সময়টা ধরো নব্বই দশক। গ্রামের একটা হাফপ্যান্ট পরা বাচ্চা ছেলে। উদোম গায়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছে!
দৌড়াবে না কেন? সমানে যে আইসক্রিমওয়ালার কাঠের বাক্সের ঠকাস ঠকাস বাড়ি শোনা যাচ্ছে! এর চেয়েও বেশি জোরে জোরে শব্দ হচ্ছে বোধ হয় বাচ্চাটার হৃদপিণ্ডে! আইসক্রিমওয়ালা এসেছে আজ। কী সৌভাগ্য!
ঘর থেকে বের হয়ে গাছে উঠে আম পাড়তে গিয়ে বা ডাংগুলি খেলতে খেলতেই আইসক্রিমওয়ালার দেখা পাওয়া যাবে, ব্যাপারটা এমন না! কালেভদ্রে তার খোঁজ পাওয়া যায়। হাটের দিনে বা কোনো মেলায় বা এই রকম আজকের দিনের মতো হুট করে। দেখা পেলেই যে আইসক্রিম খাওয়ার ধুম পড়ে যাবে তা-ও না, ওই সময় আব্বার পকেটে টাকা থাকতে হবে। তার চেয়েও বড় কথা আব্বার মেজাজ-মর্জি ঠিক থাকতে হবে!
আইসক্রিম দেন একটা।
কোনডা খাইবা?
ছোট্ট কাঠের বাকসো হলেও তার আইটেম কিন্তু একটা না! কাজেই কোন আইটেম বাচ্চাটার পছন্দ, এইটুকু জিজ্ঞেস করার বিলাসিতা সে করতেই পারে!
আইটেম কী কী, কোনটার দাম কত সেটা এই বয়সী সব বাচ্চাদের মুখস্থ! আট আনার আইসক্রিম আছে দুই রকম। একটা মিষ্টি স্বাদের, রং হলো বরফের মতো। গরমের দিনে তৃষ্ণা মেটানোর জন্য এক নম্বরের কাজের জিনিস। আরেকটার রং হলো সবুজ, দূর্বা ঘাসের রং। এই আইসক্রিমটা নোনতা। স্বাদ বাড়ানোর জন্য আইসক্রিমওয়ালা বাড়তি নুনের জোগান দেয়। বাচ্চারা আইসক্রিমওয়ালার কাছ থেকে যখন হাতের তালুতে নুন গুঁজে গম্ভীর মুখে লবণ ছিটানো আইসক্রিম খেয়ে যায়, মুখ-জিব তখন সবুজে সবুজে একাকার। এত দিন এসব আইসক্রিমের দাম চার আনা ছিল, এই কিছুদিন আগে ডাবল হয়েছে!
আজকে আব্বার যেন কী হয়েছে। চাইতেই পকেট থেকে দুই টাকা বের করে দিয়ে দিয়েছেন! কাজেই আট আনার আইসক্রিম-টাইসক্রিমের দিকে প্রথমেই না ঘেঁষে ছেলেটা অর্ডার দিল এক টাকার আইসক্রিমের! নারকেলের আইসক্রিম। নাহ্, ভুল বলা হলো। আসলে স্বপ্নের একটা আইসক্রিম! খুব ভালো করেই ছেলেটা জানে, প্রথমেই একটা শাঁসালো কামড় দিতে হবে আইসক্রিমের গোড়ার দিকে। নারকেল জমে ওই জায়গাটা ভারী হয়ে থাকে। একটু গলে যাওয়া শুরু হলেই ওই জায়গাটা সবার আগে থুব করে মাটিতে পড়ে যায়। কাজেই সাবধানের মার নেই। নারকেল না হলে কলা, সুখের কোনো তারতম্য হয় না!
গ্রামের ছেলেটার আইসক্রিম-জীবনে রেনেসাঁ যুগের প্রবর্তন ঘটল ঢাকা শহর আসার পর। আরও নির্দিষ্ট করে বললে রেনেসাঁ ঘটিয়ে দিল ঢাকা শহরের পাইপ আইসক্রিম! সাদা-কমলা-সবুজ কত রঙের আইসক্রিম ভরা পাইপ! বিকেলবেলা পাড়ার মাঠে খেলতে যাওয়ার সময় তার যেকোনো একটা না খেলে মনে হয় জীবনটাই বৃথা! তত দিনে অবশ্য আশপাশে সদ্য গোঁফ ওঠা সঙ্গী গজিয়ে গেছে! তাদেরই কেউ কেউ মুখ বেঁকিয়ে বলত, ‘খাইস না, ওতে চিনি নাই, স্যাকারিন দিয়ে ভরা!’ ছেলেটা বুঝে উঠতে পারে না—চিনির বদলে স্যাকারিন থাকলে সমস্যা কী? বাসায় তো ঠিকই দেখা যায়, দাদিকে পরম যত্নে স্যাকারিন দিয়ে চা দেওয়া হচ্ছে! কাজেই ওসব কথায় কান না দিয়ে মনের সুখে চলত আইসক্রিম চর্চা।
মাঝেমধ্যে আব্বার সঙ্গে কুষ্টিয়া-যশোর অঞ্চলে গেলে দেখা মিলত আরেক বিস্ময়ের। কুলফি মালাই! ছোট্ট একটা ড্রাম নিয়ে ফেরিওয়ালা ঘোরেন। কুলফির কথা বললেই ছোট্ট ছোট্ট কৌটার ভেতর থেকে কুলফি বের করে কলাপাতায় খেতে দেন। চেটেপুটে আইসক্রিম শেষ করে পারলে ওই কলাপাতাই চিবানো শুরু করত ছেলেটা! অবস্থা বেগতিক দেখে বাবা আরেকটা কিনে দিতেন। মনের সুখে ছেলেটার এভাবেই দিন কাটত।
এই ছেলেটার জীবনে আইসক্রিম না হয় এভাবেই এল, কিন্তু মানবসভ্যতায় আইসক্রিমের আগমনও কি এ রকম আইসক্রিমওয়ালার কাঠের বাক্সের শব্দে? আদিম মানুষের বাচ্চারাও কি দৌড়াতে দৌড়াতে ছুটত নারকেলি-আইসক্রিম খাওয়ার জন্য? তাদের বন্ধুরাও কি ভয় দেখাত, পাইপ আইসক্রিমে ভেজাল চিনির? উঁহু! প্রাচীনকালে আইসক্রিম আসলে বাচ্চাদের কোনো খাবারই ছিল না। এটা ছিল শুধু রাজরাজড়াদের খাবার! এই রেসিপি গোপন রাখা হতো, যাতে অন্যরা কেউ টের পেয়ে না যায়!
কেমন ছিল সেই আইসক্রিম? অবশ্য তাকে ‘আইসক্রিম’ বলা যায় কি না, সেটাও চিন্তার ব্যাপার! সবচেয়ে প্রাচীন আইসক্রিমের উল্লেখ পাওয়া যায় খ্রিষ্টের জন্মের পাঁচ শ বছর আগে গ্রিক সাম্রাজ্যে। তারা ফুলের মধুর সঙ্গে ফল আর বরফ মিশিয়ে খেত। ইতিহাসখ্যাত গ্রিক মহাবীর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের নাকি বরফ মেশানো ফুলের মধু পেলে আর কিছু লাগত না!
তবে খ্রিষ্টের জন্মের চার শ বছর আগে পারস্য সাম্রাজ্যের খাবারটাকে কিন্তু আমাদের চেনা চেনাই মনে হবে। ওখানে পাওয়া যেত গোলাপ জল আর সেমাইয়ের মতোন একটা জিনিস—বরফে ঠান্ডা করা! তাতে ফল থাকত, জাফরান থাকত। ফালুদার খালাতো ভাই মনে হয় না?
চীনাদের আইসক্রিম খাওয়ার উল্লেখ পাওয়া যায় খ্রিষ্টের জন্মের দুই শ বছর আগে থেকে। মোঙ্গলদের দেখাদেখি তারা এতে আখের রস মেশায়! ও ভালো কথা, মোঙ্গল দুর্ধর্ষ সেনাপতি কুবলাই খানের কিন্তু আইসক্রিম না হলে চলতই না! ধারণা করা হয়, আইসক্রিমের সূত্রপাত এসব রেসিপি থেকেই।
ইতিহাসের কথাই যখন হচ্ছে, ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম চার্লসের একটা মজার কথা বলি। সপ্তদশ শতকের এই রাজার টেবিলে দেখা যেত ক্রিম আইস নামের একটা খাবার। রাজা এতই পছন্দ করতেন এই জিনিস যে বাবুর্চিকে সারা জীবনের জন্য পেনশন দিয়ে রেখেছিলেন। শর্ত একটাই—এই গোপন রেসিপি যেন পাঁচ কান না হয়। খালি পাঁচ কান? বাবুর্চি ডি মার্কো চুপিচুপি সারা বিশ্বকেই এই রেসিপি জানিয়ে দিতে কসুর করেননি! ধন্যবাদ মার্কো!
তার মানে কিন্তু এই না যে মার্কোর রেসিপিতেই দুনিয়া পড়ে রয়েছে! আইসক্রিমের শত শত জাত-বেজাতের রেসিপি এখন বিশ্বজুড়ে। কেউ বলেন এক হাজার। কেউ বলেন আরও বেশি! সবচেয়ে জনপ্রিয় অবশ্য দেখতে একেবারে ‘সাদামাটা’ ভ্যানিলাই! চকলেট, আমন্ড, স্ট্রবেরি—এসব ফ্লেভারও বেশ জনপ্রিয়। জাপানে অন্যতম প্রচলিত একটা ফ্লেভার হলো গরুর মাংসের স্বাদের আইসক্রিম! গরুর মাংসের দাম যদি আকাশে গিয়ে ঠেকে, ওই ফ্লেভারের আইসক্রিম খেয়ে তারা সান্ত্বনা পেতে পারে!
ভারতের মার্কামারা অনেক আইসক্রিমই আছে। কুলফি তো উপমহাদেশেরই খাবার। মোগল বাদশাহরা খেতেন। তারপর ওদের আমের আইসক্রিম রয়েছে। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পাকা আম পরিবেশন করা হবে। তুমি খোসা ছাড়িয়ে আম খাবে, ভেতরে আঁটির জায়গায় আবিষ্কার করবে আইসক্রিম! এমনকি পশ্চিম বাংলার খাবার হিসেবেও বলা যায় নলেন গুড়ের আইসক্রিম! আমাদের বাংলাদেশের একেবারে একটা নিজস্ব ফ্লেভার হবে কবে? হলেও বা কেমন হবে? খেজুরের রসের ফ্লেভার? নাকি ইলিশ মাছের সরষে বাটার ফ্লেভার? হাসার কী আছে, গরুর মাংস থাকতে পারলে ইলিশ মাছ আর দোষ করল কী?
সবচেয়ে বেশি আইসক্রিম খায় কারা? আমেরিকানরা। হিসাব করে দেখা গেছে, বছরে ওদের একেক জন ২৬ লিটার করে আইসক্রিম খেয়ে ফেলে। কী অন্যায়, তাই না? ওদের আম্মু বকা দেয় না? আব্বু টনসিলের ভয় দেখায় না? বারণ করবে কী, ওরা সবাই মিলেই তো হাপুসহুপুস করে খায়! এমনকি আইসক্রিম খাওয়ার জাতীয় মাসও আছে একটা ওদের—জুলাই মাস! ওদের একটা আইসক্রিমের মিউজিয়ামও আছে নিউইয়র্কে! ওখানে পাওয়া যায় ইতিহাসের নানান রকম আইসক্রিম। যে চকলেট দিয়ে আইসক্রিম বানানো হয়, তার একটা সুইমিংপুল! চাইলে তাতে গা ডুবিয়েও থাকা যায়! আছে চকলেটের ঝরনা, আইসক্রিম নিয়ে ফিল্ম। আর যত খুশি ফ্রি আইসক্রিম খাওয়া তো আছেই!
আমাদের দেশেও কিন্তু আইসক্রিম রসিকেরা একেবারে বঞ্চিত নয়! নানা স্বাদের, নানা ফ্লেভারের আইসক্রিমের বক্স এখন পাওয়া যাচ্ছে একেবারে বাড়ির পাশের দোকানটাতে। ভ্যানিলা, ম্যাঙ্গো, স্ট্রবেরির মতো ক্ল্যাসিক ফ্লেভারগুলো তো রয়েছেই, এখন পাওয়া যাচ্ছে মালাই, পায়েস, দই, ক্ষীরের মতো ফ্লেভারও। নামীদামি সব আইসক্রিম পারলারও একেবারে দুর্লভ নয়। ওখানে গিয়ে চাখা যায় হৃদয় হরণ করা সব স্কুপ। এমনকি আইসক্রিম প্যানের ওপর তরল দুধ ঢেলে খুন্তি ঘষে ঘষে আইসক্রিম রোলও এখন পাওয়া যাচ্ছে ঢাকার কয়েকটা জায়গায়, যেটা আগে কেবল বিদেশে গেলেই জিবে ছোঁয়ানো যেত। আচ্ছা, তরল বিভিন্ন ফ্লেভার তাওয়ায় পড়ামাত্রই একেবারে জমে আইসক্রিম হয়ে যায় কীভাবে? হতে বাধ্য, কারণ ওই তাওয়ার তাপমাত্রা থাকে মাইনাস তেত্রিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস! এই জিনিস খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কারিগরের খুন্তির কারিকুরি দেখতেও মজা! আমাদের দেশে ছোট্ট শিশুরা এখনো পানি খাওয়ার গ্লাসে চকবার খেতে খেতে ভাবে, বড় হয়ে আইসক্রিমওয়ালা হতে হবে! পানি খাওয়ার গ্লাস কেন? আহা, না হলে হাতের চকবার গলে গলে পড়ে যাবে না?
সেই বাচ্চা ছেলেটার খবর কী? সে-ও কি এসব আইসক্রিমে বুঁদ? অবশ্যই! গপগপিয়ে আইসক্রিম খেয়ে বেড়ায়। পাগল না হলে এসব মাথা নষ্ট স্বাদের আইসক্রিম কেউ ফিরিয়ে দেয় নাকি? তারপরও, মাঝেমধ্যেই তার মন টানে পাইপ আইসক্রিমে একটা টান দেওয়ার জন্য। ঢাকায় এখন কুলফির বেশ চল হয়েছে। কুলফিওয়ালা মামাদের দেখলেই সে আত্মহারা হয়ে যায়! এখন আর সে বাচ্চাটি নেই, কাজেই হাতে পাইপ আইসক্রিম দেখলে আশপাশের লোকজন কেমন কেমন করে তাকায়। তাকাক! ওরা তো আর জানে না, পাইপ আইসক্রিমে একটা টান দিয়ে, কুলফির ঠোঙায় একটা চুমুক দিয়ে সে ফিরে যায় তার হারিয়ে যাওয়া শৈশবে, তার ছোটবেলার চেনা গন্ধে!
আহা আইসক্রিম!
মডেল: মারিয়া, জুয়েনা, তানিসা, জাসিয়া, কাজী জাহিদ হোসেন, মনামী, স্নেহা, মাহিন, তাসনিমুল, তুরফা, সাকিন ও রাফিদ | ছবি: সুমন ইউসুফ | আইসক্রিম কৃতজ্ঞতা: ঢাকা আইসক্রিম ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড