বনে বনে ঘনিয়ে আসছে ছায়া। মেঘ ডাকছে। এখন শ্রাবণ মাস, বর্ষাকাল। ঝিঙে ফুলের মতো ফুটে ওঠা সন্ধ্যায় কোনো ঝোপের ভেতর থেকে ঝিঁঝি আর জলার পাশ থেকে ডেকে উঠছে ব্যাঙের দল। থই থই বৃষ্টি এসে ভাসিয়ে দেবে নদী–বিল–জলা। পদ্ম–শাপলার রং ধারণ করবে গোটা বিল। প্রকৃতি সবুজ হয়ে উঠবে। আর চারদিকে ফুটবে বিচিত্র সব ফুল। সুন্দর। জলে জলে বদলে যাবে প্রকৃতির রূপ। চারদিক হয়ে উঠবে অপরূপ।
বর্ষার এই নবধারা জলে ঝরনা, নদী, মাঠ ও বন সব কেমন বদলে যায়। আকাশে প্রশান্তি নেমে আসে। যেন প্রকৃতির ওপর আরেকটি নতুন প্রকৃতি জেগে ওঠে। শীতল হয়ে আসে ঘুঘুর ডাক, শীতল ভঙ্গিমায় সূর্য ওঠে। এত দিন পতঙ্গসহ যারা প্রচণ্ড দাবদাহে হাঁসফাঁস করেছিল, বেদনার কথা ভুলে তারাও শান্ত হয়ে যায়। এত দিন যেসব পিঁপড়া ও পতঙ্গ মাঠ থেকে তিল কিংবা মুগ ফুলের মধু চুষে নিয়ে গেছে ঘরে, এবার তারা বৃষ্টির কণা মুখে করে নেমে যাবে মাটির বহু নিচে। সঙ্গীদের কাছে পাঠাবে বৃষ্টির সংকেত। দলবদ্ধ হয়ে কিছুদিন আয়েশে কাটাবে এই সব পিঁপড়া ও পতঙ্গের দল। সঙ্গীকে দেবে সমূহ সময়।
বর্ষার বৃষ্টির সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রেম ও বিরহ। এ ঋতু প্রণয়ের। তাই বুকের ভেতর থেকে থেকে জেগে ওঠে সুন্দর সম্পর্কের স্মৃতি। হঠাৎ আকাশ মেঘ করে এল বা শুরু হয়ে গেল ঝুম বৃষ্টি। এমন সময় হয়তো প্রিয়জনের কথা মনে পড়ে গেল। এই আধুনিক যুগে হয়তো একটা ফোনকল বা বার্তা পাঠিয়ে সেই প্রিয়জনের কাছে বার্তা পাঠানো যাচ্ছে। কিন্তু আগে এসব সুযোগ ছিল না। আগে এই সুন্দর কাজ মেঘ বা বৃষ্টির মাধ্যমে হতো।
কালিদাসের মেঘদূত পড়েছ? আনুমানিক ৩৫০ খ্রিষ্টাব্দে লেখা কালিদাসের মেঘদূত–এ এই ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়। ঐশ্বর্যের দেবতা কুবেরের বাগানের কাজে নিয়োজিত ছিল যক্ষ। প্রেমিকার সঙ্গ ছাড়তে না পেরে দায়িত্বে অবহেলা করে যক্ষ। এই অপরাধে কুবের তাকে রামগিরি পর্বতে নির্বাসনে পাঠায়। রামগিরিতে নির্বাসনে থেকে প্রেমিকার বিরহে কাতর যক্ষ। আষাঢ়ের প্রথম দিন পাহাড়ের দিকে সঞ্চারিত মেঘরাশি দেখে অলকানগরীতে থাকা প্রেমিকার কথা মনে পড়ে তার। এই মেঘ তো ভেসে ভেসে যাবে। তাই মেঘকে দূত হিসেবে অলকানগরীতে থাকা প্রেমিকার কাছে প্রেমবার্তা পাঠানোর মনস্থির করে যক্ষ। মেঘ একসময় যক্ষের প্রেমবার্তা নিয়ে পৌঁছে যায় যক্ষপ্রিয়ার কাছে। সে সময় বার্তা পাঠানোর জন্য যক্ষের কাছে মেঘই ছিল ই–মেইল।
মাঝেমধ্যে বনবাদাড় কাঁপিয়ে বৃষ্টি আসে। মনে হয় যেন চারদিক কাঁপিয়ে ধেয়ে আসছে মহাকালের ঘোড়া। এই বৃষ্টির সঙ্গে বই পড়ারও একটা সুন্দর সম্পর্ক আছে। বিশেষ করে ভূতের গল্পের সঙ্গে এই বৃষ্টির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। টেবিলের ওপর থাকা আর সব বইয়ের ভেতর থেকে আধো অন্ধকার ঘরে গা ছমছমে ভয়ংকর প্রচ্ছদের বই উজ্জ্বল আলো হয়ে তাকিয়ে থাকে। একবার বই কাছে টেনে নিলে শেষ না করে উপায় থাকে না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা টানা বই পড়ার এক দারুণ অভ্যাস এই বৃষ্টির দিনেই গড়ে তোলা সম্ভব।
তানসেনের কথা জানো? বৃষ্টির সঙ্গে তানসেনের সম্পর্ক কী, এটা জানার আগে জেনে নাও, সুরসম্রাট তানসেন ভারতীয় ধ্রুপদি সংগীতের ঐতিহাসিক কিংবদন্তি। মোগল সম্রাট আকবরের দরবারে নবরত্ন সভার অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। ষোড়শ শতকের ভারতে সংগীতের ধারায় এক নতুন পথ দেখিয়েছিলেন তিনি। কথিত আছে, মেঘমল্লার রাগে গান গেয়ে তানসেন আকাশ থেকে বৃষ্টি ঝরাতে পারতেন। তানসেনের মতো সুর দিয়ে না হলেও এখনো বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বৃষ্টির প্রার্থনায় বিভিন্ন লোকাচার পালন করা হয়।
বৃষ্টি এতটাই প্রয়োজনীয় যে সঠিক সময়ে বৃষ্টি না হলে বাংলার নানা ধর্ম, বর্ণ ও সম্প্রদায়ের মানুষ বৃষ্টির জন্য আদি সংস্কৃতি ও লোকসংস্কৃতি অনুযায়ী বিভিন্ন লোকাচার পালন করেন। বৃষ্টি নিয়ে বাংলার লোকজ সংস্কৃতি বেশ সমৃদ্ধ। গ্রামে এখনো এসব সংস্কৃতির দেখা মেলে।
এসব লোকাচারের মধ্যে সুন্দর ও বহুল প্রচলিত একটি হলো ব্যাঙের বিয়ে। কোনো জলা থেকে এক জোড়া ব্যাঙ ধরে এনে স্থানীয় গীত গাইতে গাইতে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দেওয়া হয়। ব্যাঙের মাথায় দেওয়া হয় পাতার টোপর। ব্যাঙের গায়ে হলুদ মাখানো হয়। এই বিয়ে উপলক্ষে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদার মতো সবজি ও চাল সংগ্রহ করা হয়। এই বিয়ে উপলক্ষে চলে ভূরিভোজ। স্থানীয় লোকজনের বিশ্বাস, ব্যাঙের বিয়ে দিলে মেঘ সন্তুষ্ট হবে। বৃষ্টি নেমে আসবে ধরায়। জলের অভাবে শুকিয়ে যাওয়া মাঠ সবুজ হয়ে উঠবে।
আবার কোথাও কোথাও বৃষ্টি নামানোর জন্য কাদা মাখানোর প্রথাও রয়েছে। মেয়েরা পানিভর্তি কলসি নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে হাজির হয়। তারা শুকনা উঠানে পানি ঢেলে কাদা তৈরি করে একে অন্যের গায়ে কাদা ছিটিয়ে দেয়। বৃষ্টি নামানোর প্রথা থেকে শুরু করে বৃষ্টি আসা পর্যন্ত দেশের নানা প্রান্তে একটা উৎসব উৎসব আমেজ বিরাজ করে। এসবই বর্ষার সুন্দর ছবি।
বৃষ্টি আসার ঠিক আগের মুহূর্তটা সবুজ মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছ? মনে হবে যেন বহুদূর থেকে বিশাল মেঘ ডানা মেলে আসছে। ধীরে ধীরে বিস্তীর্ণ মাঠের ওপর ছড়িয়ে দিচ্ছে কালো শামিয়ানা। এরপরই নেমে আসবে বৃষ্টির ঝুম। এই বৃষ্টি মানে প্রকৃতির আনন্দ। এই জল নদী ও জলায় দেবে মায়ের স্নেহের মতো থই থই পানি। দেবে নতুন জীবনের আগমনী বার্তা। গাছে গাছে সবুজ পাতা আর বহু বর্ণের ফুল ফুটে উঠবে। মাটিতে ছড়ানো–ছিটানো অথবা অযত্নে পড়ে থাকা বীজ থেকে গজাবে চারা। এই নরম চারা একদিন গাছ হবে। ছায়া দেবে। আগলে রাখবে মাটিকে, প্রকৃতিকে। সবুজে সুন্দর হয়ে উঠবে এ ধরা।