সবচেয়ে বড় মাছের নাম কী?
ঝটপট হাত তুলে যদি বলে ফেলো নীল তিমির নাম, তবে একটু পরেই তোমাকে বলতে হবে এই যা, ভুল হয়ে গেছে!
কারণ, নীল তিমি মোটেই সবচেয়ে বড় মাছ নয়! এটা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণী। সবচেয়ে বড় কথা, নীল তিমি আসলে কোনো মাছই নয়, সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী। সমুদ্রের নিচে থাকে বলে একে মাছ বলে ভুল করে অনেকেই। একটা মাছের যেসব বৈশিষ্ট্য থাকে, নীল তিমির ভেতর তার অনেক কিছুই অনুপস্থিত। মাছেরা সাধারণত শীতল রক্তবিশিষ্ট হয়, আর তিমিদের রক্ত উষ্ণ। ফুলকা দিয়ে নিশ্বাস নেয় মাছেরা, কিন্তু তিমির শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজ চলে ফুসফুসের মাধ্যমে। মাছেরা ডিম দেয় কিন্তু তিমি আস্ত বাচ্চা প্রসব করে, সেই বাচ্চা মা-তিমির দুধ খেয়ে, মায়ের যত্ন-আত্তি পেয়েই বিরাট সমুদ্রে রাজপুত্রের আদরে বড় হয়।
আক্ষরিক অর্থেই তারা বড় হয়।
পূর্ণবয়স্ক একটি নীল তিমি ৮২ থেকে ১০৫ ফুট পর্যন্ত বড় হতে পারে।
তিনটি বড় স্কুলবাস সারিবদ্ধভাবে রাখলে একটা নীল তিমির সমান হবে। একটা বাস্কেটবলের কোর্টের মাপ হয় ৯০ ফুট, সেই হিসাবে একটা নীল তিমি বাস্কেটবল কোর্টের ওপর রাখলে বাস্কেটবলের কোর্টটাই ঢাকা পড়ে যাবে সেটার নিচে। জন্মানোর সময় নীল তিমির বাচ্চার আকৃতি হয় প্রায় ২৫ ফুটের কাছাকাছি, যা গড় উচ্চতার চারটি মানুষের চেয়েও বেশি।
আকৃতির মতোই নীল তিমি পৃথিবীর সবচেয়ে ওজনদার প্রাণীও। একটা নীল তিমির ওজন ১৮১ মেট্রিক টন পর্যন্ত হতে পারে, অর্থাত্ ১৫টি পূর্ণবয়স্ক হাতি আর একটি নীল তিমি একটা পাল্লায় রাখলে তাদের ওজন সমান হবে। এক মেট্রিক টন হলো ১০০০ কেজির সমান। এখন তোমার ওজন মেপে দেখে নীল তিমির ওজন সম্পর্কে ধারণা করে দেখতে পারো যে সেটা আসলে কত বিশাল।
নীল তিমির জিবের ওজন যেমন একটা হাতির থেকে বেশি, তেমনি এদের হূিপণ্ডকে ওজন করলে একটা গাড়ির থেকে বেশি হবে। সদ্য জন্মানো নীল তিমির একটা বাচ্চার ওজনও একটা বয়স্ক হাতির থেকে বেশি হয়।
বিশাল এই দৈত্যের খাবারও দৈত্যাকার হওয়ার কথা, তবে তা কিন্তু হয়নি। এরা ক্রিল নামের ফ্যাকাশে গোলাপি রঙের একপ্রকার সামুদ্রিক পতঙ্গ খায়। এই পতঙ্গগুলো বড়জোর তোমার আঙুলের সমান বড় হয়ে থাকে। নীল তিমি দিনে চার টন ক্রিল খেতে পারে। তিন কোটি ক্রিল একসঙ্গে দাঁড়িপাল্লায় রেখে ওজন করলে তিমির এক দিনের খাবারের ওজনের সমান হবে।
নীল তিমির খাবার ধরনও বেশ অদ্ভুত। এদের কোনো দাঁত থাকে না। তার বদলে থাকে ব্যালিন, যা তিমির ওপরের চোয়াল থেকে নিচের দিকে ঝুলে থাকে ঝালরের মতো। এই ব্যালিনকে ছাঁকনিও বলা যায়। নীল তিমির গলার চামড়ায় প্রায় ৮৮টির মতো ভাঁজ থাকে, ক্রিল গেলার সময় হাঁ করলেই সব ভাঁজ খুলে যায় এবং মুখটা বিশাল বেলুনের মতো হয়ে যায়। হাঁ করে নীল তিমি লোনা পানিসহ একবারে হাজার হাজার ক্রিল মুখের ভেতর টেনে নেয়। তারপর সেই পানি ব্যালিনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত করে দেয়, যার ফলে ক্রিলগুলো ব্যালিনে আটকে যায় এবং পানি বেরিয়ে পড়ে। পানি বের হওয়ার পর ক্রিলগুলো একত্রে জমা হয় এবং তা গিলে ফেলে ভোজন সম্পন্ন করে নীল তিমি।
মজার ব্যাপার হলো নীল তিমি মোটেই নীল নয়, পানির নিচে থাকলে এটাকে দেখতে নীল মনে হয়। এটার আসল রং অনেকটা ফ্যাকাশে। তিমিরা সাধারণত ঘণ্টায় পাঁচ মাইল বেগে চলাচল করে, কিন্তু কখনো কখনো তাদের ছোটার গতি ২০ মাইলের কাছাকাছিও হয়। বাতাসে একবার শ্বাস নিয়ে নীল তিমি সর্বোচ্চ ৩০ মিনিট পানির নিচে থাকতে পারে। ৩০ মিনিটের ভেতরে তাই পানির নিচ থেকে ওপরে উঠে শ্বাস নিতে হয় নীল তিমিকে।
অনেকেই বলে তিমি গান গাইতে পারে, অনেকেই আবার ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে, হুহ যতসব গাঁজাখুরি প্রলাপ। তিমি গায়ক কি গায়ক না সে বিষয়ে তর্কে না জড়িয়ে তার চেয়ে চলো তিমির মুখের বুলির কথা শুনি। প্রাণীদের মধ্য তিমিই সব থেকে জোরে আওয়াজ করতে পারে। শুনতে দীর্ঘ লয়ে ‘মমমমমমমমমমমম’ ধরনের এই আওয়াজ সাধারণত নিজেদের ভেতর যোগাযোগ করে থাকে। যেখানে একটা জেট ইঞ্জিনের আওয়াজে ডেসিবলের মাত্রা থাকে ১৪০, সেখানে নীল তিমির আওয়াজের ডেসিবল হয় ১৮৮, যা কিনা প্রায় এক হাজার মাইল দূর থেকেও শোনা যায়। তিমির এই আওয়াজকেই অনেকে গান হিসেবে বিশেষায়িত করে থাকে।
প্রাগৈতিহাসিক দৈত্যাকার প্রাণী ডাইনোসরের থেকেও বড় এই নীল তিমি গড়ে ৮০ থেকে ৯০ বছর বেঁচে থাকে। সবচেয়ে বেশি দিন বেঁচে থাকা নীল তিমিটার বয়স ছিল ১১০ বছর। এরা সাধারণত তিন বছরে একবার একটা বাচ্চা প্রসব করে। প্রায় সব সাগরে একসময় নীল তিমি প্রচুর পরিমাণে দেখা গেলেও বসবাসের পরিবেশ নষ্ট এবং গণহারে শিকার হয়ে যাওয়ার ফলে দিন দিন নীল তিমির সংখ্যা একেবারেই নেই হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে সারা বছর সাগরে ঘুরলেও একটা নীল তিমির দেখা পাওয়া যাবে কি না, তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না।
আইন করে নীল তিমি শিকার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বহু আগেই। রাজকীয় এই প্রাণীটি যাতে আবার স্বমহিমায় ঝাঁকে ঝাঁকে সাগরে বিচরণ করতে পারে, সেই কামনাই রইল।
সূত্র: ন্যাটজিও কিডস