শীতের কুয়াশা জড়ানো সকাল। রাতের জড়তা কাটিয়ে সবে জেগে উঠছে শহরটি। আচমকা প্রচণ্ড এক ঝাঁকুনিতে নড়ে উঠল সবকিছু। ধসে পড়ল ভারতের গুজরাটের ভুজ শহর।
চোখের পলকে চার লাখ ঘরবাড়ি হুড়মুড়িয়ে পড়ল মাটিতে। প্রাণ হারাল ২০ হাজার মানুষ। আহত হলো এক লাখ ৬৭ হাজার। যোগাযোগব্যবস্থা বলতে আর কিছুই রইল না। ঘটনাটি ২০০১ সালের ২৬ জানুয়ারির।
এ ভয়ংকর দুর্যোগে বিপন্ন মানবতার সাহায্যে এগিয়ে এলেন কিছু মানুষ। তাঁদের হাতে ১০০ ওয়াটের একটি ট্রান্সমিটার। গাড়িতে ব্যবহারের উপযোগী ১২ ভোল্টের একটি ব্যাটারি আর কিছু তার। ঘটনাস্থলেই পাওয়া গেল লম্বা একটি বাঁশ। সেটি ব্যবহার করা হলো টাওয়ার হিসেবে। মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে চালু হয়ে গেল বেতারকেন্দ্র। এ কেন্দ্রের সঙ্গে একে একে যুক্ত হলেন ১৫০ ব্যক্তি। হাতে একটি করে ওয়াকিটকি। তাঁরা ছড়িয়ে পড়লেন শহরের সর্বত্র। এরপর পৃথিবী জানল ভুজের মর্মান্তিক দুর্যোগের সংবাদ।
সেদিন যাঁরা এগিয়ে এসেছিলেন, তাঁরা সবাই ছিলেন শৌখিন রেডিও অপারেটর। দুনিয়াজুড়ে তাঁরা পরিচিত ‘হ্যাম’ নামে। শুধু ভারতের কথা কেন, আমাদের দেশে ১৯৯১ সালের সেই ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ের সময়ও রেড ক্রিসেন্টের উদ্ধারকারীদের সঙ্গে কক্সবাজারে ছিলেন একদল হ্যাম। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে কক্সবাজারের পুরো যোগাযোগব্যবস্থা সেদিন অকেজো হয়ে পড়েছিল। এগিয়ে এসেছিলেন একজন জাপানি শৌখিন রেডিও অপারেটর। তাঁর বেতার থেকে সেই খবর ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বে।
দুর্যোগে যখন সবকিছু ধ্বংস হয়ে যায়, যোগাযোগব্যবস্থা বলতে আর কিছুই থাকে না, ঠিক তখনই এগিয়ে আসেন হ্যাম। অ্যামেচার রেডিও বা শৌখিন বেতার যোগাযোগব্যবস্থায় একজন ব্যবহারকারী নিজেই একটি পূর্ণাঙ্গ বেতার গ্রাহক ও প্রেরকযন্ত্রের অধিকারী। এর মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট বেতারতরঙ্গ ব্যবহার করে নিজের শহর, দেশ, এমনকি পৃথিবীর যেকোনো দেশের ওই ধরনের বেতারযন্ত্র ব্যবহারকারীর সঙ্গে তথ্য বিনিময় করা যায়। এর বড় সুবিধা হলো এতে কোনো মাশুল গুনতে হয় না।
মোদ্দা কথা, অ্যামেচার রেডিও হলো একটি শখ। একটি বেতারযন্ত্র দিয়ে অন্য একটি বেতারযন্ত্রে কথা বলা বা তথ্য নেওয়া-দেওয়াই হলো অ্যামেচার রেডিও অপারেটরদের কাজ। এই অপারেটররা পাহাড়ের চূড়া, নিজের বাসা অথবা গাড়িতে বসে চাইলে মহাকাশযানের নভোচারীদের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারেন। নভোচারীদের সবাই হ্যাম। মহাকাশে যাওয়ার সময় তাঁরা সবাই কল-সাইন ব্যবহার করে অন্য হ্যামদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বাংলাদেশের তিন হ্যাম বিভিন্ন সময় নভোচারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, এমন নজিরও আছে। মূলত বেতারযন্ত্রের সাহায্যে অ্যামেচার রেডিও সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিচ্ছে বন্ধুত্বের হাতছানি। উপরি হিসেবে বিপদ-আপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার কাজ তো আছেই।
১৯০৮ সালের দিকে কয়েকজন রেডিও অপারেটর যখন সফলভাবে কোনো তার ছাড়া এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সংকেত পাঠাতে সক্ষম হলেন, সেই সময় তাঁরা নিজেদের হ্যাম বলে ঘোষণা দিলেন। তাঁরা নিজেদের কেন্দ্রে বসে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করলেন। একটি ক্লাব বানিয়ে নাম দিলেন হার্ভার্ড রেডিও ক্লাব। সম্ভবত এটাই বিশ্বে প্রথম রেডিও ক্লাব। এ ক্লাবের সদস্য ছিলেন তিনজন—আলবার্ট এস হাইমেন, বব আলমই ও পুগি মারি। প্রথমে তাঁরা ক্লাবটির নাম দিলেন হাইমেন-আলমই-মারি। ১৯১১ সালে আমেরিকা কংগ্রেস তাঁদের নামের আদ্যক্ষর দিয়ে ক্লাবটির নাম রাখে হ্যাম। সেই থেকে সব অ্যামেচার রেডিও ব্যবহারকারী ‘হ্যাম’ নামে পরিচিত।
থাইল্যান্ডের রাজা ভূমিপাল, সৌদি যুবরাজ তালাল, স্পেনের রাজা হুয়ান কার্লোস, জর্ডানের বাদশা হুসেন, তাঁর স্ত্রী নুর, অভিনেতা মারলন ব্রান্ডো, ডলবি সাউন্ড সিস্টেমের উদ্ভাবক টনি ডলবির মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিও হ্যাম। ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী ছিলেন হ্যামদের কাছে খুব জনপ্রিয়। তাঁর স্ত্রী সোনিয়া গান্ধীও হ্যাম। সোনিয়া গান্ধী এখনো হ্যামদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন। রাজীব গান্ধী নিহত হওয়ার পর তাঁর আততায়ীরা জঙ্গলে কোনো বেতারযন্ত্র ব্যবহার করছে কি না, তা পরীক্ষার জন্য ভারতীয় পুলিশ সেই সময় হ্যামদের সহায়তা নিয়েছিল।
১৯৯২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে হ্যাম রেডিও নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৯২ সাল থেকে একটি পরীক্ষার মাধ্যমে হ্যাম লাইসেন্সে প্রদান শুরু হয়। তোমরা যারা আগ্রহী, তারা বিটিআরসি (www.btrc.gov.bd) থেকে পরীক্ষাসংক্রান্ত তথ্য পেতে পারো।
দেশে ‘বাংলাদেশ অ্যামেচার রেডিও লিগ’ নামে হ্যাম রেডিওর একটি জাতীয় সংগঠন আছে। এর সদস্য প্রায় ২০০। এ-সংক্রান্ত তথ্য জানতে পারো barl.org ওয়েবসাইট থেকে।
হ্যাম হতে চাইলে টেলিফোন রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) ১০০ নম্বরের একটি পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। সে পরীক্ষায় পাস করার পর নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে লাইসেন্স পাওয়া যায়। লাইসেন্সের সঙ্গে পাওয়া যায় ‘কল-সাইন’। কল-সাইন হলো একজন অপারেটরের পরিচিতি। কল-সাইন দিয়েই প্রত্যেককে আলাদা করে চেনা যায়।
সব দেশের জন্য আছে আলাদা কল-সাইন। সেটা শুনলেই বোঝা যাবে ব্যবহারকারীর পরিচয় এবং তিনি কোন দেশের বাসিন্দা। সারা পৃথিবীতে একজনের এককটি মাত্র কল-সাইন থাকবে। তবে অ্যামেচার রেডিও কোনো বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করা যায় না। ধর্মীয় বা রাজনৈতিক আলোচনাও এতে নিষিদ্ধ।
বুঝতেই পারছ, অ্যামেচার রেডিও এমন একটি শখ, যা প্রায়ই শখের সীমা ছাড়িয়ে মানবিকতার মহিমায় ভাস্বর হয়ে ওঠে। হ্যামের দুনিয়া এখন উন্মুক্ত। চাইলে আসতে পারো তুমিও। এখানে বয়সের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।