১৯০৫ সালে জার্মানির একটি বৈজ্ঞানিক জার্নালে একজনের তিনটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। নিবন্ধ তিনটি লিখেছেন সুইজারল্যান্ডের জুরিখ শহরের পেটেন্ট অফিসের একজন কেরানি, বিজ্ঞানীকুলে তাঁকে কেউ একটা চেনেও না। তিনটি নিবন্ধের একটিতে তিনি ‘ব্রাউনীয় গতি’ সম্পর্কে লিখেছেন। আর একটিতে, তারও পাঁচ বছর আগের অর্থাৎ ১৯০০ সালের একটি ধারণাকে আরেকটু এগিয়ে নিয়েছেন এবং সেটা দিয়ে সমাধান করে ফেলেছেন ‘ফটো ইলেকট্রিক ইফেক্ট’ নামের একটি প্রহেলিকা। আর বাকি নিবন্ধটি পাল্টে দিয়েছে পদার্থবিজ্ঞানের হাজার বছরের ইতিহাস। লেখক অবতারণা করেছেন আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বের। ১৯০৫ সালের ওই নিবন্ধ তিনটির ক্ষমতা পরে সবাই টের পেয়েছেন। এখন তো পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসের দুটো পর্যায়—১৯০৫ সালের আগে আর ১৯০৫ সালের পরে।
সুইজারল্যান্ডের জুরিখ শহরের ওই কেরানির নাম অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। বলা যায়, পদার্থবিজ্ঞানকে একটি নতুন ভিত্তির ওপর তিনি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। এখনকার যুগের সবচেয়ে জনপ্রিয় পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের ধারণা, একসময় পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাস কয়েক পৃষ্ঠায় লিখে ফেলা যাবে এবং তার ৭৫ শতাংশ জুড়ে থাকবেন আইনস্টাইন!
১৯০৫ সালের বিশেষ তত্ত্বের পর ১৯১৬ সালে আইনস্টাইন তাঁর আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব প্রকাশ করেন। ওই সময় অনেকেই তাঁর এই তত্ত্ব মেনে নিতে পারেননি। কয়েকজন মিলে তো একটা বই লিখে ফেললেন— আইনস্টাইনের বিরুদ্ধে এক শ (Hundred against Einstein)। আইনস্টাইনের কাছে যখন এ বিষয়ে মন্তব্য চাওয়া হলো তখন তিনি বললেন, ‘আরে বাবা, আমি যদি ভুলই হতাম তাহলে একজনই তো যথেষ্ট!’
তো এই পদার্থবিজ্ঞানী যদি পদার্থবিজ্ঞানী না হতেন (পদার্থবিজ্ঞানের ব্যাপক ক্ষতি হতো, নিঃসন্দেহে) তাহলে কী হতেন? জবাবটা আইনস্টাইন নিজেই দিয়েছেন, ‘আমি যদি পদার্থবিজ্ঞানী না হতাম, তাহলে সম্ভবত আমি একজন সংগীতবিদ হতাম। আমি প্রায়ই সংগীত নিয়ে ভাবি, আমি আমার সংগীতের স্বপ্নে বেঁচে থাকি এবং সংগীতের আঙিনায় জীবনকে দেখি।’
হ্যাঁ, বিজ্ঞানী আইনস্টাইন সময় পেলেই সংগীতের জগতে ডুবে যেতেন। আইনস্টাইনের মা পাউলিন একজন ভালো পিয়ানো বাজিয়ে ছিলেন। পাঁচ বছর বয়সে তিনি অ্যালবার্টকে বেহালা কিনে দিয়ে তা শিখিয়ে দেন। তবে অ্যালবার্ট সেখানে তেমন আগ্রহ পেতেন না। তবে মায়ের কারণে পিয়ানোটাও শেখেন।
১৩ বছর বয়সে অ্যালবার্ট একদিন মোৎসার্টের খোঁজ পান এবং তার পরই আক্ষরিক অর্থে ‘সংগীতের প্রেমে পড়েন’। তবে পিয়ানোর চেয়ে বেহালাই ছিল তাঁর প্রধান যন্ত্র। কিছুদিনের মধ্যে বিটোফেনের নানা সুর এবং মোৎসার্টের বিভিন্ন সুরে তিনি পারঙ্গম হয়ে ওঠেন। তবে কোনো পাবলিক অনুষ্ঠানে বাজাতেন না। ১৯৩০ সালের দিকে ম্যাক্স প্ল্যাংকের বাসায় প্রায়ই গানের আসর হতো। আর সেখানে আইনস্টাইন বাজাতেন। প্ল্যাংক গাইতেন।
তত দিনে বিজ্ঞানী হিসেবে আইনস্টাইনের অনেক সুনাম। কিন্তু বেহালা সঙ্গে আছেই! আইনস্টাইনের গবেষণাগার ছিল তাঁর পড়ার ঘর আর যন্ত্রপাতি ছিল কাগজ-কলম। সারা দিনই কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে আঁকিবুঁকি। আইনস্টাইনের স্ত্রী এলসা জানান, যখনই কোনো ভাবনায় মিল পেতেন না, তখনই তিনি হলঘরে এসে পিয়ানোয় বসে পড়তেন কিংবা বেহালা বাজাতে বসে যেতেন। আইনস্টাইন কেবল নিজে বাজাতে ভালোবাসতেন তা নয়, তাঁর শোনার কানও ছিল চমৎকার। তাঁর জীবনীকারেরা অনেকেই মেনুহিনের প্রথম কনসার্টের কথা বলেন। ১৩ বছর বয়সে বাখ ও বিটোফেনের সঙ্গে মেনুহিনের প্রথম কনসার্ট। অনুষ্ঠান শেষে সাজঘরে গিয়ে আইনস্টাইন মেনুহিনের পিঠ চাপড়ে বললেন, ‘আমি এখন জানি স্বর্গে একজন ঈশ্বর আছেন।’
তবে আইনস্টাইনই বিজ্ঞানজগতের একমাত্র লোক নন, যিনি সংগীতজগতের খোঁজ রাখতেন। অনিশ্চয়তা তত্ত্বের জনক ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ চমৎকার পিয়ানো বাজাতেন। ম্যাক্স প্ল্যাংক ছিলেন একাধারে সুরকার ও গায়ক। ইদানীং সুইজারল্যান্ডের সার্নে (CERN) গেলে অনেক পদার্থবিদকে পিয়ানো, বেহালা কিংবা বাঁশি বাজাতে দেখা যায়। কেমব্রিজের লুকাসিয়ান অধ্যাপক থাকার সময় স্টিফেন হকিংয়ের রুমে মাত্র দুটি পোস্টার ছিল। এর একটি, অবধারিতভাবে আইনস্টাইনের। আর অন্যটি মেরিলিন মনরোর!
আকাশচুম্বী অট্টালিকা বানানোর মূল বুদ্ধিটা বের করেছিলেন বাংলাদেশের সন্তান, আমেরিকার নাগরিক ফজলুর রহমান খান। তাঁকে বলা হতো ‘কাঠামোগত প্রকৌশলের আইনস্টাইন’। উইলস টাওয়ার, হ্যাকক টাওয়ার, জেদ্দা বিমানবন্দরের টার্মিনালের মতো বিশ্বের সেরা কিছু স্থাপত্যকর্মের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা। যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের মেয়র অফিসের সামনে তাঁর একটি ব্রোঞ্জের মূর্তি-স্মারক রয়েছে। সেখানেই লেখা রয়েছে তাঁর একটি আপ্তবাক্য। ১৯৭১ সালে ইঞ্জিনিয়ারিং নিউজ রেকর্ড তাঁকে বছরের সেরা প্রকৌশলী ঘোষণা করে (তিনিই একমাত্র প্রকৌশলী, যিনি তিন তিনবার এই সম্মান পেয়েছেন)। পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, প্রযুক্তি আর প্রযুক্তিবিদদের মূল কাজ হলো মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন। সে জন্য তাঁদের অবশ্যই মানুষের কাছাকাছি থাকতে হবে। স্মারক ভাস্কর্যে তাঁর সেই উক্তি খোদাই করা হয়েছে, ‘The technical man must not be lost in his own technology. He must be able to appreciate life; and life is art, drama, music and most importantly people.’ (‘প্রযুক্তিবিদদের অবশ্যই তাঁর প্রযুক্তির নিচে চাপা পড়া চলবে না। তাঁর অবশ্যই জীবনকে উপভোগ করা উচিত; আর জীবন হলো শিল্প, নাটক, সংগীত এবং সর্বোপরি মানুষ।’)