ঈদের কেনাকাটা শেষ করে বিকেলের মধ্যে বাসায় ফেরাই ছিল প্ল্যান। কিন্তু কপালের ফের, শপিংয়ে গেলে চোখ ভরে তো মন ভরে না। মার্কেটেই সময় হয়ে গেল ইফতারের!
কী, খুব বেকায়দা অবস্থা? মোটেই না! এই সময়ে প্রত্যেক দোকানদার বসেন যাঁর যাঁর ইফতার নিয়ে। এবং উদ্বাহু হয়ে ডাকতে থাকেন তাঁর থাল থেকে ইফতার করার জন্য। এগিয়ে গিয়ে একজনের কাছ থেকে ভাগ বসালাম। মুখে নিতেই একেবারে চোখ বুজে এল তৃপ্তিতে।
তা কী সেই ইফতার? কী আর? বাংলাদেশিদের ইফতার মানেই তো পেঁয়াজু-ছোলা-মুড়ি মাখানো। বাইরের দোকানে বা অফিস–আদালতে যখন মানুষ একসঙ্গে ইফতারে বসেন, তখন ছোলা-মুড়ির সঙ্গে যোগ হয় কয়েকটা খেজুর। আপেল, শসা, কমলা। বাড়িতে বসলে হালিম, পরোটা, কাবাব আরও নানা কিছু।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে পেঁয়াজু, ছোলা, বেগুনি, খেজুর দিয়ে আমরা যে ইফতার করে থাকি, এগুলো কোত্থেকে এল? থাক থাক, বাজার থেকে যে এসেছে, সে আমরা সবাই জানি। জানতে চাচ্ছিলাম এগুলোর উৎপত্তি কোথায়?
এই যেমন খেজুর। সেটা এসেছে একেবারে সুন্নত অনুসরণ করে। আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ইফতারের সময় খেজুর খেতেন। মধ্যপ্রাচ্য থেকে এই রীতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। খেজুরটা ইফতারে বিশ্বের সব জায়গাতেই কমবেশি খাওয়া হয়।
তারপর এই যে ছোলা, সেটাও আমাদের একেবারে নিজস্ব খাবার নয়। আফগানদের প্রিয় খাবার এটা, সেখান থেকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঢুকেছে ভারতবর্ষে, ধীরে ধীরে আমাদের এই বাংলাদেশে। তার মানে এই না যে রশিদ খানরা ক্রিকেট খেলে ইফতারের সময় আমাদের চেনা বুটভুনা নিয়ে বসে যান। তাঁদের ওগুলো কাবুলি ছোলা, মসলারও তত আধিক্য নেই। বোঝাই যায়, এ দেশে আসার পর আমাদের পূর্বপুরুষেরা তাতে মনের মাধুরী মিশিয়ে মসলা যোগ করেছিলেন। আরও ব্যাপার আছে। ছোলার সঙ্গে যে মুড়ি খাওয়ার ব্যাপারটা, সেটাও শুরু হয় আমাদের অঞ্চলে। পুরো ব্যাপারটা কেমন মচমচে হয়ে উঠল, তাই না?
আর বেগুনি, পেঁয়াজু, আলুর চপ; এই সব ভাজাপোড়া? দিলে তো মনটা উত্তর ভারতের দিকে ঘুরিয়ে! সেখানকার লোকজন ইফতারে ভাজাপোড়া খেতেন বেশ। সেখান থেকে ক্রমে ক্রমে এ অঞ্চলেও। যতই ‘ছি ছি, অস্বাস্থ্যকর, এগুলো কম খাওয়া ভালো’ বলি; ইফতারে ভাজাপোড়া না থাকলে মন আসলে একটু কেমন কেমনই করে আমাদের।
হালিম, কাবাব, বিরিয়ানির ব্যাপারটা কিন্তু ভিন্ন। হালিমটা যেমন মধ্যপ্রাচ্য থেকে এসেছে, সেটা পারসিকরা তাদের মতো একটা ঘরানা তৈরি করেছে। আবার মোগলরা পারসিকদের কাছ থেকে অনেক কিছু গ্রহণ করেছে, খাদ্যসংস্কৃতিও। সেভাবেই মোগলদের কাছে এসেছে ইফতারে হালিম, কাবাব খাওয়ার সংস্কৃতি। আর বিরিয়ানিতে তো মোগলদের একচেটিয়া অধিকার! এ দেশবাসী মোগলদের কাছ থেকেই ইফতারে এই খাবারগুলো খাওয়ার অভ্যাস পেয়েছে।
আর শরবত? সেটা আসলে মধ্যপ্রাচ্য আর উপমহাদেশে সব জায়গার ইফতারেরই বৈশিষ্ট্য। উষ্ণপ্রধান দেশ, তাই তেষ্টা মেটানোতেই এ দেশবাসীর মনোযোগ থাকে শুরুতে। আর সেই তেষ্টা তারা মেটায় নানা ফলের ঘ্রাণে, নানা বৈচিত্র্যের সুমিষ্টতায়। বলা বাহুল্য, সেই বৈচিত্র্য আসে শরবতের রূপ ধরে।
তাহলে প্রশ্ন একটা চলেই আসে, আজ থেকে দুই শ-তিন শ-চার শ-পাঁচ শ বছর আগে বাংলাদেশিরা ইফতারে কী খেত? বড় বাপের পোলায় খায়? যেটাকে আমরা অনেকেই ঐতিহ্যবাহী খাবার বলে জানি? আসলে, পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবার যে একে বলা হয়, সেই পুরান ঢাকাবাসীই কিন্তু এটাকে তাঁদের ঐতিহ্যবাহী খাবারের তালিকায় স্থান দিতে নারাজ। তাঁদের ঐতিহ্যবাহী খাবারের তালিকায় রয়েছে সুতলি কাবাব, নারগিসি কোফতা, শাহি জিলাপি ইত্যাদি। এ ছাড়া গোলাপপানি আর কেওড়াতে ভিজিয়ে রাখা হতো আখের ছোট ছোট কাটা টুকরা। ইফতারের পর সবার মুখ চলত এগুলো দিয়ে। কিন্তু সে–ও অধুনা ঢাকার কথা, মানে শ খানেক বছর আগের কথা। যখন চার শ-পাঁচ শ বছর আগের কথা বলছি তখন? সোজা উত্তর—ভাত খেত। সঙ্গে এন্তার মাছ-মাংস, সবজি, বিভিন্ন পদের ডাল।
আহা, ভাবতেই ভালো লাগছে। প্রাচীন বাঙালি খেতে বসেছে গরম গরম ভাত। সঙ্গে কাঁচা মরিচে চটকে বানানো আলুভর্তা, গাওয়া ঘি…দাঁড়াও দাঁড়াও…কাঁচা মরিচ আনল তো এই সেদিন, পর্তুগিজরা! তার আগে আমরা এই জিনিস চিনতাম না! আলুরও একই অবস্থা! তাহলে বাঙালি ঝাল খেত তখন কি? সে আরেক ইতিহাস! অন্য আরেক দিন বলব না হয়, কেমন?
তথ্যসূত্র:
ঢাকা পাঁচাস বারাস পেহলে; হাকীম হাবীবুর রহমান
ঢাকাই খাবার ও খাদ্য সংস্কৃতি; সাদ উর রহমান
বিবিসি বাংলাকে দেওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. নুসরাত ফাতেমা ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শেখ মো. ইউসুফের দেওয়া সাক্ষাৎকার