কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও কার্টুনিস্ট আহসান হাবীবের মা রত্নগর্ভা আয়েশা ফয়েজ মারা যান ২০১৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। সেসময় প্রিয় নানুকে নিয়ে লিখেছিলেন তাঁর নাতনি - অপলা হায়দার।
নানু চলে যাওয়ার বেশ কিছুদিন হয়ে গেল, অথচ আমি তাঁকে স্বপ্নে দেখলাম না! স্বপ্নে দেখার জন্য রোজ নানুর কথা ভাবি, কিন্তু দেখি না কেন? আমেরিকা এসেছি দুই বছর হলো। আসার সময় যখন কাঁদছিলাম, নানু বললেন, ‘নানা, আমাকে নিয়ে চিন্তা কোরো না, আমার দীর্ঘ আয়ু। আমি ভালো থাকব।’ কথাটায় অনেক ভরসা পেয়েছিলাম সেদিন। কিন্তু এবার যখন দেশে যাব তখন দেখব নানুর খালি খাট। এত কষ্ট লাগে মনে করলে। আমার সেই নানু, যিনি আমার জন্মের সময় ভয়াবহ জন্ডিস কমার জন্য আল্লাহর কাছে বলেছিলেন, ‘আমার বংশে আর বাচ্চা লাগবে না, শুধু এই বাচ্চাকে বাঁচিয়ে দাও।’ আল্লাহ অত নির্দয় হননি। আমি বেঁচে গেলাম এবং এর পরে অনেক বংশধরও এল। সে সময় আমার বিলিরুবিন হুহু করে বেড়েই চলছিল, কমে না। আমাকে ‘রে’ দিতে ছয়তলায় নিয়ে যেতে হয়। নানু নিয়ে যান, এরপর আমাকে মায়ের কাছে আনেন খাওয়াতে। নানুর মনে হতো লিফটে আমার দম বন্ধ হয়ে যাবে, তাই তিনি প্রতিবার ছয়তলা ভেঙে ভেঙে আসেন। এদিকে মায়ের অপারেশনও সাকসেসফুল হয়নি। এসব চিন্তায় আমার নানুর সব চুল পেকে গেল। হুট করে নানুকে আমি বুড়ো বানিয়ে ফেললাম। কে জানে, নানু না থাকলে হয়তো আমি বাঁচতামও না!
নানুর অসাধারণ কিছু আইডিয়া ছিল। এক, সব নাতজামাই বিয়েতে সোনার মোহর পাবে আর আমাদের জন্য একটি সোনার মুকুট বানানো থাকবে, যা সব বোন বিয়েতে পরবে। একজনের বিয়ের পর যার বিয়ে হবে, সে তাকে দিয়ে দেবে। পরবে তার বিয়ের দিন। সবার শেষে যার বিয়ে হবে, সে এই মুকুট একেবারে রেখে দেবে।
আরেকটা ব্যাপার ছিল, তাঁর নাতনিরাশ্বশুরবাড়ির উঠানে নূপুর পরে হাঁটবে। তাই আমাদের সোনার পানি দিয়ে ধুয়ে রুপার নূপুর দেওয়া হতো। সোনা নাকি পায়ে পরতে হয় না, তাই রুপা।
আমার ক্ষেত্রে এমন হয়েছিল। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি ভাটারা যাচ্ছি। তুমুল বৃষ্টি। আমি শাড়ি তুলে হাঁটছি। ধানখেতের ধারে জমে থাকা পানিতে নিজের পা দেখে নানুর কথা মনে হলো। আমি যখন শ্বশুরবাড়ির উঠানে হাঁটছি, পাশের বাসার এক বৃদ্ধা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘নূপুর কে দিল?’ আমি গর্বের সঙ্গে বললাম, ‘আমার নানু।’ উনি বললেন, ‘নানির শখ কত।’ আসলেই তো আমার নানুর কত বিচিত্র শখ ছিল। ইশ্, কেন বারবার আমার কান্না পায়। নানু যেদিন মারা যান সেদিন ছোট বোন নীষা ফোন করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘অমি আপু, নানু মারা যাচ্ছে। আমরা হাসপাতালে।’ আমি হাজার হাজার মাইল দূর থেকে ফোন ধরে আছি। নানুকে দেখতে পারছি না। ইশ্, কী কষ্ট দূরে থাকার! পরদিন যখন দাফন করার জন্য নানুকে নেওয়া হচ্ছে, ঠিক সেই সময় আমার এত অস্থির লাগছিল, নীষাকে ফোন দিই। ও কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘অমি আপু, নানুকে নেওয়া হচ্ছে।’ আচ্ছা, আমি হাজার হাজার মাইল দূর থেকে কীভাবে বুঝলাম নানুকে চিরবিদায় জানানো হচ্ছে?
কয়েকটা স্মৃতি খুব মনে পড়ে। নানু শাক কাটছেন, আমি পাশে বসে আছি। নানু কীভাবে জানি বঁটিতে হাত দিলেন। আমি ভাবলাম এই বুঝি সব আঙুল কেটে পড়ে যাবে। কিন্তু অবাক হয়ে দেখি, শাক কুচি কুচি হয়ে নিচে পড়ছে। নানুর রান্নার হাত ছিল অসাধারণ! খুব আয়োজন করে নানু রাঁধতেন না। এই হুটহাট এটা-সেটা দিচ্ছেন। রান্না শেষে খাবারটা অমৃত হতো! ছোটবেলায় আমরা যখন পিরোজপুর থেকে ঢাকায় আসতাম, নানু আমাদের ছয় বোনকে (মামাতো-খালাতো) তেল দিয়ে কষে চুলে দুটি বেণি করে দিতেন। এমন টাইট হতো যে চোখে পানি এসে যেত। জুলফি দিয়ে তেল চুয়ে চুয়ে পড়ত। রুটিনের মতো ছিল রোজ বিকেলে তেল দিয়ে বেণি বাঁধা।
আমার যখন বাচ্চা হবে, তখন আব্বার শরীর খুব খারাপ। আমার কাছে আম্মার এক মাসের জন্য আসাও অনিশ্চিত। নানু তখন মাকে বললেন, ‘শেফু, তুই মেয়েটার কাছে যা, জামাইকে আমি দেখব।’ নিজের অসুস্থ শরীর নিয়ে নানু তা করেছেনও। আমার ছেলেটা জন্ম নিল, অথচ আমি নানুকে দেখাতে পারলাম না! এই দুঃখ কি আমার যাবে?
মানুষ সান্ত্বনা খোঁজে। আমিও খুঁজি—নানু অন্তত আমার ছেলে অহনের ছবি দেখে গিয়েছেন। ওর ভিডিওগুলো দেখে তিনি নাকি খুব মজা পেতেন।
নানু, শেষবেলা আপনাকে দেখতে পেলাম না, স্বপ্নেও দেখছি না...দেখার অপেক্ষায় রইলাম।