সময়টা ১৯৭৮ সাল। ১৫ জন সভ্য নিয়ে ঢাকা কলেজের পেছনে শিক্ষা সম্প্রসারণ কেন্দ্রে শুরু হলো এক পাঠচক্র। প্রতি সপ্তাহে নির্ধারিত একটি বই পড়ে সভ্যরা। একদিন বসে আলোচনায়। তারপর কেটে গেছে প্রায় ৩৯ বছর। ১৫ জন থেকে সংখ্যাটা ১৫ লাখও ছাড়িয়েছে। বলছি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কথা। উচ্চ মূল্যবোধসম্পন্ন, আলোকিত মানুষ গড়ার পথে আজ অনেক দূর এগিয়ে গেছে প্রতিষ্ঠানটি। সারা দেশে এ রকম সম্পন্ন মানুষ গড়ে তোলাই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের লক্ষ্য।
প্রথমে শুরু হওয়া সেই পাঠচক্র চলেছিল পাঁচ বছর। পাঁচ বছর পর প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ লক্ষ করলেন, এই সময়ের মাঝে সভ্যদের দৃষ্টিভঙ্গি, জীবনবোধে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। তিনি ভাবলেন, বিশ্ববিদ্যালয় নয়, আরেকটু কম বয়সী শিক্ষার্থীদের হয়তো আরও ভালোভাবে গড়ে তোলা যাবে। সে ভাবনা থেকেই ১৯৮৪ সালে কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে শুরু করলেন এক বছর মেয়াদি কার্যক্রম। আশ্চর্য রকম সাফল্য এল। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ দেখলেন, শিক্ষার্থীদের দৃষ্টিভঙ্গি যেমন উজ্জ্বল হচ্ছে, তেমনি বিকাশ হচ্ছে হৃদয়েরও। সেই থেকে শুরু। এখন সেই কার্যক্রমের ৩২তম ব্যাচ বইপড়া, বই নিয়ে আলোচনা, চলচ্চিত্র দেখা—এসব কাজ চালিয়ে যাচ্ছে নিয়মিত। কলেজের শিক্ষার্থীদের পর কাজ শুরু হয়েছিল স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিয়েও। ঢাকার তত্কালীন ডিসি বদিউর রহমানের কাছ থেকে দুই লাখ টাকা নিয়ে শুরু হয়েছিল স্কুলের কার্যক্রম। বিশ্বসাহিত্যের সেরা বইগুলো পড়ে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার পথে নিজেদের এগিয়ে নিয়েছিল স্কুলের ছেলেমেয়েরা।
স্বপ্নের এক প্রতিষ্ঠান বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। কঠোরতার বেড়াজাল নয়, আনন্দের সঙ্গেই নিজের মনকে আলোকিত করার আয়োজন এখানে। এখান থেকেই কিশোর তরুণেরা স্বপ্ন দেখতে শেখে, শেখে কীভাবে বিকশিত করতে হয় স্বপ্নকে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ লিখেছেন, ‘কেন্দ্রের বক্তব্য একটাই: প্রথমে শিক্ষা, পরে দীক্ষা। প্রথম কাজটির ভেতর দিয়ে কেন্দ্র চিত্তকে আলোকিত করে দেয়। কিন্তু দীক্ষা সভ্যের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার। তার জেগে-ওঠা আলোকিত হৃদয় যে-আদর্শকে দেশ, জাতি এবং পৃথিবীর দুঃখের শ্রেষ্ঠতম প্রত্যুত্তর বলে বিবেচনা করে, সেই আদর্শে সে স্বদীক্ষিত হয়। সব দীক্ষার মধ্যে এই দীক্ষাই শ্রেষ্ঠ।’
কেবল সাহিত্যের রস আস্বাদনের জায়গাই নয় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। হৃদয়কে বিকশিত করার নানা পথ খোলা আছে এখানে। দেশভিত্তিক উৎকর্ষ কার্যক্রম, পাঠাভ্যাস উন্নয়ন কার্যক্রম, ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি, কেন্দ্র লাইব্রেরি, আলোর ইশকুল, প্রকাশনা, শ্রবণ-দর্শন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আলোর পাঠশালা, প্রাথমিক শিক্ষকদের বইপড়া কর্মসূচি—এই কর্মসূচিগুলো চালু রয়েছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে।
দেশভিত্তিক উৎকর্ষ কার্যক্রম
সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের শাখা গড়ে তোলা হয়েছে। সেখানে আগ্রহী ছাত্রছাত্রীদের খুঁজে বের করে সদস্য করে নেওয়া হয়। প্রতি সপ্তাহের যেকোনো একদিন নির্ধারিত ১৬টি বইয়ের ১টি করে বই নিয়ে যায় তারা। পরের সপ্তাহে ওই বইটি ফিরিয়ে দিয়ে নিয়ে যায় অন্য একটি বই। এভাবে সব বই পড়া শেষে একটি মূল্যায়ন পরীক্ষা নেওয়া হয়। মূল্যায়ন পরীক্ষার ফল থেকে বোঝা যায় কে কয়টি বই পড়েছে। ৭টি বই পড়লে শুভেচ্ছা পুরস্কার ১টি বই, ১০টি বই পড়লে স্বাগত পুরস্কার ২টি বই, ১৩টি বই পড়লে অভিনন্দন পুরস্কার ৩টি বই এবং ১৬টি বই পড়লে সেরা পাঠক পুরস্কার ৪টি বই দেওয়া হয়। দেশভিত্তিক উৎকর্ষ কার্যক্রমই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রথম বড় কর্মসূচি।
সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের শাখা গড়ে তোলা হয়েছে। সেখানে আগ্রহী ছাত্রছাত্রীদের খুঁজে বের করে সদস্য করে নেওয়া হয়। প্রতি সপ্তাহের যেকোনো একদিন নির্ধারিত ১৬টি বইয়ের ১টি করে বই নিয়ে যায় তারা। পরের সপ্তাহে ওই বইটি ফিরিয়ে দিয়ে নিয়ে যায় অন্য একটি বই। এভাবে সব বই পড়া শেষে একটি মূল্যায়ন পরীক্ষা নেওয়া হয়। মূল্যায়ন পরীক্ষার ফল থেকে বোঝা যায় কে কয়টি বই পড়েছে। ৭টি বই পড়লে শুভেচ্ছা পুরস্কার ১টি বই, ১০টি বই পড়লে স্বাগত পুরস্কার ২টি বই, ১৩টি বই পড়লে অভিনন্দন পুরস্কার ৩টি বই এবং ১৬টি বই পড়লে সেরা পাঠক পুরস্কার ৪টি বই দেওয়া হয়। দেশভিত্তিক উৎকর্ষ কার্যক্রমই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রথম বড় কর্মসূচি।
দেশভিত্তিক লাইব্রেরি কার্যক্রম
বই পড়ার প্রতি খুব আগ্রহ, কিন্তু অনেক অনেক বই তো সব সময় কিনে পড়া সম্ভব হয় না। আবার লাইব্রেরি আছে, কিন্তু লাইব্রেরি থেকে বই বাড়িতে আনা যায় না কিংবা বাড়ি থেকে তা অনেক দূরে। এর সমাধান কী হবে? এ রকম পড়ুয়াদের কথা চিন্তা করে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র এমন কর্মসূচি চালু করেছে যে পাঠককে লাইব্রেরির কাছে যেতে হবে না, লাইব্রেরিই আসবে পাঠকের কাছে। এই কর্মসূচি হচ্ছে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি। বিভিন্ন আকারের গাড়িতে ৪ থেকে ১১ হাজার বই নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে অনেক ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি। বর্তমানে দেশের ৫৮টি জেলায় চালু আছে এই লাইব্রেরিগুলো। প্রতিটি লাইব্রেরি সপ্তাহে ৪০টি এলাকায় গিয়ে আধা ঘণ্টা থেকে দুই ঘণ্টা পর্যন্ত অবস্থান করে। এই লাইব্রেরির সময়সূচী পাওয়া যাবে bskbd.org/mobile-library ঠিকানায়।
এ তো গেল ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির কথা। তারপরও একটি বড় আকারের লাইব্রেরির প্রয়োজনীয়তা থেকে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ভবনে তৈরি করা হয়েছে একটি কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি। দেশি-বিদেশি প্রায় দুই লাখ বইয়ের সংগ্রহ রয়েছে এখানে। যেকোনো পাঠক মঙ্গলবার ছাড়া অন্যান্য দিন বিকেল চারটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত বই পড়তে পারে এই লাইব্রেরিতে। এ ছাড়া সদস্যরা পছন্দমতো বই বাড়িতে নিয়েও পড়তে পারে। বছরে প্রায় ১০ হাজার পাঠক এই কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ব্যবহার করে।
আলোর পাঠশালা
প্রযুক্তির উন্নয়নে ছাপা বইয়ের পাশাপাশি এসেছে ই-বুক। কর্মব্যস্ত মানুষের ঝোঁকও বাড়ছে এর প্রতি। এ জন্য ঘরে বসেই বই পড়ার সুবিধা দিতে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র চালু করেছে অনলাইন লাইব্রেরি আলোর পাঠশালা। এখানে এখন পর্যন্ত ৭২টি বই আপলোড করা হয়েছে। যেকোনো পাঠক এই বইগুলো বিনা মূল্যে ডাউনলোড করে নিয়ে পড়তে পারবে। এখানেও পাঠকদের উত্সাহ সৃষ্টির জন্য রয়েছে পুরস্কার। চারটি বই পড়লে একজন পাঠককে একটি করে বই পুরস্কার দেওয়া হবে। alorpathshala.org এই ওয়েবসাইট থেকে রেজিস্ট্রেশন করে তোমরাও পড়তে পারো বইগুলো।
আলোর ইশকুল
স্কুল-কলেজভিত্তিক উৎকর্ষ কার্যক্রমের উচ্চতর পর্যায় আলোর ইশকুল কর্মসূচি। ১৮ বছরের বেশি বয়সীরা এই কর্মসূচিতে সদস্য হতে পারেন। এখানে সাহিত্য, সংগীত, নৃত্য, চিত্রকলা, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি, ধর্ম, বিজ্ঞান, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ের ওপর উৎকর্ষ চক্রের আয়োজন করা হয়। প্রতি আট মাসে গড়ে ১৩টি করে পাঁচ বছরে মোট ১০০টি চক্র হয় সভ্যদের নিয়ে।
শ্রবণ-দর্শন বিভাগ
শুধু বই পড়ে বিদ্বান হলেই চলবে না। হৃদয়কে বিকশিত করতে, শৈল্পিক বোধ ও রুচিকে উন্নত করতে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, শ্রেষ্ঠ সংগীতগুলোও শোনার ব্যবস্থা থাকতে হবে। এই লক্ষ্যে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের শ্রবণ-দর্শন বিভাগের কর্মসূচি চালু করা হয়েছে। এই বিভাগে সংগীত এবং চলচ্চিত্র—এই দুটি শাখা রয়েছে। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষার সংগীতের একটি সংগ্রহ রয়েছে সংগীত বিভাগে। দেশভিত্তিক উৎকর্ষ কার্যক্রমের সদস্য এবং আগ্রহী শ্রোতারা এখানে সংগীত শুনতে পারেন। চলচ্চিত্র বিভাগে রয়েছে একটি চলচ্চিত্র চক্র। এখানে আলোর ইশকুল কার্যক্রমের সদস্যরা এবং সাধারণ আগ্রহী ব্যক্তিরা চলচ্চিত্র দেখতে পারে। এ ছাড়া জেলা ও উপজেলা শহরগুলোতে বছরে ৩০০টি দুই দিনের চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজন করা হয়।
প্রকাশনা কার্যক্রম
বাংলা ভাষাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার বইগুলো প্রকাশ করছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। তিনটিসিরিজে বইগুলো প্রকাশ করাহয়। ইংরেজি ভাষার বইগুলোপড়ে খুব কম পাঠকই। অন্যান্য ভাষার বইও সবার পক্ষে পড়া সম্ভব নয়। আবার বাংলা ভাষায় অনূদিত ভালো মানের বইয়ের সংখ্যাও বেশি নয়। এসব কারণে বিশ্বের সেরা রচনাগুলো বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করা হচ্ছে ‘চিরায়ত গ্রন্থমালা’ সিরিজে। বাংলা ভাষার সেরা লেখকদের রচনাগুলোও ‘চিরায়ত বাংলা গ্রন্থমালা’ সিরিজে প্রকাশ করা হচ্ছে। শিশু-কিশোর উপযোগী বাংলা ভাষার লেখা এবংঅন্যান্য ভাষার অনুবাদ করা বইগুলো প্রকাশ করা হচ্ছে ‘কিশোর সাহিত্য গ্রন্থমালা’ সিরিজে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ভবনে প্রকাশনা বিভাগের নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে।
প্রাথমিক শিক্ষকদের বইপড়া কর্মসূচি
শিক্ষকদের চিত্তকে উন্নত, আলোকিত করা গেলে তাদের সংস্পর্শে শিক্ষার্থীরাও একেকজন সম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে। এ কারণে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র প্রাথমিক শিক্ষকদের বইপড়া কর্মসূচির ব্যবস্থা করেছে। দেশের ৫৮টি পিটিআইতে প্রশিক্ষণার্থীদের ২০টি করে বই পড়াতে দেওয়া হচ্ছে। বইপড়া কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীদের বই উপহার দেওয়া হচ্ছে।
রাজধানীর বাংলামোটরে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ভবন। এখান থেকেই প্রতিষ্ঠানটির যাবতীয় কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ভবনে অফিসের জায়গা ছাড়াও রয়েছে বৃহৎ লাইব্রেরি, চিত্রশালা, মিলনায়তন, সংগীত ও চলচ্চিত্র সংগ্রহশালা, বই বিক্রয়কেন্দ্র ও ক্যাফেটেরিয়া। শিল্প-সাহিত্য অনুরাগী ও সংস্কৃতিজগতের ব্যক্তিদের নিয়মিত আসা-যাওয়ায় মুখর হয়ে ওঠে ভবনটি।
যে কোনো তথ্য পাবে কেন্দ্রের ওয়েবসাইট bskbd.org-এ। তো, কোন পদ্ধতিতে বই পড়ার এই বিশাল কর্মসূচিতে অংশ নেবে, তা তোমরাই ঠিক করে ফেলো। আলোকিত হওয়ার এটাই তো সময়।