ভাষার শব্দ সর্বদা যে নির্দিষ্ট একটিমাত্র অর্থই বহন করে, তা নয়। কালে কালে নানা কারণে অর্থ পাল্টায়। এককালে ঘৃণা শব্দের অর্থ ছিল দয়া, করুণা ইত্যাদি, কিন্তু একালে শব্দটির অর্থ দাঁড়িয়েছে বিতৃষ্ণা, অবজ্ঞা ইত্যাদি। এক ভাষার শব্দ অন্য ভাষায় গেলে সেই শব্দের অর্থও পাল্টাতে পারে। আরবি আমলা শব্দের অর্থ সাধারণ কর্মচারী। কিন্তু বাংলায় এসে তা হয়েছে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। মোটকথা, শব্দের অর্থ চিরকাল এক রকম থাকে না। শব্দের অর্থ পরিবর্তনের বিচিত্র কথা নিয়ে এই ‘অভিধানের গল্প’।
কারসাজি
ফারসি ‘কারসাজী’ শব্দ বাংলায় হয়েছে কারসাজি। ফারসি থেকে বাংলায় এসে শব্দটির অর্থের পরিবর্তন ঘটে গেছে। ফারসি ভাষায় কারসাজী শব্দের অর্থ হলো সৃষ্টি, নির্মাণকৌশল। এই কাজ অবশ্যই ভালো লোকের। কিন্তু বাংলা কারসাজি শব্দের অর্থ হলো চালাকি, কূটকৌশল, প্রবঞ্চনা, ছলচাতুরী ইত্যাদি। বলা বাহুল্য, এই কাজগুলো ভালো লোকের নয়, দুষ্ট লোকের।
ঘুণাক্ষর
ঘুণাক্ষরেও টের না পাওয়া বা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে না দেওয়া বাক্যভঙ্গির ঘুণাক্ষর শব্দটির সাধারণ অর্থ হলো ঘুণপোকা কর্তৃক তৈরি করা অক্ষর। কিন্তু এটি ঘুণাক্ষর শব্দের প্রচলিত অর্থ নয়।
ঘুণপোকা নিরবচ্ছিন্নভাবে কাঠ কেটে চলে। দৈবাৎ কোনো কোনো কাটা অংশ কাকতালীয়ভাবে অক্ষরের মতো হয়ে পড়ে। অস্পষ্ট অক্ষরাকৃতির এই কাটাকুটিই হলো ঘুণাক্ষর।
ঘুণাক্ষর স্পষ্ট নয় অস্পষ্ট। ঘুণাক্ষরের মধ্যে বর্ণমালার অক্ষরের একটু-আধটু আভাসমাত্র থাকে। আর এই আভাসটাই ঘুণাক্ষর শব্দের বর্তমান অর্থ তৈরি করতে সহায়তা করেছে। ঘুণাক্ষর শব্দের বর্তমানে প্রচলিত অর্থ হলো সামান্যতম ইঙ্গিত বা আভাস।
ঘুণাক্ষরেও টের না পাওয়া বা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে না দেওয়ার অর্থ তাই ঘটে যাওয়া কাণ্ড বা ঘটনা সম্পর্কে আগে থেকে বিন্দুমাত্র আভাস বা ইঙ্গিত না পাওয়া বা দেওয়া।
দমকা
হাওয়া-বাতাসের সঙ্গেই দমকা শব্দের বেশি সম্পর্ক। যেমন: দমকা হাওয়া, দমকা বাতাস ইত্যাদি। তবে শব্দটি হাওয়া ছাড়াও আরও কিছু বিষয়ের সঙ্গে ব্যবহূত হয়। যেমন: দমকা খরচ বা দমকা খাটুনি। দমকা শব্দের অর্থ হলো সহসা প্রবলবেগে আগত, ঝটিকাবেগে, আকস্মিক সংঘটিত ইত্যাদি।
ফারসি ‘দমগাহ’ শব্দ থেকে বাংলা দমকা শব্দের সৃষ্টি। ফারসিতে দমগাহ একটি যন্ত্রের নাম। বাংলায় এ যন্ত্রের নাম হলো হাপর। হাপর ব্যবহূত হয় হাওয়া সৃষ্টির কাজে। কর্মকারেরা বড় হাপর আর স্বর্ণকারেরা ছোট হাপর ব্যবহার করেন। হাপরে চাপ পড়লে ফস করে হঠাৎ বাতাস বেরিয়ে আসে। অবিরাম বায়ুর জন্য হাপরের হাতল বারবার ওঠাতে-নামাতে হয়। হাপরের এই হঠাৎ হাওয়া বাংলা দমকা শব্দ তৈরিতে প্রেরণা দিয়েছে।
ছত্রভঙ্গ
বাংলায় দুটি ‘ছত্র’ শব্দ আছে। একটি ছত্র ছাতিরূপ ধরে মাথার ওপরে রোদ-বৃষ্টি নিবারক হিসাবে কাজ করে। এই ছত্র আবার একচ্ছত্র, রাজছত্র হয়ে ভাসার অন্য দায়িত্বও পালন করে। এই ছত্র শব্দটি তৎসম, অর্থাৎ সংস্কৃত ভাষা থেকে আগত। দ্বিতীয় যে ছত্র শব্দ, তার চেহারার তেমন বদল হয় না। কথ্য ভাষায় কখনো ছত্তর হয়। যেমন: দুছত্তর লিখে পাঠাও, তবে এর বেশি নয়। এর কারণ হলো, চেহারা বদল করেই শব্দটি আরবি থেকে বাংলায় এসেছে। আরবি ‘সত্র’ শব্দ বাংলায় হয়েছে ছত্র।
আমরা যখন বলি, ছত্রে ছত্রে বানান ভুল, তখন ছত্র শব্দের মূলে কাজ করে আরবি সত্র শব্দটি। সত্র বা ছত্র শব্দের অর্থ হলো লাইন, সারি, পঙিক্ত ইত্যাদি।
ছত্রভঙ্গের ছত্রও সত্র থেকে। ভাষার চরিত্র বড় বিচিত্র। ছত্রভঙ্গ বলতে ভাঙা লাইন বা সারি না বুঝিয়ে আরও বেশি কিছু বোঝায়। ছত্রভঙ্গ হলো বিশৃঙ্খলা, এলোমেলো অবস্থা।
ফাতরা
ফাতরা শব্দটি বিশেষণ হিসেবে ভালো নয়। ফাতরা কাজ, ফাতরা কথা বা ফাতরা লোক বলার সময় সবাই যথেষ্ট বিরক্তিসহ ফাতরা শব্দটি উচ্চারণ করে।
বিরক্তিসহ ব্যবহূত ফাতরা শব্দটি এসেছে কলাগাছ থেকে। কলাগাছের পাতা ধরে টান দিলে পাতার সঙ্গে ফড়ফড় করে যে শুকনা বাকল উঠে আসে, সেটার নামই হলো ফাতরা।
ফাতরা কোনো কাজে আসে না। কলাগাছের পাতাটা দরকারি, কিন্তু ফাতরা নিতান্তই অদরকারি। ফাতরার এই অপ্রয়োজনীয় ও অবাঞ্ছিত বিষয়টাই ভাষায় উপমা
হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
থ
থ ব্যঞ্জনবর্ণের সপ্তদশ এবং ত-বর্গের দ্বিতীয় বর্ণ। কোনো কাণ্ড দেখে অথবা কোনো ঘটনার বিবরণ শুনে আমরা যখন থ হয়ে যাই, তখন আমরা বর্ণমালার থ হই না, আমরা হই শব্দভান্ডারের থ। থ একটি শব্দ আর এই থ শব্দের মূল অর্থ হলো পর্বত।
থ নিশ্চল নিশ্চুপ হয়ে থাকে। বিশেষ পরিস্থিতিতে আমাদের মধ্যেও থ-এর ভাবটা চলে আসে। আমাদের মুখে আর কথা সরে না। আমরা থ-রূপ ধারণ করে থ হয়ে যাই বা থ মেরে যাই। আর এই থ-এর অর্থ তখন দাঁড়ায় হতভম্ব, অভিভূত, কিংকর্তব্যবিমূঢ়, স্তম্ভিত, অবাক, নির্বাক ইত্যাদি। বস্তুত, থ-এর বর্তমান অর্থ এগুলোই।
যথেষ্ট
যথেষ্ট শব্দটা নির্বিচারে ব্যবহূত হয়। যথেষ্ট ভোজন হয়, আবার যথেষ্ট মার বা ক্ষতিও হয়। যথেষ্ট শব্দের বর্তমান অর্থ হলো প্রচুর, অনেক, খুব, ঢের ইত্যাদি।
ঘটনা জানলে যথেষ্ট শব্দটাকে নিয়ে মানুষ বেকায়দায় পড়ে যাবে। কারণ, যথেষ্ট শব্দের মূল অর্থ হলো যথা বা যা ইষ্ট বা ঈপ্সিত। অর্থাৎ, যা মঙ্গলকর ও অভিপ্রেত।
যথেষ্ট খাওয়া হয়েছে বললে যথেষ্ট শব্দের মূল অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়। এখানে দেহের জন্য যেটুকু ইষ্ট, সেটুকুই বুঝে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু একটা লোক যখন যথেষ্ট মার খায়, তখনই ঝামেলা বেধে যায়। কষ্ট কি কখনো ইষ্ট হয়?