১৪ ফেব্রুয়ারি বিমানটি যখন বাংলাদেশের মাটি স্পর্শ করল, আমাদের ১১ জনের জীবনে অনেক কিছুই বদলে গিয়েছে ততক্ষণে। সাত দিন পর আমরা ফিরে এসেছি সূর্যোদয়ের দেশ জাপানে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে।
আয়োজনটির নাম ‘JENESYS 2016’। প্রতিবছর জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন সেন্টার থেকে সার্ক, আসিয়ান, বিমসটেকভুক্ত দেশসহ অনেক দেশে আমন্ত্রণ পাঠানো হয়। নির্বাচন করা হয় স্কুল-কলেজশিক্ষার্থী ও কর্মজীবী তরুণদের। বাংলাদেশে নির্বাচন প্রক্রিয়াটি হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে। মন্ত্রণালয় দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সাক্ষাৎকার শেষে নির্বাচন করে চূড়ান্ত দল। এবার সার্কভুক্ত আটটি দেশের ১৫০ জনকে নিয়ে ছিল এই আয়োজন। মূল উদ্দেশ্য জাপানের সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত করা, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও জ্বালানি খাত সম্পর্কে ধারণা দেওয়া। আমিসহ মোট ১১ জন সুযোগ পেলাম বাংলাদেশ থেকে। সবাই বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় নারিতা বিমানবন্দরে কনকনে ঠান্ডার মাঝে আমাদের বরণ করে নেন সমন্বয়ক মিস হামুরি মোরি। পরদিন জাপানের ইতিহাস, ঐতিহ্য, অর্থনীতি ও দৈনন্দিন জীবনের ওপর একটি বক্তব্য দেন অধ্যাপক হিদেও কিমুরা। জানতে পারি, জাপানে জনগণের এক-তৃতীয়াংশই ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সী। জানলাম, কীভাবে দেশটি এত বড় যুদ্ধ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করেও উন্নতির শিখরে আছে। তারপর গেলাম শিমিনাতো ক্লিন এনার্জি সেন্টারে। শুধু ময়লা-আবর্জনা থেকে উৎপন্ন হচ্ছে বিদ্যুৎ, সরবরাহ করা হচ্ছে শহরে। সেইবু দুর্যোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে গেলাম পরদিন। হাতে-কলমে শিখলাম ভূমিকম্প, অগ্নিকাণ্ড ও ঝড়ে সুরক্ষিত থাকার উপায়। এদিন কামোগাওয়া শহরে মেয়রের সঙ্গেও দেখা করি আমরা।
এর পরদিন মিন্নামিনোসাতো কমিউনিটি সেন্টারে গিয়ে দেখি জাপানি শিল্পের কিছু নমুনা। খাই ঐতিহ্যবাহী খাবার ‘ওয়াশোকু’। কামোগাওয়া সি ওয়ার্ল্ডে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যেই দেখি ডলফিন ও তিমি প্রদর্শনী। প্রশান্ত মহাসাগরের পাশেই আমাদের হোটেল। কেন যেন ওই মহাসমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়েও আমাদের কক্সবাজারকেই বেশি সুন্দর মনে হলো আমার।
পরদিন কামোগাওয়া মিরাই সৌরবিদ্যুৎ প্ল্যান্টের বিশাল কর্মযজ্ঞ দেখে বিস্মিত হলাম আমরা। সেই রেশ না কাটতেই শুরু হলো সবচেয়ে আকর্ষণীয় আয়োজন হোম স্টে। জাপানের দৈনন্দিন জীবন ও দেশের মানুষকে একদম কাছ থেকে দেখার সবচেয়ে বড় সুযোগ এটা। সম্পূর্ণ অচেনা জায়গায় পাহাড়ের ওপর এক বাসায় দুই দিন থাকলাম। আমরা ছিলাম ৮৩ ও ৭৭ বছর বয়সী ‘শিবাসাকি’ দম্পতির পরিবারে। নির্মল বাতাস ও স্বাস্থ্যকর খাবারের মধ্যে থাকায় তাঁদের শরীরের বল আমাদের তুলনায় অনেক বেশি। আমাদের সবার খাবার রান্না, পরিবেশন, ধোয়ামোছা সবই করলেন তাঁরা। শুধু একটি জাপানি ভাষার ছোট বইয়ের ওপর নির্ভর করে চলতে থাকে আমাদের কথাবার্তা। কঠিন হলেও অভিজ্ঞতাটি ছিল অসাধারণ। ওই বাসা থেকেই জীবনে প্রথমবারের মতো উপভোগ করলাম তুষারপাত। তুষারপাতের মধ্যে পাহাড়ে ওঠার স্মৃতি, রাতের বেলা স্নো ফাইট খেলা—সে এক অসাধারণ ব্যাপার। ফেরার সময় দিয়ে আসা বাংলাদেশের কাঠের মানচিত্রটি হয়তো এখনো শোভা পাচ্ছে তাদের ড্রয়িংরুমে।
এই পরিবারটি ছেড়ে আসার আগে বিদায়ী অনুষ্ঠানে আমরা বাংলাদেশি ছেলেরা পরে যাই লুঙ্গি/পায়জামা-পাঞ্জাবি, মেয়েরা পরেছিল শাড়ি। তাদের উৎসর্গ করে গাওয়া ‘আমি বাংলায় গান গাই’ যখন পুরো মিলনায়তনকে নিশ্চুপ করিয়ে দেয়, বাংলাদেশি হিসেবে বেশ গর্ব হচ্ছিল তখন।
অনুষ্ঠান শেষে হোটেলে ফিরে অংশ নিলাম কর্মশালায়। নির্দেশনা অনুযায়ী পরদিন ‘অ্যাকশন প্ল্যান’ উপস্থাপন করি রাজধানী টোকিওতে। প্রেজেন্টেশন হলে উপস্থিত ছিলেন সার্কভুক্ত দেশগুলোর রাষ্ট্রদূত আর জাপান সরকারের প্রতিনিধিরা। এত সব গণ্যমান্য ব্যক্তির সামনে যখন নিজ দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে উঠি, স্বাভাবিকভাবেই বেশ ভয়ে ছিলাম। তবে উপস্থাপনা শেষে সবগুলো দেশের মধ্যে ‘সেরা উপস্থাপনা’র তকমা পেলাম আমরাই। রাষ্ট্রদূতদের ব্যক্তিগত প্রশংসা পাওয়ার চেয়েও বেশি ভালো লাগছিল নিজ দেশের জন্য কিছুটা হলেও গৌরব এনে দিতে পারায়। এর চেয়ে গর্বের অনুভূতি মনে হয় অন্য কিছুতেই পাওয়া সম্ভব নয়।