ওকি গাড়িয়াল ভাই...

সাপের মতো আঁকাবাঁকা গাঁয়ের পথ। শেষ বিকেলের মরে যাওয়া আলোয় ধুলো উড়িয়ে চলছে ছইওয়ালা একটা গরুর গাড়ি। সন্ধ্যার আগেই গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে। গাড়োয়ান বারবার তাগাদা দিচ্ছে বলদজোড়াকে, ‘হুররররর...হাঁট হাঁট’। ক্লান্তি তো মানুষের মতো গরুরও আছে। কাকভোর থেকে একটানা হেঁটে চলেছে গরু দুটি। একটু ঢিল দেওয়ার জো নেই, গতি কমালেই গাড়োয়ানের নির্দয় লাঠির শপাং শপাং বাড়ি পড়বে পিঠে। ছইয়ের ভেতরে শিশু ছেলেটাকে কোলে নিয়ে বসে আছে গাঁয়ের এক বধূ। চোখমুখে তার রাজ্যের উৎকন্ঠা, সময়মতো পৌঁছাতে পারবে তো? ছেলেটারও বিরক্তি এসে গেছে একঘেয়ে পথচলায়। মাঝেমধ্যেই কেঁদে উঠে বিরক্তি প্রকাশ করছে সে। তবু চলার যেন শেষ নেই। গাড়ির চাকায় কর্কশ শব্দ, যেন বিরামহীন পথচলায় সে প্রতিবাদ করছে। তবু থামবে না গাড়োয়ান। লোকমুখে তারাই গাড়িয়াল নামে পরিচিত। কখনো কোলাহলমুখর হাটের ভেতর দিয়ে, কখনো লোকালয়ের পাশ দিয়ে ধীরগতিতে এগিয়ে চলেছে সে। হাটের, গাঁয়ের লোকেরা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাদের গমনপথের দিকে। লাজুক বধূ চাদর টাঙিয়ে ছইয়ের ভেতরে আড়াল করেছে নিজের মুখ। বটতলায় খেলছে একদল ছেলেমেয়ে। ভিনগাঁয়ের গাড়ি তাদের ভারি আমোদ দেয়। ওরা ছড়া কাটে, ‘ভাঙা গাড়ি ভেঙে যা/ বউটা মোদের দিয়ে যা।’

গরু আর গাড়োয়ানদের সংগ্রামের জীবন তুলে ধরেছেন শিল্পাচার্য তাঁর ‘দ্য স্ট্রাগল’ ছবিতে

ছড়া শুনে লাজুক বধূ যেন আরও লজ্জা পায়। চোখ ঢাকে আঁচলে। দুষ্টু ছেলেমেয়ের দল তবু হাল ছাড়ে না। ছুটে এসে গাড়ির পেছন ধরে ঝুলতে থাকে। ঝুলতে ঝুলতে গাড়ির সওয়ারি হয় কিছুক্ষণের জন্য। গাড়িয়াল ভাই বিরক্ত। ‘তবে রে ব্যাটা’ বলে তেড়ে আসে। ধমক খেয়ে নেমে পড়ে দুষ্টু ছেলেমেয়ের দল। আবার পথচলা শুরু। সন্ধ্যার ম্লান আলোয় শেষ হয় সারা দিনের যাত্রা। বধূ তখন বাপের বাড়িতে পৌঁছে মহাখুশি। উৎকন্ঠা কাটে তার পথ চেয়ে থাকা স্বজনদেরও।...

এ গল্প খুব বেশি দিন আগের নয়। মাত্র ২৫ বছর আগেও বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে প্রধান বাহনই ছিল গরুর গাড়ি। এখনো আছে। কিন্তু গরুখোঁজা করেও সারা দেশের কোথাও ছইওয়ালা গরুর গাড়ি পাবে না। এখন এ ধরনের গাড়ি ব্যবহৃত হয় শুধুই মাঠ থেকে ফসল ঘরে তোলার কাজে।

গরুর গাড়ি বাঙালি ঐতিহ্যের অন্যতম প্রতীক। বাঙালি সভ্যতার শুরু থেকেই এ দেশে গরুর গাড়ির প্রচলন ছিল। এ উপমহাদেশে প্রথম মানবসভ্যতা গড়ে ওঠে সিন্ধু নদের তীরে। মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা সভ্যতা। সেখানে গরুর গাড়ির ব্যবহার ছিল বলে মনে করেন ঐতিহাসিকেরা। অবশ্য পৃথিবীতে গরুর গাড়ির সবচেয়ে প্রাচীন নমুনা পাওয়া যায় ফ্রান্সের আল্পস পর্বতমালার একটা গুহায়। সেখানকার দেয়ালচিত্রে গরুর গাড়ির ছবি আছে। ঐতিহাসিকদের ধারণা, এ দেয়ালচিত্র ব্রোঞ্জযুগে, মানে সেই খ্রিষ্টপূর্ব ৩১০০ বছর আগে আঁকা।

অজ্ঞাত শিল্পীর আঁকা গরুর গাড়ি ও গাড়োয়ান। ধারণা করা হয়, ছবিটি ১৮৭৪ সালে আঁকা

৫০০ বছর আগের ঘটনা। সম্রাট বাবর তখন উজবেকিস্তান ও আফগানিস্তানের বিরাট অঞ্চল দখল করে পা বাড়িয়েছেন ভারতবর্ষের দিকে। দিল্লির সম্রাট তখন ইব্রাহীম লোদী। ভারতবর্ষ আক্রমণের সাহস তখন বিশ্বের অনেক হাঁকডাকওয়ালা সম্রাটেরও ছিল না। কিন্তু ছোট্টবেলা থেকেই রাজ্যহারা, পথে পথে ঝটিকা আক্রমণ করে বেড়ানো বাবরের বহুদিনের স্বপ্ন ভারতবর্ষ দখল করার। ইরানের বাদশাহর সঙ্গে তাঁর ভারি ভাব। তিনিই বাবরকে দিয়েছিলেন পৃথিবীর প্রথম মারণাস্ত্র কামান। ইয়া বড় আর বিশাল ভারী কামানগুলো বহন করা হতো গরুর গাড়িতে। বাবর কামান নিয়ে হাজির হলেন সিন্ধু নদের তীরে। জায়গাটার নাম পানিপথ। নদীর অপর পাড়ে বিশাল সৈন্যবহর নিয়ে হাজির ইব্রাহিম লোদী। সেই বাহিনীর কাছে বাবরের বাহিনী একেবারে নস্যি। তখনই বাবরের গরুর গাড়ি থেকে গর্জে উঠল কামান। ঠিক লক্ষ্যভেদ। প্রথম আঘাতেই ধরাশায়ী ইব্রাহিম লোদী। কামান আর বলদে টানা গরুর গাড়ি দিয়ে মাত্র মিনিট বিশেকের যুদ্ধে বাবর ধুলোয় মিশিয়ে দিলেন বিশ্বের অন্যতম প্রতাপশালী সম্রাটের মসনদ। ষাঁড়ে টানা সেই কামানবাহী গাড়িগুলোই মধ্যযুগের যুদ্ধ ময়দানে আতঙ্ক সৃষ্টি করত প্রতিপক্ষ শিবিরে।

‘পার হয়ে যায় গরু পার হয় গাড়ি,/ দুই ধার উঁচু তার ঢালু তার পাড়ি।’

‘আমাদের ছোট নদী’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিন্তু গরুর গাড়ির কথাই বলেছিলেন। বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত কবিতা-উপন্যাসে অলংকরণ হয়ে আছে গরুর গাড়ি। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাসগুলোর একটি। বাংলাদেশের প্রকৃতি, গ্রামীণ সমাজ, মানুষের সুখ, দুঃখ, কষ্ট ইত্যাদি অত্যন্ত নিপুণভাবে এ উপন্যাসে বর্ণনা করা হয়েছে। বাদ যায়নি দেশের ঐতিহ্য গরুর গাড়িও। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র অপু। অভাবের পড়ে একসময় গ্রাম ছাড়তে হয় ওদের। হিরু গাড়োয়ানের গরুর গাড়িতে চেপে চলে যায় গ্রাম ছেড়ে। পেছনে পড়ে থাকে তাদের প্রিয় জন্মভূমি নিশ্চিন্দিপুর। গাড়িতে বসে দিগন্তের বুকে নিশ্চিন্দিপুরের হারিয়ে যাওয়ার যে ছবি এই উপন্যাসে আঁকা হয়েছে, বাঙালির হূদয় থেকে তা কোনো দিন মোছার নয়। আবার শরত্চন্দ্রের বিখ্যাত চরিত্র দেবদাসে মৃত্যুও হয় এক গরুর গাড়িতেই।

নাইয়র
শিল্পী: কামরুল হাসান

বাংলাদেশের রং-তুলির জগতেও অবহেলিত নয় এ গাড়ি। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের বিখ্যাত ছবি ‘দ্য স্ট্রাগল’-এর মূল বিষয় গরুর গাড়ি। গ্রামের মেঠো পথ পাকা নয়। তাই বর্ষাকালে বলদ বাবাজিরা প্রায়ই ভুল করে রাস্তায় কাদায় নেমে পড়ে। তখন গরু, গাড়ি ও গাড়োয়ান সবারই ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা। গাড়োয়ান তখন লোক ডেকে গাড়ির চাকায় ঠেলে কাদা থেকে গাড়ি তোলার চেষ্টা করেন। সেই ছবিই ফুটে উঠেছে ‘দ্য স্ট্রাগল’-এ। তবে ছবিটি শুধু নিছক গরুর গাড়ির ছবি নয়; এটি বাঙালির সংগ্রামী জীবনের প্রতিচ্ছবিও বটে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় আগুনঝরা সব পোস্টার এঁকে বাঙালিদের মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রেরণা জুগিয়েছিলেন পটুয়া কামরুল হাসান। আমাদের জাতীয় পতাকার নকশাও করেছিলেন তিনি। তিনিও এর ছবি এঁকেছিলেন। ছবিতে গাঁয়ের বধূ তার ছেলেকে নিয়ে নাইয়রে যাচ্ছে। ছবিটার নামও ‘নাইয়র’। ছবিটা পরে পাঁচ টাকা মূল্যমানের এক ডাকটিকিটেও ব্যবহার করা হয়।

বাংলাদেশের আরেক প্রবাদপ্রতিম শিল্পী এস এম সুলতানের দুটো ছবিতে এ গাড়ি দেখা দেখা যায়। একটার নাম ‘ফারমার’ আরেকটা ‘মেন ইন প্যাডি ফিল্ড’। কৃষকেরা একদিকে ধান কাটছেন, কোনো কোনো কৃষক আবার গরুর গাড়িতে বোঝাই করছেন ধান। বাংলার মাঠের এ এক চিরচেনা দৃশ্য।

এই গাড়ি ও গাড়োয়ান নিয়ে সিনেমা, নাটক আর গানও তৈরি হয়েছে একাধিক। ভাওয়াইয়া এ দেশের অন্যতম জনপ্রিয় লোকগান। এ গানের জন্মও হয়েছে গাড়োয়ানদের মুখে মুখে।

গরুর গাড়ি তৈরি হয় বাঁশ আর কাঠ দিয়ে। গাড়ির পুরো কাঠামো বাঁশের। চাকা আর এক্সেল তৈরি হয় বাবলা কাঠ দিয়ে। বাবলা কাঠ ভীষণ শক্ত। অনেক ওজন সইতে পারে। এর চাকা বেশ বড় হয়। চাকায় কোনো বল-বিয়ারিং থাকে না। কাঠের শক্ত কাঠি এক্সেলে ঢুকিয়ে চাকা ধরে রাখা হয়। গাড়ির সামনের দিকে বাঁশের তৈরি জোয়াল থাকে। জোয়াল গরুর ঘাড়ে আটকে দেওয়া হয়। গাড়োয়ান গরুকে তাগাদা দেয় হাঁটার জন্য। গরু হাঁটে, তার কাঁধের ধাক্কায় গাড়িও চলতে থাকে সামনের দিকে।

গ্রামীণ মেঠোপথে গরুর গাড়ির চিরচেনা দৃশ্য

ছই তৈরি হয় বাঁশ, পাটের চট, বেতের পাটি ইত্যাদি দিয়ে। ছইয়ে আলকাতরা মাখিয়ে চট কিংবা পাটির ছিদ্রগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে ছই মজবুত হয়। পানির হাত থেকেও বাঁচে গাড়ির যাত্রীরা। ছইয়ের মতো আরেকটা জিনিস ব্যবহার করা হয় এ গাড়িতে। একে বলে ধরাট। বাঁশের মাচা দিয়ে তৈরি এই ধরাট বসানো হয় গাড়ির দুই পাশে। মাঝখানে রাখা হয় আলু, কুমড়ো ইত্যাদি গড়িয়ে পড়ে যায় এমন ফসল। ধান, পাট, গম ইত্যাদি ফসলের জন্য ধরাটের দরকার হয় না। বাঁশ এবং দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিলেই ব্যস।

পৃথিবী দিন দিন আধুনিক হচ্ছে। বাস, ট্রাক আর অন্য মোটরচালিত যানবাহনের ছোঁয়া লেগেছে দেশের গ্রামগঞ্জেও। সেই ধারাবাহিকতায় হারিয়ে গেছে ছই। গরুর গাড়িও হয়তো বছর দশেক পর আর দেখা যাবে না কোথাও। আশ্রয় নেবে মহাকালের গহিনে, ইতিহাসের পাতায় কিংবা তোমাদের পাঠ্যবইয়ের পাতায়।