১৮৫৫ সাল। জার্মান বিজ্ঞানী জুলিয়াস প্লাকার কাজ করছিলেন একটা বায়ুশূন্য কাচনল নিয়ে। সেই কাচনলের ভেতরে দুটি ধাতব দণ্ড যুক্ত করেন। অ্যানোড এবং ক্যাথোড দণ্ড। দণ্ডের একটার প্রান্ত কাচের টিউবের ভেতরে, আরেকটা প্রান্ত থাকে টিউবের বাইরে। প্লাকার একটা বিদ্যুৎ উৎসের দুই প্রান্ত যুক্ত করলেন সেই দণ্ড দুটির সঙ্গে। দণ্ড দুটির নিজেদের সঙ্গে সরাসরি কোনো সংযোগও নেই। তাই সেকালের জ্ঞান অনুযায়ী ধাতব দণ্ড দুটিতে বিদ্যুৎ-সংযোগ দিলেও কাচের টিউবের ভেতর কোনো ঘটনা ঘটার কথা নয়। তবু ঘটল। প্লাকার দেখলেন, ক্যাথোডের কাছাকাছি একধরনের সবুজ আলোর আভা দেখা যাচ্ছে। সেই সবুজ আভার নাম দেওয়া হলো ক্যাথোড রশ্মি। তবে কাচনলের ভেতর এই সবুজ আভা প্লাকারকে ভাবিয়ে তুলল—নিশ্চয়ই কোনো মাধ্যম ছাড়া বিদ্যুৎ প্রবাহিত হতে পারে। পরে তাঁর এই ধারণা সত্য প্রমাণিত হয়। এর পরে রীতিমতো ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটে গেছে এই রশ্মিকে নিয়ে। দুই দলে ভাগ হয়ে গেছেন বিজ্ঞানীরা। বিশ্বযুদ্ধের মতো এখানেও বিভক্ত ব্রিটিশ ও জার্মান বিজ্ঞানীরা। ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই রশ্মি শুধু রশ্মি নয়, কণাও; অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা। এই দলের নেতৃত্বে ছিলেন ব্রিটিশ পদার্থবিদ জুলিয়াস প্লাকার। তিনি ক্যাথোড রশ্মির চলার পথে পাখাযুক্ত ছোট্ট একটা চাকা রাখেন। দেখেন, ক্যাথোড রশ্মি সেই চাকা ঘুরিয়ে দিতে পারে। প্লাকারের যুক্তি, ক্যাথোড রশ্মি বস্তুকণার স্রোত বলেই চাকা ঘোরাতে পারে। আলোলক রশ্মি চাকা ঘোরাতে পারে না। অন্যদিকে জার্মান বিজ্ঞানীরা আঁকড়ে থাকলেন তাঁদের রশ্মি তত্ত্বে। সেই দলের নেতৃত্বে ছিলেন হেনরিখ হার্জ। আলো, বিদ্যুৎ, শব্দ ইত্যাদি তরঙ্গ কম্পাঙ্কের এককের নামকরণ করা হয়েছে তাঁর নামেই।
হার্জই কিন্তু প্রথম ম্যাক্সওয়েলের তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। বেতার তরঙ্গের আবিষ্কারকও তিনি। অবশ্য একই বিষয়ে গবেষণা করেন আমাদের জগদীশচন্দ্র বসুও। হার্জ কাচনলের ভেতর স্থাপন করলেন ধাতব পাত। খুব পাতলা। পাতটা বসানো হলো ক্যাথোড রশ্মির চলার পথে। হার্জ দেখলেন, ক্যাথোড রশ্মি চলে যাচ্ছে ধাতব পাত ভেদ করে। এখানেই বাধল বিপত্তি, ধাতব পাত ভেদ করে গেল কেন? হার্জ ভাবলেন, ক্যাথোড রশ্মি বস্তুকণা হলে এমনটা ঘটত না। নিশ্চয়ই এটা আলোক তরঙ্গ।
শেষমেশ ব্রিটিশদেরই জয় হলো। ১৮৯৭ সাল। ক্যাথোড রশ্মি নিয়ে কাজ করছিলেন পদার্থবিদ জোসেফ জন থমসন। যাঁকে আমরা চিনি স্যার জে জে থমসন নামে। তিনি প্রমাণ করে দিলেন, ক্যাথোড রশ্মি আসলে ইলেকট্রন কণার স্রোত। হ্যাঁ, বায়ুশূন্য কাচনলের পরীক্ষা থেকেই আবিষ্কার হলো মহাবিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত মৌলিক কণা ইলেকট্রনের।
এরপর আবির্ভাব এক জার্মান বিজ্ঞানীর। পদার্থবিজ্ঞানের গণ্ডি ছাড়িয়ে তাঁর অবদান জোরেশোরে উচ্চারিত হয় চিকিৎসাশাস্ত্রে। তাঁর আবিষ্কার এক্স-রে আজও চিকিৎসাশাস্ত্রে অপরিহার্য উপাদান। তিনি উইলহেম কোনার্ড রন্টজেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে তিনিও ক্যাথোড রশ্মি নিয়ে গবেষণা করেছিলেন।
১৮৯৫ সাল। তখনো নিশ্চিত হয়নি ক্যাথোড রশ্মিই ইলেকট্রনের স্রোত। ৮ নভেম্বর। ল্যাবরেটরির কাজকর্ম শেষ করে ঘরে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন রন্টজেন। টেবিলের ওপর ক্যাথোড টিউব ছিল। সেটাকে একটা কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দিলেন। তারপর নিভিয়ে দিলেন ঘরের বাতি। এখানে একটা কথা বলে রাখা জরুরি। ক্যাথোড টিউবের আশপাশে বেরিয়াম প্লাটিনোসায়ানাইডের প্রলেপ দেওয়া কাগজ রাখা ছিল। রন্টজেন ঘরের বাতি নিভিয়ে দিলেন, কিন্তু ক্যাথোড টিউবের সঙ্গে সংযুক্ত বিদ্যুৎ প্রবাহমাত্রা বন্ধ করেননি। হয়তো সুইচ অফ করতে ভুলে গিয়েছিলেন।
ঘরের লাইট অফ করার সঙ্গে সঙ্গে একটা আলোর ঝলক দেখতে পেলেন রন্টজেন। ঝলকটি দেখলেন বেরিয়াম প্লাটিনোসায়ানাইডের প্রলেপ দেওয়া কাগজের ওপর। থেমে গেলেন রন্টজেন। চমকেও উঠলেন। আবার ঘুরে এলেন। বারবার ক্যাথোড টিউবের সুইচ অফ ও অন করে দেখলেন, একই ঘটনা ঘটছে প্রতিবার।
এ ঘটনার ব্যাখ্যা কী? রন্টজেন নিশ্চিত জানেন, আলোর ঝলক ক্যাথোড টিউবের ভেতর থেকে আসছে না। টিউবের ওপর রাখা ক্যাথোড রশ্মির ক্ষমতা নেই কালো কাপড় ভেদ করে বেরিয়ে এসে বেরিয়াম প্লাটিনোসায়ানাইডের পর্দায় ঝলক তোলার। তাহলে এই নতুন ঝলক নিশ্চয়ই অন্য কিছু এবং সেটা আসছে ক্যাথোড নলের ভেতর থেকেই।
অনেক পরীক্ষা করে দেখলেন রন্টজেন। খুব বেশি কিছু জানতে পারলেন না সেই আলোক রশ্মি সম্পর্কে। শুধু জানতে পারলেন, বিদ্যুৎ প্রবাহমাত্রা বাড়ালেই সেই রশ্মির ভেদ করার ক্ষমতা বাড়ে। এমনকি পুরু দেয়াল পর্যন্ত ভেদ করে যেতে পারে।
ঘটনার পরই বৈজ্ঞানিক মহলে হইচই ফেললেন না রন্টজেন। কেউ হয়তো বিশ্বাসই করতে চাইবে না। তারপর নানাভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালালেন। ফল সেই একই। সিদ্ধান্ত নিলেন ব্যাপারটা স্ত্রীকে জানানোর। সেটাও নাটকীয়ভাবে। একদিন ল্যাবে ডেকে নিলেন স্ত্রী বার্থাকে। তত দিনে এক্স-রে ব্যবহার করে ছবি তোলার প্রক্রিয়া শিখে গেছেন। নিজের মতো করে বানিয়ে নিয়েছেন ফটোগ্রাফিক প্লেট।
রন্টজেন বার্থাকে বললেন হাতটা ফটোগ্রাফিক প্লেটের ওপর রাখতে। তারপর এক্স-রে নিক্ষেপ করলেন প্লেটের ওপর। ফটোগ্রাফিক প্লেটটা ডেভেলপ করে নিয়ে এলেন রন্টজেন। ধরলেন বার্থার চোখের সামনে। চমকে উঠলেন বার্থা, ভয় পেলেন এবং চিৎকার করে উঠলেন। সেটাই স্বাভাবিক। রন্টজেন বার্থার সুস্থ-সবল হাতের ছবি তুলেছিলেন; কিন্তু ছবিতে যে হাতের কঙ্কাল! প্রতিটা হাড়, হাড়ের জোড়া চেনা যাচ্ছে স্পষ্ট করে। বার্থার হাতে একটা আংটি ছিল। সেটাও খুব ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু হাতের মাংস, চামড়ার ছবি বেশ হালকা।
বার্থার হাতের সেই ছবি, সেটাই পৃথিবীর প্রথম এক্স-রে ফটোগ্রাফ। এরপর রন্টজেন সাজিয়ে-গুছিয়ে লেখা শুরু করলেন এক্স-রে নিয়ে বৈজ্ঞানিক এক প্রবন্ধ। সেই প্রবন্ধে জুড়ে দিলেন বার্থার হাতের এক্স-রের ছবি। ৮ নভেম্বর প্রথম এই বিকিরণের খোঁজ পান রন্টজেন। কিন্তু সে খবর বিজ্ঞান-দুনিয়াকে জানালেন ২৮ ডিসেম্বর। অবশ্য প্রবন্ধটা ছাপা হয় আরও পরে।
রন্টজেন সেই বিকিরণের নাম দিলেন এক্স-রে। কারণ, তিনি তখনো এই রশ্মি সম্পর্কে কিছুই জানতে পারেননি। প্রবন্ধটা ছাপা হওয়ার পর রাতারাতি বিখ্যাত বনে গেলেন রন্টজেন। সারা পৃথিবীতে তুমুল আলোড়ন তুলল এক্স-রে। আবিষ্কার পদার্থবিজ্ঞানের। কিন্তু সেটার সবচেয়ে বেশি ব্যবহার চিকিৎসাবিজ্ঞানে। সেই যুগ থেকে এই অত্যাধুনিক যুগেও এক্স-রে ছাড়া চিকিৎসাবিজ্ঞান প্রায় অন্ধ। মহান এই আবিষ্কারের যোগ্য সম্মানও পেয়েছিলেন রন্টজেন। ১৯০১ সালে রন্টজেনের হাতেই ওঠে পদার্থবিদ্যার প্রথম নোবেল পুরস্কারটি।