একবার চিন্তা করে দেখা যাক, লিখনপদ্ধতি বা লিপির প্রচলন না থাকলে কী সর্বনাশটাই না হতো! গ্যালিলিও দাদু কবে কী আবিষ্কার করে রেখে গেছেন, তার খোঁজ আমরা পেতাম না। সুকুমার রায়ের মজার মজার ছড়া পড়তে পারতাম না। দূরের কারও সঙ্গে যোগাযোগ করাটাও মুশকিল হয়ে যেত। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়া যেত না। কিশোর আলোও পড়া যেত না। কিন্তু আমরা খুব ভাগ্যবান যে এমনটি হয়নি। লিখনপদ্ধতির মতো খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় আমরা পেয়েছি। আচ্ছা, এই দারুণ জিনিসটাকে সব সময় একইভাবে লিখতে হবে, এমন কোনো কথা আছে? যদি একটু অন্য রকম করে, আরও সুন্দর করে রংচং মেখে লিখি, তাহলে কেমন হয়? সব সময় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের স্টাইলেই লিখতে হবে কেন? (ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা লিপির ডিজাইনার) সৃজনশীল মানুষ সব সময়ই একটা নতুন কিছু চায়। লিপির ক্ষেত্রেও তা-ই। এই অন্য রকম করে লেখার ইচ্ছা থেকেই ক্যালিগ্রাফি, লেটারিং, টাইপোগ্রাফি ইত্যাদি শিল্পের জন্ম ঘটে। আচ্ছা ঠিক কোনটা ক্যালিগ্রাফি, কোনটা লেটারিং আর কোনটাই বা টাইপোগ্রাফি?
ক্যালিগ্রাফি হচ্ছে সেই ভদ্রগোছের সৃজনশীল শিল্পীদের কাজ, যারা মায়ের সুবোধ বালক, কিন্তু নতুন কিছু করার চেষ্টা করে। ক্যালিগ্রাফি শব্দের উৎপত্তি গ্রিক দুটি শব্দ ‘kallos’ (সৌন্দর্য) আর ‘graphein’ (লেখা) থেকে। এটা লেটারিংয়েরই একটা ধরন, কিন্তু লেটারিংয়ের সংজ্ঞা থেকে অনেক আলাদা। ক্যালিগ্রাফি হচ্ছে মূলত হাতে লেখার শিল্প। তুমি সাধারণভাবে খাতায় যখন লেখো, সেটাতেও একটু শৈল্পিক ছোঁয়া দিলে, সেটাও ক্যালিগ্রাফি হয়ে যাবে। ক্যালিগ্রাফি সাধারণত ব্রাশ অথবা ক্যালিগ্রাফি পেন দিয়ে ট্র্যাডিশনালি এক স্ট্রোকে করতে হয়। ক্যালিগ্রাফি হাতের লেখা বা সিগনেচারের মতো। এটা সহজপাঠ্য হতে পারে আবার না-ও হতে পারে। ক্যালিগ্রাফি অত্যন্ত প্রাচীন একটি শিল্প হলেও তা এখনো বহুল প্রচলিত।
ক্যালিগ্রাফি বলতে বোঝানো হয় লেখা, আর লেটারিং হচ্ছে আঁকা। লেটারিংয়ে অক্ষরগুলোর নিজস্ব একটা ভঙ্গি আছে। ধরা যাক, একটা আম লিখলে যেটার আকার দেখতে একেবারে আমের মতোই। এটা লেটারিং। ক্যালিগ্রাফিকে যদি ডেকোরেশন করা হয়, তাহলে সেটাও লেটারিং হয়ে যাবে। মূলত অক্ষরগুলোকে প্রাণবন্ত ও সুদৃশ্য করাই লেটারিং। লেটারিং একাধিক স্ট্রোকের হয়। লেটারিংকে ‘faux calligraphy’-ও বলা হয়। এতে অক্ষরের ওপর শিল্পীর বেশি স্বাধীনতা থাকে। ক্যালিগ্রাফির মতো অত বেশি ডিসিপ্লিন মেনে চলতে হয় না। তবে লেটারিংয়েরও আছে নিজস্ব ডিসিপ্লিন। অনেকটা নিয়ম ভাঙার নিয়মের মতো।
আমরা লেখা জাতীয় সবকিছুকেই একসঙ্গে টাইপোগ্রাফি বলি। কিন্তু শাস্ত্রমতে সবগুলোই টাইপোগ্রাফি নয়। টাইপোগ্রাফিও ক্যালিগ্রাফির মতো সুনির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলে। ক্যালিগ্রাফির চেয়েও এটা বেশি নিয়ম মেনে চলে। তুমি এখন কিশোর আলোয় যেসব ফন্টের লেখা পড়ছ, সেগুলোই টাইপোগ্রাফি। টাইপোগ্রাফিতে শিল্পের ব্যবহার যতটা বেশি, তার চেয়েও ঢের বেশি ডিজাইনের বাঁধাধরা নিয়মের ব্যবহার। টাইপোগ্রাফির একটা বিষয় হচ্ছে টাইপফেস। একটা সম্পূর্ণ ফন্টসেটকে টাইপফেস বলে। ফন্টসেটের প্রতিটি অক্ষর একই স্টাইলের হয়, সবগুলো অক্ষরের উচ্চতা ও দূরত্ব নিয়মানুযায়ী হয়ে থাকে। আবার বিল্ট ইন ফন্ট দিয়ে লেখা সাজানোটাও টাইপোগ্রাফিতে পড়ে। কোন জায়গায় কোন রঙের লেখা বসবে, কোন ফন্টের সাইজ কত হবে, টাইটেলে কী টাইপফেস থাকবে, প্যারাগ্রাফে কী থাকবে—এসব সাজানোটাও টাইপোগ্রাফির অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ তুমি কীভাবে লেটার ব্যবহার করবে, সেটাই টাইপোগ্রাফি।
টাইপোগ্রাফি হলো ‘টাইপ তৈরি ও ব্যবহার করার শিল্প’। আর একটা ব্যাপার, টাইপ ডিজাইনাররা টাইপফেস অথবা ফন্ট বানান, আর গ্রাফিক ডিজাইনাররা সেই টাইপফেস তাঁদের মতো সাজিয়ে ডিজাইনে ব্যবহার করেন। টাইপোগ্রাফির ব্যাপারটা আরও ভালো করে জানতে চাইলে থিংকিং উইথ টাইপ বইটা পড়ে ফেলতে পারো।
ক্যালিগ্রাফি, টাইপোগ্রাফি, লেটারিং—এ বিষয়গুলো অত্যন্ত মজার। যে কেউ চাইলেই এগুলোর চর্চা করতে পারে। হাতের লেখা এগুলোর জন্য মোটেই কোনো প্রতিবন্ধক নয়। হাতে-কলমের পাশাপাশি এসব ডিজিটাল মাধ্যমেও করা যায়। ডিজিটালে ফটোশপ আর ইলাস্ট্রেটর রয়েছে। তবে ফটোশপের চেয়ে ইলাস্ট্রেটরই বেশি ভালো হবে। কারণ, ইলাস্ট্রেটরে ভেক্টর ডিজাইনের জন্যই তৈরি। ট্র্যাডিশনালি ক্যালিগ্রাফি, লেটারিংয়ের জন্য কালি, কলম, পেনসিল, তুলি ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। কলমগুলো নানা রকমের হয়। একেক স্টাইলের জন্য একেক কলম ব্যবহার করা হয়। আমাদের দেশে ক্যালিগ্রাফি কলম খুব একটা সহজলভ্য নয়। তবে খুব সহজে ঘরে বসেই ক্যালিগ্রাফি কলম তৈরি করা যায়। বাঁশের কঞ্চি, আইসক্রিমের স্টিক, কোকের ক্যানের টুকরা থাকলেই হয়ে যায়। ইউটিউবে কীভাবে কলম তৈরি করতে হয়, তা নিয়ে অনেক ভিডিও রয়েছে। আর নতুনদের জন্য কালির হিসেবে ফাউন্টেইন পেনের কালি বা ড্রাফটিং পেনের কালি ব্যবহার করা ভালো। চাইনিজ ইংক মোটামুটি সব স্টেশনারিতেই পাওয়া যাবে। বিভিন্ন কালির মধ্যে তোমার যেটা দিয়ে কাজ করতে ভালো লাগবে, সেটা দিয়েই কাজ করবে।
আজকাল বাংলা ক্যালিগ্রাফি ও লেটারিং আবার অনেক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বাংলা ক্যালিগ্রাফির জন্য ফেসবুকে একটি গ্রুপ রয়েছে, নাম ‘মাত্রা’। fb.com/groups/matra.bangla এই লিংকে গিয়ে তোমরা গ্রুপে যুক্ত হয়ে যেতে পারো। এখানে নিজেদের কাজ শেয়ার করে, অন্যের কাজ দেখে দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারো। এ ছাড়া ডিজাইন প্রতিদিন (designprotidin.com) নামক একটি ওয়েবসাইটেও বাংলা ডিজাইন বিষয়ে নানা ধরনের লেখা দেখতে-পড়তে পারো। লেটারিং নিয়ে বেশ কিছু পোস্ট আছে সেখানে। এ ছাড়া ফেসবুকে ‘রয়েলের ছবি’ পেজটাতেও আছে মজার কিছু কাজ। কলকাতার ‘ডুডলার্স’ পেজটাও ঘুরে দেখতে পারো। তারপর শুধু কালি, তুলি আর কলম হাতে খেলার অপেক্ষা।