১৫-১৬ বছর বয়সী কেউ যখন তার কোনো দুঃখের গল্প বলতে আসে, বেশির ভাগ সময়ই বড়রা খুব একটা পাত্তা দেয় না। ‘আর কিছু না, সব বয়সের দোষ’ বলেই খুব একটা সমাধান দিয়ে ফেলেছে ভঙ্গিতে উপদেশ দেয়। একদিন এই বয়সী এক ছোট বোন মুখ ভার করে তার দুঃখের গল্প বলতে এল। ঘটনা শুনে আমি একদমই বয়সের দোষ দিতে পারলাম না, বরং খানিকটা ব্যথিত হলাম। জন্মগতভাবেই মেয়েটার চোয়াল খানিকটা বাঁকা। এ জন্য সহপাঠীদের কেউ কেউ তাকে ‘প্রতিবন্ধী’ বলে পরিহাস করে। কথাগুলো বলার সময় তার চোখ ছলছল করছিল।
বিখ্যাত আইরিশ লেখক ও চিত্রকর ক্রিস্টি ব্রাউনকেও এমন অনেক মন্দ কথা শুনতে হয়েছে। ছোটবেলাতেই তাঁর মাকে ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘সেরেব্রাল পলসি’ মানে মস্তিষ্কের এই অসুখের জন্য পুরো শরীর অচল হয়ে থাকবে ক্রিস্টির। শুধু বাঁ পা ছাড়া আর কোনো অংশই নাড়ানোর ক্ষমতা ছিল না তাঁর। তাঁকে প্রতিবন্ধী কেন্দ্রে ভর্তি করার পরামর্শও দিয়েছিলেন ডাক্তার। কিন্তু তাঁর মা তাকে অন্য ভাইবোনদের সঙ্গে বাড়িতেই বড় করার সুযোগ দেন। ফলাফলটাও হয় যথার্থ! একসময় সেই বাঁ পা দিয়েই চমত্কার সব ছবি এঁকে সবাইকে চমকে দেন ক্রিস্টি। তাঁর লেখা আত্মজীবনী মাই লেফট ফুট প্রকাশিত হওয়ার পর হইচই পড়ে যায় রীতিমতো। এই বইকে কেন্দ্র করে বানানো মুভি ১৯৮৯ সালে অস্কার পুরস্কারও জিতে নেয়। গতানুগতিক কজন সুস্থ মানুষ এমন প্রতিভার বিকাশ করতে পারে, বলো?
ইন্দোনেশিয়ার ২৫ বছর বয়সী তরুণ আলোকচিত্রী আহমেদ জুলকারনাইনেরও সেই একই কথা। তাঁর ছবিগুলো যেন মূল্যায়ন করা হয় প্রতিভার বিচারে। সে কে বা কোথা থেকে এসেছে সেটা দিয়ে নয়। আহমেদ জুলকারনাইনের গল্পটাও বেশ চমত্কার।
ইন্টারনেট ক্যাফে নামক ছোট্ট এক দোকানে কাজ করতেন তিনি। হঠাৎ খেয়াল চাপল, ফটোগ্রাফি শিখবেন। সবাই তাঁর ইচ্ছার কথা শুনে অবাক! জন্মগতভাবে যাঁর হাত-পা নেই, তিনি কেমন করে ফটোগ্রাফি শিখবেন? তবু পরিবার আর কয়েকজন বন্ধুর সমর্থনে একটা ক্যামেরা কিনে ফেলেন তিনি। গভীর আগ্রহে শিখতে থাকেন ফটোগ্রাফি।
নিজের সুবিধামতো শিখে নেন ক্যামেরা চালানো। কখনো চোয়ালের অংশ দিয়ে জুম, ফোকাস বা আইএসও পরিবর্তন করা আবার কখনো মুখ দিয়ে ক্যামেরা অন-অফের কাজ—সবকিছুই ধৈর্য নিয়ে শেখেন। আর হাতের অংশবিশেষ দিয়েই কায়দা করে শাটারে ক্লিক করেন।
ফটোগ্রাফি বিদ্যা পুরোপুরি আয়ত্তে এনে কাজে নেমে যান আহমেদ। কিছুদিনের মধ্যেই এলাকাজুড়ে তাঁর কাজের খ্যাতি ছড়িয়ে যায়। বন্ধুদের কাছ থেকে পাওয়া ডাকনামেই নিজের ফটোগ্রাফি স্টুডিওর নাম রাখেন ‘ডিজুয়েল’। তাঁর তোলা নিপুণ ছবি দেখে বোঝার সাধ্য কার, সেটা মুখ দিয়ে তোলা নাকি পাকা হাতের কাজ!
ছবি তোলার জন্য পাহাড়-পর্বতের চূড়াতেও উঠতে ভয় পান না আহমেদ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২ হাজার ৮০০ মিটার উঁচু মাউন্ট আইজেনের চূড়াতে উঠেও ছবি তুলেছেন তিনি। একবার তো একটা চূড়া থেকে প্রায় পড়েই গিয়েছিলেন, কিন্তু কিছুদূর গড়িয়ে পড়লেও তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি তাঁর। ধাতস্থ হয়েই তিনি প্রথম খেয়াল করেছিলেন ক্যামেরাটা ঠিকঠাক আছে কি না, শরীরের আঘাত তাঁকে আর চিন্তিত করে না। যে ক্যামেরাটা তাঁকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে, সেটাকেই প্রাধান্য দেন তিনি।
বন্ধু আর পরিবারের সহযোগিতায় নিজেই ছোট্ট একটা স্কুটি যান তৈরি করে নিয়েছেন জুলকারনাইন। কাজ ছাড়াও আশপাশের জগত্টাকে ঘুরে ঘুরে দেখেন সেটাতে চড়ে। প্রতিবন্ধী বলে এখনো কটুকথা বলে লোকে। তবে সেসবে কান দেন না আহমেদ। তাঁর মতে, ‘নিজেকে সেরা প্রমাণ করতে চাইলে ভুলে যাও তুমি অকেজো কি না। কাজের ক্ষেত্রে সেরা হতে নিজেকে পারফেক্ট হতে হয় না।’
নিজের স্টুডিওতে ফটোগ্রাফিও শেখান এই আলোকচিত্রী। সম্প্র্রতি আল-জাজিরা সংবাদমাধ্যম তাঁকে নিয়ে ভিডিও-ফিচার তৈরি করলে সবার মনোযোগ কাড়েন তিনি।
শারীরিক বা মানসিক সীমাবদ্ধতা থাকা মোটেও দোষের কিছু নয়। কিন্তু সেটা নিয়ে মন্দ কথা বলা রীতিমতো অপরাধ। অনেক সময় এমন স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে না বুঝেই বন্ধুদের সঙ্গে ঠাট্টা করি আমরা। ভেবে দেখো, তুমি আবার তোমার বন্ধুকে এমন কোনো বিষয় নিয়ে ঠাট্টা করতে গিয়ে কষ্ট দিচ্ছ না তো?
তথ্যসূত্র: মেট্রোডটইউকে ও বোরডপান্ডা