বাসা থেকে বের হয়ে লিফটের সামনের দাঁড়িয়ে আছ তুমি। গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে লিফট ওপরে উঠে আসা শুরু করেছে। লিফট পৌঁছানোর পর দরজা খোলামাত্রই ঢোকার জন্য এগোতে গেলে। কিন্তু হঠাৎ কিছু একটা দেখে দাঁড়িয়ে গেলে। লিফটের মধ্যে এক বিশাল সিংহ দাঁড়িয়ে আছে। সিংহের গলায় নেই কোনো দড়ি বা শিকল। আস্তে আস্তে সিংহটি এগিয়ে এল। তোমাকে না দেখার ভান করে পাশ দিয়ে হেঁটে চলে গেল।
হঠাৎ একদিন এমন ঘটনার মুখোমুখি পড়ে গেলে কী করতে? সিংহ তো আর বিড়াল বা কুকুর নয় যে দেখে ভয় পাব না! অনেকে হয়তো ভাবছ, আমি তো সঙ্গে সঙ্গেই ভোঁ–দৌড় দিতাম। তবে সিংহটি যদি ‘কিং’ হতো, তাহলে আর তোমাকে দৌড়াতে হতো না। বরং সিংহটিকে একটু আদরও করে দিতে পারতে। ঘটনাটা খুলেই বলি তাহলে।
১৯৭০ সালের কথা। আজারবাইজানের বাকু শহরে ছোট্ট একটি অ্যাপার্টমেন্টে থাকত এক পরিবার, যারা নিজেদের সঙ্গে সিংহ পুষত। পরিবারের কর্তা লিও একজন স্থপতি ছিলেন। একদিন চিড়িয়াখানা থেকে একটি সিংহশাবক বাসায় নিয়ে আসেন তিনি। কারণ, ছোট্ট বাচ্চাটিকে সিংহী মা কাছে নিচ্ছিল না। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষও আশা ছেড়ে দিয়েছিল। এ জন্যই লিও অসহায় সিংহশাবকটিকে বাসায় নিয়ে আসেন, যার নামই পরবর্তী সময়ে ‘কিং’ রাখা হয়। গল্পের শুরুটা হয়েছিল এখানেই।
ধীরে ধীরে ছোট্ট ওই অ্যাপার্টমেন্টের মধ্যেই বড় হতে থাকে কিং। অন্য চারটা পরিবারের সঙ্গে লিওদের তফাত এই ছিল যে তাঁর স্ত্রী, দুই সন্তানের সঙ্গে একটি সিংহ থাকে। আবার বিশাল দেখতে সিংহটিও খুবই ঠান্ডা মেজাজের। কিং কাউকে খুব পছন্দ করলে চেটে দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করে। তবে কেউ যদি ওকে খুব বেশি বিরক্ত করে, তাহলে দৌড়ে ঘরের কোণে চলে যায়।
বাড়ির কর্তা লিওকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে কিং। অনেক রাতে লিওর কোলের মধ্যেই ঘুমিয়ে যায় সিংহটি। ছোটবেলায় কিংয়ের পায়ের থাবার অংশটি প্যারালাইজড ছিল। এ জন্য হাঁটতে পারত না সে। পরিবারের সদস্যরা অনেক দিন ধরে সেই অংশটি মালিশ করতে থাকেন। একসময় কেটে যায় সমস্যাটি।
যদিও প্রতিবেশীরা সিংহটির ব্যাপারে খুশি ছিল না, সিংহের গন্ধ বা রাতের গর্জনই যার মূল কারণ। তা ছাড়া কে চাইবে দরজা খুলেই করিডরে একটি ৪০০ পাউন্ডের সিংহের দেখা পেতে! কিং সারা ঘর পায়চারি করত, বড় বড় লাফ দিয়ে বিছানায় ওঠা-নামা করত। অনেক সময় তো লিও বা তাঁর স্ত্রীকেও বিছানা থেকে ঠেলে নামিয়ে দিত। নিজে বিছানা দখল করে শুয়ে পড়ত নিশ্চিন্তে। অবশ্য বাসার বাচ্চারা সিংহটিকে কমে ছাড়ত না। টাট্টু ঘোড়ার মতো সিংহের কাঁধে চড়ে ঘুরত, কেশর ধরে টানাটানি করত। কিং রেগে না গিয়ে বরং বাচ্চাদের সঙ্গে খেলা করতে মজাই পেত।
ধীরে ধীরে কিংয়ের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। সিনেমায় অভিনয়ের প্রস্তাবও আসছিল। তখনকার বেশ কিছু জনপ্রিয় সোভিয়েত সিনেমায় অভিনয়ও করে কিং। বেশ কিছু বই ও ডকুমেন্টারিতেও জায়গা করে নেয় সে।
একদিন সেন্ট পিটার্সবার্গে এক শুটিংয়ে নিয়ে যাওয়া হয় কিংকে। সঙ্গে ছিল লিও পরিবার। অন্যান্য দিনের মতোই শুটিং স্পটে কাজ চলছিল। কিন্তু সেখানে আলেক্সান্দার গুরভ নামের এক পুলিশ কর্মকর্তা ভুল বুঝে ভেবেছিলেন কিং বিপজ্জনক আচরণ করছে। যেকোনো সময় কাউকে হামলা করতে পারে ভেবে তিনি গুলিও করে বসেন। ঘটনাস্থলেই করুণ মৃত্যু ঘটে কিংয়ের। মানুষের সঙ্গে বাস করা শান্তশিষ্ট সিংহটির বিশাল নিথর দেহ পড়ে থাকে মাটিতে, কোনো ধরনের হিংস্রতা মৃত্যুর আগে ছিল না যে সিংহটির মধ্যে। লিও পরিবারের অন্যতম সদস্য সেদিন মারা যায়। পাশে বসে কাঁদতে থাকে লিওর দুই সন্তান। মারা যায় একটি শহুরে বন্য প্রাণী।
কিংকে হারিয়ে পরিবারের সদস্যরা মুষড়ে পড়েন। পুনরায় একটি সিংহ নেন তাঁরা (কিং টু)। সঙ্গে নেওয়া হয় ‘লালা’ নামের পাহাড়ি আরেকটি সিংহকে। কিংয়ের মৃত্যুর পর সবাই পরিবারটিকে সাপোর্ট করেছিল। যদিও কিংয়ের মতো পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হচ্ছিল না নতুন সিংহ দুটির। একমাত্র শুধু লিওকেই নতুন কিং মান্য করত। তবে ১৯৭৮ সালে লিও হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। দুই সন্তান ও দুটি বিশাল সিংহ নিয়ে লিওর স্ত্রী পড়ে যান বিপাকে। তিনি চেয়েছিলেন সিংহগুলোকে বার্লিন চিড়িয়াখানায় দিয়ে দিতে, কিন্তু সে রকম কিছুই হয়নি। এর আগেই ঘটে গেছে এক মর্মান্তিক ঘটনা।
১৯৮০ সালের একদিন। ব্যালকনিতে লিওর স্ত্রী একটি সিংহকে প্রচণ্ড রাগান্বিত অবস্থায় পান। প্রতিবেশী এক মদ্যপ ব্যক্তি কিছু পোড়াচ্ছিলেন। আর সেগুলো সিংহটির দিকে ছুড়ে মারছিলেন। আগুনের পোড়ানো জিনিসগুলো ঘাবড়ে দিচ্ছিল সিংহটিকে। অনেক চেষ্টার পর লিওর স্ত্রী সিংহটিকে একটু শান্ত করেন। তবু সিংহটির ভয় কাটে না পুরোপুরি। ছোটাছুটি করতে থাকে সে।
এ অবস্থায় একজন মহিলার দিকে আক্রমণাত্মকভাবে এগিয়ে যায় সিংহটি। মহিলাটি অজ্ঞান হয়ে যান। তাঁর ১৪ বছর বয়সী সন্তান সিংহকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। ছেলেটিও জানত না এটি পোষা সিংহ। ছেলেটির আচরণে সিংহটি আরও বেশি ঘাবড়ে যায়। পরে সে সিংহের শিকার হয় এবং মারা যায় ঘটনাস্থলেই।
প্রতিবেশীরা পুলিশকে জানানোর পরে পরিস্থিতি লিও পরিবারের হাতের বাইরে চলে যায়। কিংয়ের মতোই করুণ পরিণতি হয় কিং টু এবং লালার। স্থানীয় পুলিশ এসে গুলি করে মেরে ফেলে সিংহ দুটিকে। একই পরিণতি হয় তিনটি সিংহের। লিও পরিবারের সদস্য এবং পারিবারিক বন্ধুরা বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে পরবর্তী সময়ে জানান সিংহগুলোর কথা। এসব সিংহ কোনো দিন পরিবারের সদস্য বা কোনো প্রতিবেশীকে আঁচড়ও কাটেনি বা হিংস্র ধরনের আচরণও করেনি। সাধারণ পোষা কুকুর-বিড়ালের মতোই ঘুরে বেড়াত। এ জন্যই সিংহগুলোর মৃত্যু মেনে নিতে পারেননি কেউ-ই।