আকাশ দেখার নির্মল আনন্দ

ছোটবেলায় খেলাধুলা, গান-বাজনা, লেখাপড়া, আর্ট, প্রযুক্তি সম্পর্কে আবছা যেন কোনো জ্ঞান ছিল। কিন্তু কোনোটাতেই পারদর্শী ছিলাম না। সেই সময় দু-একটা রুশ বইয়ের অনুবাদ, মূলত শুভময় ঘোষের সুন্দর অনুবাদে ইয়াকভ পেরেলমানের জ্যোতির্বিদ্যার খোশখবর কিছুটা পড়ে (পুরোটা বোঝার মতো মাথা ছিল না) এবং অধ্যাপক আবদুল জব্বারের তারাচিত্র দেখে খুব অনুপ্রাণিত হয়ে রাতের আকাশের দিকে দৃষ্টি দিই। সত্তরের দশকে, স্বাধীনতার পরপর, ঢাকার রাতের আকাশ এখন থেকে অনেক দূষণমুক্ত আর পরিষ্কার ছিল। তখন রাতে একাই বাড়ির ছাদে উঠে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তারাদের অবস্থান চিনেছি। সপ্তর্ষির প্রশ্ন, শীতের রাতে কালপুরুষের শিকার অন্বেষণ, লুব্ধককে নিয়ে কালপুরুষের পায়ের কাছে বৃহৎ সারমেয়র অপেক্ষা, অভিজিৎসহ ছোট সামান্তরিক বীণামণ্ডলী, ছায়াপথের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া সারস—সিগনাস, এসব আবিষ্কার করে রোমাঞ্চিত হতাম।

আঙুল দিয়ে মানচিত্রের তারাকে আকাশে চিহ্নিত করতে পেরে আনন্দে নেচে উঠতাম। কিন্তু সেই খুশি কারোর সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারতাম না। তবু বিশাল কালো আকাশের নিচে নিজেকে ভাবতাম একধরনের নাক্ষত্রিক পরিব্রাজক, যে কিনা অনন্ত মহাশূন্যে নিজের মহাকাশযানে বসে তার পরবর্তী গন্তব্যস্থল কী হবে সেটা নির্ধারণ করছে। ঢাকার আকাশে তখনো ছায়াপথ দেখা যেত। আর ধনুরাশির পেছনে, প্রায় ৩০ হাজার আলোকবর্ষ দূরে, ছায়াপথের তারাদের পার হয়ে যে আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্র সেটাও আমি তখন জানতে পেরেছিলাম। তবে কী করে তারাদের দূরত্ব আর প্রকৃতি নির্ধারণ করা হয়, সে সম্পর্কে আমার ধারণা ছিল না। অবশ্য সেই অজ্ঞতা আমাকে আকাশ চেনার নির্মল আনন্দ থেকে বঞ্চিত করতে পারেনি। এখনো মনে পড়ে, এক রাতে, আমার বয়স তখন পনেরো হবে, রাত একটা নাগাদ, নিশ্ছিদ্র কালো আকাশে, উজ্জ্বল তারাদের মাঝে আমাকে হকচকিত করে উড়ে গিয়েছিল একটা কালো মেঘ। কেমন যেন ভয় পেয়েছিলাম। পরের কয়েক দিন ধরে সেই দ্রুত মেঘ আমার মন অধিকার করে রেখেছিল। একধরনের অবোধ্য বিস্ময়বোধ নিয়ে বসে ছিলাম। পরে বুঝেছিলাম, সেটা হয়তো যাযাবর পাখির ঝাঁক ছিল; শীতের শেষে উড়ে যাচ্ছিল হিমালয়ের দিকে। এর প্রায় দশ বছর পরে, যুক্তরাষ্ট্রে আমি প্রথম অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি দেখি একটি ৮ ইঞ্চি দুরবিন দিয়ে। (পরে খালি চোখেই বাংলাদেশের রাঙামাটি থেকে আমাদের কাছের এ গ্যালাক্সিটি দেখতে পাই।) তখনই আমার সুযোগ হয় একটা ১৬ ইঞ্চি দুরবিন দিয়ে কর্কট নীহারিকা দেখার। কর্কট নীহারিকার কথাটা বললাম এ জন্য যে গামা রশ্মি জ্যোতির্বিদদের জন্য কর্কট পালসার বা নিউট্রন নক্ষত্র ও তার চতুষ্পার্শের নীহারিকা খুবই মূল্যবান খ-গোল (ঈবষবংঃরধষ ংঢ়যবত্ব) বস্তু। কারণ কর্কট পালসার ও নীহারিকা উত্তর গোলার্ধের, আপাতদৃষ্টিতে, সবচেয়ে শক্তিশালী গামা রশ্মির উৎস। এটি ব্যবহার করেই গামা রশ্মির জ্যোতির্বিদেরা তাদের গামা দুরবিন ক্যালিব্রেট করে।

প্রশ্ন করতে পারো, ক্যালিব্রেশন কী? কর্কট থেকে কী পরিমাণ গামা রশ্মি নির্গত হয় সেটা আমরা আগে থেকে জানি। এই গামা রশ্মি চোখে দেখা যায় না। তবে পরোক্ষ পদ্ধতিতে ডিটেক্টর যন্ত্রে গামা-রশ্মি-সৃষ্ট সংকেতের মাধ্যমে আপতিত গামা রশ্মির পরিমাণ নির্ধারণ করতে হয়। নতুন যন্ত্র কর্কটের দিকে তাকালে যে পরিমাণ সংকেত পাওয়া যাবে, সেই সংকেতের পরিমাণকে কর্কটের আগে থেকে জানা গামা শক্তির সঙ্গে তুলনা করার উপায়কে ক্যালিব্রেশন বলা হয়। কিন্তু পেশাদারি গামা রশ্মি জোতির্বিদেরা হয়তো জানেনই না আকাশের কোন দিকে তাকালে কর্কট নীহারিকাকে দেখা যাবে। আসলে বেশির ভাগ পেশাদার জ্যোতির্বিজ্ঞানী রাতের আকাশ চেনেন না। তাঁরা মানচিত্রে আকাশ জানেন, তাঁদের দুরবিনকে কোন দিকে তাক করতে হবে সেটা গ্যালাক্সি বা তারার ক্যাটালগ অনুসন্ধান করে বের করেন। কার সময় আছে রাতের আকাশ দেখার! আরও পরে আমার দক্ষিণ গোলার্ধে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। দক্ষিণের আকাশ খুবই ইন্টারেস্টিং। সেখানে সমস্ত নক্ষত্র যেন উল্টো। কালপুরুষ উল্টো, বৃহৎ সারমেয় উল্টো। তার নিচে সূর্য ও লুব্ধকের পরে আকাশের আপাতদৃষ্টিতে তৃতীয় উজ্জ্বল তারা ক্যানোপাস বা অগস্ত্য, দক্ষিণের ক্রস। অগস্ত্যকে ঢাকার দক্ষিণ দিগন্তে দেখা যাবে নভেম্বর, ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে। সেই সময়েই চতুর্থ উজ্জ্বল ও আমাদের সবচেয়ে নিকটবর্তী তারা সিস্টেম আলফা সেন্টাউরিকে (জয়) দেখে রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম। তবে তার কয়েক বছর আগে ঢাকা থেকে দক্ষিণের দিগন্ত ঘেঁষে আলফা ও বেটা সেন্টাউরিকে (জয় ও বিজয়) দেখি।

পৃথিবী তথা আমাদের সৌরজগতের সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশীদের অবস্থান

এপ্রিলের প্রথম দিকে কয়েক দিনের জন্য মাত্র এদের দেখা যাওয়ার কথা ঢাকা থেকে। কিন্তু দক্ষিণ গোলার্ধের সবচেয়ে বড় দ্রষ্টব্য হচ্ছে বড় ও ছোট ম্যাজিল্লান নীহারিকা। ইংরেজিতে Large Magellanic Cloud (LMC) এবং Small Magellanic Cloud (SMC)। LMC I SMC হচ্ছে আমাদের ছায়াপথ গ্যালাক্সির বামন উপগ্যালাক্সি। দক্ষিণ গোলার্ধের শহরগুলো থেকে ম্যাজিল্লান নীহারিকাগুলো দেখা মুশকিল, আর SMC তো খ-গোল দক্ষিণ মেরুর একেবারে কাছে ও উজ্জ্বলতাও কম। তাই তাকে খুঁজে পেতে বেগ পেতে হয়েছিল।

আমরা পৃথিবীর যেখানেই থাকি না কেন, যে রকম মানুষই হই না কেন, আকাশের দিকে তাকালেই আমরা সবাই জ্যোতির্বিদ হয়ে যাই। এই তাকানোর জন্য আমাদের দুরবিন লাগবে না, পকেট থেকে টাকা খরচ করতে হবে না, এর জন্য বড় ডিগ্রি লাগবে না, বিদেশ যেতে হবে না, শুধু ভালো চোখ থাকতে হবে। চোখ যদি ফোকাস না করতে পারে তবে এখনই ডাক্তার দেখিয়ে নিতে হবে। নির্মল আনন্দের জন্য শুধু এটাই শর্ত, ভালো চোখের। আর একটা বাইনোকুলার থাকলেও থাকতে পারে, সেটা অপরিহার্য নয়। তারপর আকাশের উজ্জ্বল সব তারার নাম জানতে হবে, সেই তারাদের হাত তুলে চিহ্নিত করতে হবে। সেই চিহ্নিত করার মধ্যে যে আনন্দ সেটা নির্দোষ ও ঈর্ষাবিহীন। তবে ভালো চোখও অপরিহার্য নয়, বছরব্যাপী সূর্যের উত্তরায়ণ ও দক্ষিণায়ন অনুসরণ করা যেতে পারে, চাঁদের কলার ক্ষয়বৃদ্ধি দেখে আনন্দ পাওয়া যেতে পারে। সেই আনন্দের মাঝে আমরা সবাই পাব পর্যবেক্ষকের তকমা আর এই তকমা মহাবিশ্বের মাঝে আমাদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অবস্থানকে বুঝতে সাহায্য করবে। এর মাঝে পেশাদারি ও অপেশাদারির কোনো তফাত নেই। এখানে যেন

আকবর বাদশাহর সঙ্গে
হরিপদ কেরানির
কোনো ভেদ নেই।
বাঁশির করুণ ডাক বেয়ে
ছেঁড়া ছাতা রাজছত্র মিলে চলে গেছে
এক বৈকুণ্ঠের দিকে। (বাঁশি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

মহাবিশ্বের সঙ্গে সব ধরনের মানুষ ও সমগ্র প্রকৃতির সম্পর্ককে বোঝার জন্য আকাশ দেখার আনন্দই আমাদের প্রথম ধাপ। সেখানে ছেঁড়া ছাতাই যথেষ্ট।

লেখক: যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ায় রিভারসাইড কলেজের অধ্যাপক, নাসার সাবেক গবেষক।