ধরা যাক, গাড়ি থেকে নামার সময় বিল গেটসের হাত থেকে হঠাত্ পড়ে গেল এক হাজার ডলারের একটা নোট। ডলারটা তুলে আবার পকেটে ভরতে ৩০ সেকেন্ডের মতো সময় লাগারই কথা। বিল গেটস সম্ভবত এক হাজার ডলারের নোটটি তুলতে সেই সময়টি দিতে চাইবেন না। কারণ, তিনি জানেন, এই ৩০ সেকেন্ডে যা আয় করবেন, সে তুলনায় এক হাজার ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৮০ হাজার টাকা) সামান্য অর্থ। অর্থাত্ নিচে পড়ে যাওয়া এক হাজার ডলারের নোট তুলতে যতটা সময় লাগবে, তার চেয়ে বেশি আয় করতে পারবেন একই সময়ে।
হিসাবটা কিন্তু খুব গোলমেলে, তাই না? ধরা যাক, বিল গেটস প্রতিদিন ১৪ ঘণ্টা কাজ করেন। ১৯৭৫ সালে মাইক্রোসফট প্রতিষ্ঠার পর থেকে যত সম্পদ আয় করেছেন, তা সেকেন্ডে যদি ভাগ করি তাহলে দেখা যাচ্ছে, তিনি প্রতি সেকেন্ডে আয় করেন তিন হাজার ডলার। সুতরাং মাত্র এক হাজার ডলারের নোট তুলতে কেনই-বা বিল গেটস ৩০ সেকেন্ড ব্যয় করবেন?
বিল গেটসের মতোই আয় করেন—এ রকম অসংখ্য মানুষ আছেন এই বিশ্বে। তাঁদের মধ্য থেকে মাত্র ৬২ জনকে বেছে নিয়ে অবাক করা এত তথ্য পাওয়া গেছে। বলা হচ্ছে, এই ৬২ জনের যে সম্পদ, তা বিশ্বের ৩৬০ কোটি মানুষের মোট সম্পদের সমান। ৩৬০ কোটি মানুষ হচ্ছে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক। অঙ্কের ভাষায় ৬২ জনের মোট সম্পদ = ৩৬০ কোটি মানুষের সম্পদ।
ওই ৩৬০ কোটি মানুষ কারা? একটু চোখ খোলা রাখলেই আমাদের আশপাশে তাদের দেখতে পাব। কারণ, সবাই জানি, পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি দরিদ্র মানুষ বাস করে দক্ষিণ এশিয়ায়।
আর ওই ৬২ জন কারা? তালিকার সবার ওপরে অবশ্যই বিল গেটস। তাঁর সম্পদ হচ্ছে ৭৬ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। তালিকায় আরও আছে স্পেনের আমানকায়ো ওর্তেগা, তাঁর সম্পদ ৬৭ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। আমরা অনেকেই পোশাক বিক্রির প্রতিষ্ঠান জারার নাম জানি। ওর্তেগার তারই মালিক। এরপরের নামটি হচ্ছে বিনিয়োগগুরু ওয়ারেন বাফেট। তাঁর সম্পদের পরিমাণ ৫৯ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। তোমাদের সবার পছন্দের ফেসবুকের সহপ্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গও ৬২ জনের তালিকায় আছেন। তাঁর সম্পদ ৪১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। আছেন গুগলের সহ-উদ্যোক্তা ল্যারি পেজ। মার্স চকলেট নিশ্চয়ই অনেকে পছন্দ করো। মার্স চকলেট কারখানাটি যাঁর, সেই জন মার্সও কিন্তু এই তালিকায়। চকলেট বিক্রি করেই আয় করেছেন ২৩ বিলিয়ন ডলার। তোমরা তো জানোই, এক বিলিয়ন মানে হলো ১০০ কোটি।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, তালিকায় কিন্তু ভারতীয়রাও আছেন। যেমন মুকেশ আম্বানি। রিলায়েন্স গ্রুপের এই আম্বানি ভাইয়ের মোট সম্পদ ২২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। আর তালিকায় থাকা আরেক ভারতীয় আজিম প্রেমজির সম্পদ ১৬ বিলিয়ন ডলার। তালিকায় থাকা তৃতীয় ভারতীয় দিলীপ সাঙ্গভির ওষুধ কোম্পানি সান ফার্মার মালিক। তাঁর সম্পদ ১৫ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। এই ৬২ জন নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট করে, অনেক সংগ্রাম করে এই বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছেন। তাঁদের কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছুই শেখার আছে। কিন্তু এর উল্টো পিঠটাও আমাদের দেখতে হবে। যেমন আমরা দেখতে পাচ্ছি যাঁরা ধনী, তাঁদের সম্পদ বাড়ছেই। কিন্তু যাঁরা গরিব, তাঁদের বাড়ছে না, বরং কমছে। যেমন অক্সফাম নামের একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা বলেছে, ২০১০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে বিশ্বের দরিদ্র ৫০ শতাংশ মানুষের সম্পদ কমেছে ৪১ শতাংশ। আবার একই সময়ে ৬২ জন ধনীর সম্পদ বেড়েছে ৫০ হাজার কোটি ডলার। প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বের ৯৯ শতাংশ মানুষের যে সম্পদ রয়েছে, তার চেয়ে বেশি সম্পদ আছে শীর্ষ ১ শতাংশ ধনীর হাতে।
তারাপদ রায়ের ‘দারিদ্র্য রেখা’ নামে খুব বিখ্যাত একটা কবিতা আছে। সেটা এক ফাঁকে পড়ে ফেলতে পারো। শুরুটা এ রকম: ‘আমি নিতান্ত গরিব ছিলাম, খুবই গরিব/ আমার ক্ষুধার অন্ন ছিল না/ আমার লজ্জা নিবারণের কাপড় ছিল না/ আমার মাথার ওপরে আচ্ছাদন ছিল না/ অসীম দয়ার শরীর আপনার,/ আপনি এসে আমাকে বললেন,/ না, গরিব কথাটা খুব খারাপ,/ ওতে মানুষের মর্যাদাহানি হয়/ তুমি আসলে দরিদ্র।’
আসলে এত কথার অর্থ হচ্ছে, সারা বিশ্বেই আয়বৈষম্য বাড়ছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। যেমন সরকারি হিসাবেই ২০১০ সালে আয়ের সর্বনিম্ন অবস্থানে থাকা ৫ শতাংশ দরিদ্র মানুষের অংশীদারত্ব ছিল মাত্র দশমিক ৭৮ শতাংশ। অথচ সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ ধনীর জাতীয় আয়ের অংশীদারত্ব ২৪ দশমিক ৬১ শতাংশ।
এমনিতে আয়ের বৈষম্য মাপার কিছু পদ্ধতি আছে। এর একটা হলো জিনি সহগ। ১৯১২ সালে ইতালির সংখ্যাতত্ত্ববিদ কোরাডো জিনি এর উদ্ভাবক। এই সূচকের মান শূন্য থেকে এক পর্যন্ত হতে পারে। সবার আয় সমান হলে জিনি সূচক হবে শূন্য। এর অর্থ হলো, চরম সাম্য অবস্থা বিরাজ করছে। এটি অবশ্য কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর সব আয় একজনের হাতে গেলে সূচকটি হবে ১।
এটি আবার চরম অসাম্য অবস্থা। এই দুই সীমার মধ্যে সূচক যত বাড়ে, অসাম্য তত বেশি।
আয়ের সাম্য তাহলে কীভাবে আনা হবে? যা আয় হবে তা ভাগ করে? নিশ্চয়ই নয়। আমাদের যা দরকার তা হচ্ছে সুযোগের সাম্য। শিক্ষায় যদি সবাইকে সমান সুযোগ দেওয়া যায়, স্বাস্থ্যসেবায় যদি তা দেওয়া যায়, তাহলে কিন্তু অনেক সমস্যার সমাধান হবে। তাহলে প্রত্যেকেই লেখাপড়ার সুযোগ পাবে, সবাই স্বাস্থ্যসেবা পাবে। গ্রাম ও শহরের মধ্যে এসব ক্ষেত্রে যে ব্যবধান, তাও কমাতে হবে। তারপর যদি তাদের কাজের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া যায়, তাহলে প্রত্যেকে কাজ করে আয় বাড়াতে পারবে। এতেই বৈষম্য কমবে। তোমরা সবাই সমান সুযোগ পাবে—এটাই তো সবার প্রত্যাশা।