প্রথম গোয়েন্দা কাহিনির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেও এ চরিত্রগুলো যেন ছিল কোনান ডয়েলের শার্লক-ওয়াটসনের ছায়াবন্দী। অন্যদিকে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালজয়ী চরিত্র ব্যোমকেশ বক্সীর মধ্যবিত্ত বাঙালিয়ানা তার সত্যানুসন্ধানের ক্ষিপ্রতাকে যেন বাধাগ্রস্ত করছিল। বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যের এমন অবস্থায় পাঠককে সত্যিই এক ভিন্নমাত্রার স্বাদ দিয়েছিল নীহাররঞ্জন গুপ্তের মননে বাঙালি কিন্তু পোশাকে সাহেবির গোয়েন্দা চরিত্র কিরীটী রায়।

‘প্রায় সাড়ে ছ-ফুট লম্বা। গৌরবর্ণ। মজবুত হাড়ের ফ্রেমে বলিষ্ঠ এক পৌরুষ। মাথাভর্তি ব্যাকব্রাশ করা কোঁকড়ানো চুল। চোখে পুরু লেন্সের কালো সেলুলয়েড চশমা। নিখুঁতভাবে কামানো দাড়িগোঁফ। ঝকঝকে মুখে হাসি যেন লেগেই আছে। আমুদে, সদানন্দ এবং প্রখর রসবোধ। অসাধারণ বাক্চাতুর্য। কিন্তু মিতবাক।’— লেখক নীহাররঞ্জন গুপ্ত এভাবেই পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন সত্যানুসন্ধানী কিরীটী রায়কে।

ব্যোমকেশ, ফেলুদা কিংবা শার্লকের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় হয়তো কিরীটীর পক্ষে বাজি ধরবে খুব কম লোকই। কিন্তু জনপ্রিয় এসব গোয়েন্দার মতো গাম্ভীর্য  নেই কিরীটীর। পাশের বাড়ির ছেলের মতো সে কখনো নিছক আড্ডায় ব্যস্ত বন্ধু সুব্রতর সঙ্গে, আবার কখনোবা  চিন্তামগ্ন  টালিগঞ্জের বাড়ির পোর্টিকোতে। স্ত্রী কৃষ্ণার সঙ্গে নিতান্তই সাংসারিক আলাপে যেমন কিরীটীকে পাওয়া যায়, তেমনি যখন কলকাতার জনহীন রাস্তা ঘুমন্ত অজগরের মতো গা এলিয়ে পড়ে, তখন পানামা হ্যাট পরা কিরীটী ছুটে চলে সত্যানুসন্ধানে।

বইয়ের সাদা-কালো পাতায় কলকাতা থেকে বার্মা শহরের রহস্যের আলো-আঁধারি নিয়ে আবির্ভাব কিরীটী রায়ের। বন্ধু ও সহযোগী সুব্রতর উপস্থিত বুদ্ধি যেমন তার সহায়ক, তেমনি পরাক্রমশালী প্রতিপক্ষ কালো ভ্রমর নতুন নতুন বিপদের মুখে ফেলে কিরীটীর চরিত্রকে করেছে আরও সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী। ঘোরতর সংসারী হলেও কিরীটী ক্ষিপ্রতা হারায়নি কখনো; বরং নিশুতি রাতের অন্ধকারে নিঃশব্দে এসে দাঁড়ায় কালো অ্যাম্বাসেডর। দরজা খুলে ততোধিক নিঃশব্দে নেমে আসে আগাপাছতলা সাহেবি পোশাকের এই পুরুষ। দৃঢ় পা ফেলে প্রবল আত্মবিশ্বাসে সে এগিয়ে যায় নিশানার দিকে। অটল লক্ষ্যভেদ—এমন সব প্রেক্ষাপটে কিরীটীর উপস্থিতি বাংলা গোয়েন্দা কাহিনিকে এমন এক রূপ দিয়েছে, যা পরবর্তী সময়ে পাওয়া গেছে কমই।

শুধু পোশাকে, আচারেই নীহাররঞ্জন গুপ্তের কিরীটী অনন্য তা কিন্তু নয়, কিরীটীর স্রষ্টা পেশায় চিকিত্সক হওয়ায়, চিকিত্সাশাস্ত্রের নানা দিক উঠে এসেছে ‘ক্যাকটাসের বিষ’, ‘মরফিন’, ‘একিমোসিস’ ‘হাইপোডার্মিক নীডল’-এর মতো গল্পে। এমনকি অবচেতন মনের দুঃস্বপ্ন, মৃত্যুভয়, আত্মহত্যাপ্রবণতার মতো মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলোও যে কত বড় অপরাধের সূত্রপাত ঘটাতে পারে, তা-ও নীহাররঞ্জনের আগে কেউ এভাবে তুলে ধরেনি।

কিন্তু সবার আগে এমন নিখুঁতভাবে বাঙালিয়ানা আর সাহেবি কেতা দুটোই তিনি কিরীটীর চরিত্রে কী করে তুলে আনলেন? হয়তো পাঁচকড়ি দে-সহ অন্যান্য বাঙালি লেখকের ভক্ত হওয়া এবং লন্ডনে বিশ্বখ্যাত গোয়েন্দা কাহিনির লেখক আগাথা ক্রিস্টির সঙ্গে সাক্ষাত্ ছিল লেখকের অনুপ্রেরণা।

গোয়েন্দা চরিত্র মানে নিঃসন্দেহে সত্যান্বেষী মন, প্রখর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা আর ক্ষুরধার বুদ্ধির সন্নিবেশ। কিন্তু কৈশোরের মাঝামাঝি বা শেষ দিকে যারা বা গোয়েন্দা কাহিনির একনিষ্ঠ পাঠক যারা, তারা নিশ্চয় শুধু গোয়েন্দার বুদ্ধির জোর আর অ্যাকশনধর্মী রোমাঞ্চ পড়তে পড়তে কিছুটা একঘেয়েমিতে ভুগছ। গতানুগতিক গোয়েন্দার গুণাবলির পাশাপাশি কিরীটী রায়ের জীবনদর্শন, স্বচ্ছতা তা-ই হতে পারে তোমাদের একঘেয়েমির মহৌষধ। সব গোয়েন্দাই যখন অপরাধীকে আইনের হাতে তুলে দিতে ব্যস্ত, তখন কিরীটী তার দুর্ধর্ষতম শত্রুকেও দেয় যথাযথ সম্মান। অপরাধী নির্মূল বা সত্যানুসন্ধানে পিছপা না হলেও মানবিকতাবোধ হারায় না সে। অপরাধের কালো জগত্ যার কার্যক্ষেত্র, তার চরিত্রেও মানবতাবোধের স্পষ্ট ছাপ কীভাবে পাওয়া যায়? এমন নানা প্রশ্ন আর উত্তরের মেলবন্ধন ঘটেছে কিরীটী রায়কে নিয়ে লেখা নীহাররঞ্জন গুপ্তের গল্পগুলোতে। সত্যানুসন্ধানের ক্ষিপ্রতা আর ষোলো আনা বাঙালিয়ানার এমন রুদ্ধশ্বাস সংমিশ্রণ ঘটল যে কিরীটীর চরিত্রে, তার সঙ্গে পরিচয়ে তবে আর দেরি কেন?