একিলিসের গোড়ালি

অনেককাল আগের কথা। গ্রিস দেশে তখন অনেক শহর ছিল। প্রতিটি শহরেই ছিল উঁচু উঁচু দালানকোঠা, পাকা রাস্তা, মন্দির আরও কত কী! একেকটা শহর ছিল আলাদা রাষ্ট্র। তাদের ছিল আলাদা সৈন্যদল, আলাদা রাজা, আলাদা সরকার। সেই গ্রিসে মিরমিডনের রাজার নাম ছিল পেলেউস। তার ঘরে ফুটফুটে এক ছেলের জন্ম হলো। পেলেউস ছেলের নাম দিলেন একিলিস। অবশ্য আকিলিস, এখিলিস এসব নামেও পরিচিত তিনি। যাক সে কথা, একিলিসের মা অর্থাৎ পেলেউসের স্ত্রী থেটিস কিন্তু সাধারণ কেউ ছিলেন না। তিনি ছিলেন সাগরদেবতা নেরেউসের মেয়ে। তা ছাড়া নিজেও ছিলেন পঞ্চাশ সাগরপরির একজন। একিলিসের জন্মের পর সাগরপরিরা ভবিষ্যদ্বাণী করল, ভাবীকালে ভয়ংকর এক যুদ্ধ হবে। সেই যুদ্ধে মারা যাবে এই ছেলে। এ কথা শুনে কেঁদে উঠল মায়ের মন। মা কি কখনো সন্তান হারাতে চান? মা ভাবতে লাগলেন কী করে রক্ষা করা যায় ছেলের জীবন। ভেবে ভেবে শেষ পর্যন্ত ঠিক করলেন, ছেলেকে তিনি স্টিক্স নদীতে স্নান করিয়ে আনবেন। এখন কথা হলো, এই নদীটা কোথায়? হ্যাঁ, বলছি সে কথা। এটাও কিন্তু সাধারণ কোনো নদী নয়। তা ছাড়া এটা এই পৃথিবী অর্থাৎ মর্ত্যের কোনো নদীও নয়। পাতাল আর মর্ত্যের মাঝামাঝি বয়ে যাওয়া নদী এটা। এই নদীর যিনি রক্ষক, তিনি এ নদীর এক পাড় থেকে অন্য পাড়ে পার করে দিতেন আত্মাদের। তা ছাড়া নদীর জলের ছিল এক আশ্চর্য ক্ষমতা। নদীর জলে জীবিত কারও দেহের কোনো অংশ চুবালে অমরত্ব লাভ করে ওই অংশটা। থেটিস তাঁর ছেলে একিলিসকে নিয়ে গেলেন সেই নদীর ধারে। তারপর পায়ের গোড়ালি ধরে ছেলেকে চুবিয়ে আনলেন নদী থেকে। মা খুশি হলেন এই ভেবে যে ছেলেকে তিনি পাতালনদীতে স্নান করিয়ে অমর করে আনতে পেরেছেন।

একিলিসের যুদ্ধযাত্রা
একিলিসের যুদ্ধযাত্রা

মা থেটিসের ধারণা মোটামুটি ঠিকই ছিল। একটু শুধু ছোট্ট খুঁত থেকে গিয়েছিল। ব্যাপারটা মা বুঝতে পারেননি। আসলে পায়ের গোড়ালি ধরে চুবানোর সময় মায়ের হাতে ধরে থাকা ওই অংশটুকু ছাড়া শরীরের সব অংশেই লেগেছিল নদীর জল। ফলে পুরো দেহ অমরত্ব লাভ করলেও পায়ের গোড়ালিটা ছিল নশ্বর।
বড় হয়ে একিলিস হলেন মস্ত বড় বীর। ট্রয়ের যুদ্ধে তিনি সেই বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। সেই যুদ্ধের ঘটনা নিয়ে রচিত হয়েছিল মহাকাব্য ইলিয়াড। এই মহাকাব্যের শুরুটাই কিন্তু হয়েছিল একিলিসকে নিয়ে। ইলিয়াড–এর প্রথম দুটো পঙ্‌ক্তি:
গাও, দেবী পেলিউস-পুত্র একিলিসের দুর্বার ক্রোধের গাথা
যে অভিশপ্ত ক্রোধ সহস্রাধিক একিয়ানের দুঃখের কারণ হয়।
ট্রয়ের যুদ্ধটা হয়েছিল গ্রিসের নগররাষ্ট্র স্পার্টার রানি হেলেনকে উদ্ধাররের জন্য। ট্রয়ও ছিল একটা নগররাষ্ট্র, তবে সেটা ছিল সাগরের বিপরীত পারের আনাতোলিয়া বা এশিয়া মাইনরে অর্থাৎ বর্তমান তুরস্কে। গ্রিসের নগররাষ্ট্রগুলো একজোট হয়ে ট্রয়ের বিরুদ্ধে করেছিল এই যুদ্ধ। তো, গ্রিসের সেনাদল যুদ্ধযাত্রা করল। পথে পড়ল মাইসিয়া রাজ্য। এই রাজ্যের রাজা টেলিফাস সেনাদলকে বাধা দিলেন। ফলে যুদ্ধ হলো। যুদ্ধে একিলিসের হাতে আহত হলেন টেলিফাস। শেষমেশ একিলিসই তাঁকে সারিয়ে তুললেন। তবে একটা শর্ত ছিল একিলিসের। সেই শর্ত অনুযায়ী গ্রিক সেনাদলকে ট্রয়যাত্রার পথপ্রদর্শন করলেন টেলিফাস। তবে যাত্রাপথ ছিল বিপদে ভরা।
সাগর পাড়ি দেওয়া ছাড়া গ্রিস থেকে আনাতোলিয়ায় যাওয়া তো আর সম্ভব নয়। তাই গ্রিকদের জাহাজ ভাসল সাগরে। কিন্তু দেবতারা রেগে গেলেন গ্রিকদের ওপর। আর দেবতাদের রোষানলে পড়ে সাগরে জাহাজ আর এগোতে পারল না। মহাসংকটে পড়ল গ্রিকরা। শেষ পর্যন্ত নিজের সন্তানকে দেবতাদের হাতে তুলে দিয়ে নিষ্কৃতি পেলেন সেনাপতি আগামেমনন। এভাবে একে একে অনেক বাধাই এল। তবে সব বাধা অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত ট্রয়ের কাছে এসে পৌঁছালেন তাঁরা।
ট্রয় শহরটা ছিল আশপাশের জায়গা থেকে উঁচুতে, টিলার ওপর। পাথরের উঁচু পাঁচিলঘেরা ছিল সেই শহর। শহরে ঢোকার প্রধান একটা ফটক ছিল। ট্রয়ের লোকেরা যখন দেখল, এত বড় সৈন্যদলের সঙ্গে তারা কুলিয়ে উঠতে পারবে না, তখন ভেতরে ঢুকে ফটকে খিল আটকে দিল তারা। গ্রিকরা তাদের অবরোধ করে রাখল। তারপরও মাঝেমধ্যে চলতে লাগল দুই পক্ষের যুদ্ধ। এর মধ্যেই একদিন একিলিসের একজন দাসকে জবরদস্তি করে নিজের কাজে নিয়ে গেলেন আগামেমনন। এ ঘটনায় একিলিস রেগে গিয়ে ঠিক করলেন তিনি আর যুদ্ধই করবেন না। তাঁকে যারা বেশি পছন্দ করত সেসব গ্রিক যোদ্ধাও ঠিক করল যুদ্ধে অংশ নেবে না তারাও। ফটকের ভেতরেও পৌঁছে গেল এ খবর। ট্রয়বাসীর মধ্যে বয়ে গেল আনন্দের বন্যা। তারা ঠিক করল দুর্বলতার সুযোগে গ্রিকদের ওপর অতর্কিত হামলা করবে এবার। ঠিকই সুযোগমতো শহর থেকে বেরিয়ে এসে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল গ্রিকদের ওপর। হঠাৎ হামলার এই ধকল সহ্য করতে পারল না গ্রিক সেনারা। তারা হারতে শুরু করল যুদ্ধে। এ অবস্থা দেখে একিলিসের এক বন্ধু পেট্রোক্লাস ট্রয়বাসীকে ঠেকিয়ে দেওয়ার জন্য বুদ্ধি বের করলেন। তিনি একিলিসের যুদ্ধসাজ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ট্রয়বাহিনীর বিরুদ্ধে। একে তো পেট্রোক্লাস বীর যোদ্ধা ছিলেন, তার ওপর শত্রুপক্ষ মনে করল, একিলিস নিজেই ফিরে এসেছেন যুদ্ধে। তাই পিছু হটতে শুরু করল তারা। পেছাতে পেছাতে তারা ঢুকেই গেল শহরের ভেতরে। তারপর বন্ধ করে দিল ফটক। এ যুদ্ধে গ্রিকরা জিতল বটে, কিন্তু পেট্রোক্লাস আর ফিরলেন না। বীরের মৃত্যু হলো যুদ্ধক্ষেত্রে।

পেট্রোক্লাসের মৃত্যুতে খুব দুঃখ পেলেন একিলিস। সব মান-অভিমান ভুলে আবার তিনি তৈরি হলেন যুদ্ধের জন্য। বর্ম-শিরস্ত্রাণ পরে ঢাল-তলোয়ার বর্শায় সজ্জিত হয়ে বিশাল সেনাদল নিয়ে এগিয়ে গেলেন শত্রুবাহিনীর দিকে। তার বর্মটা ছিল দেবতাদের দেওয়া। ফলে ওই বর্মেরও বিশেষ মাহাত্ম্য ছিল।
এ পরিস্থিতিতে মহাবীর একিলিসকে প্রতিহত করতে এগিয়ে এলেন হেক্টর। তিনিও কম ছিলেন না। তিনি ছিলেন ট্রয়বাসীর মধ্যে সবচেয়ে বড় বীর। দেব–দেবীদের সঙ্গে তাঁরও সম্পর্ক ছিল। যুদ্ধে তাঁকে সাহায্যের ভরসা দিলেন দেবী অ্যাথেনা। যুদ্ধক্ষেত্রে মুখোমুখি হয়েই হেক্টরের দিকে বর্শা ছুড়ে মারলেন একিলিস। আক্রমণটা ছিল নিখুঁত। প্রায় মারাই পড়েছিলেন হেক্টর। শুধু একটু বুদ্ধি খাটিয়ে মাথাটা নিচু করেছিলেন বলে রক্ষা! এবার হেক্টর ছুড়লেন বর্শা। আর সেটা এসে লাগল একিলিসের বর্মে। সেই বর্মটা যে সে বর্ম ছিল না। কারণ সেটা বানিয়েছিলেন দেব-কর্মকার হেফেস্তুস। ফলে এ আক্রমণে কিছুই হলো না একিলিসের। উপরন্তু তিনি হেক্টরের দিকে এমন একটা বর্শা ছুড়ে মারলেন, যা তাঁকে দিয়েছিলেন দেবী অ্যাথেনা। এই মহাবিপদের সময় তাঁর ভাইকে ডাকলেন হেক্টর। ভেবেছিলেন ভাই তাঁর কাছেই আছেন। কিন্তু বিধি বাম। তাই কারও সাহায্যই তিনি পেলেন না। এবার একিলিস বর্শা হাতে ধেয়ে এলেন তাঁর দিকে। আঘাতও করলেন অব্যর্থভাবে। সে আঘাতেই মৃত্যু হলো হেক্টরের। হেক্টরের মৃতদেহ পুরো ময়দানে টেনে নিয়ে বেড়ালেন একিলিস। এতে ট্রয়বাসী এবং হেক্টরের আত্মীয়স্বজনের মন ভেঙে পড়ল। ট্রয় শিবিরে উঠল মাতম। তবে হেক্টরের ভাই প্যারিস একটা বর্শা মেরেছিলেন একিলিসের উদ্দেশে। সেটা গিয়ে লেগেছিল একিলিসের ওই দুর্বল জায়গাটায়, অর্থাৎ গোড়ালিতে। ফলে তাঁর জীবনের যবনিকা নেমে এল তখনই।

গ্রিক পুরাণের এই কাহিনিটির একাধিক বর্ণনায় কিছু কিছু পার্থক্য রয়েছে এবং সব বর্ণনায় একিলিসের দুর্বল গোড়ালির কথা নেই। তারপরও এই কাহিনিটি সবাই জানে। ‘একিলিস হিল’ বা ‘একিলিসের গোড়ালি’ কথাগুলো এখন প্রবাদবাক্যের মর্যাদা পেয়েছে। এই কথাটার দ্বারা এখন দুর্বলতার আসল জায়গার কথা বোঝানো হয়।

একিলিসের কাহিনির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি শিক্ষাও আছে। তা হলো নিজের দুর্বলতার কথা নিজেকে সব সময় মনে রাখা উচিত। এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত। আর সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গাটাতেই সবচেয়ে বড় দুর্বলতাটা লুকিয়ে থাকতে পারে।