বৈদ্যুতিক সাবমেরিন
জুল ভার্নের বিখ্যাত উপন্যাস টোয়েন্টি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার দ্য সি। ১৮৬৯ সাল থেকে ১৮৭০ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে এই উপন্যাস প্রকশিত হয়। এই উপন্যাসের ভেতরে ছিল ১১১টি আঁকা ছবি। উপন্যাসে ক্যাপ্টেন নিমো চরিত্র চালান বিশাল এক বৈদ্যুতিক সাবমেরিন। নাম নটিলাস। এই সাবমেরিনে চেপে ক্যাপ্টেন নিমো মহাসাগরের নিচে ভ্রমণ করতেন। জুল ভার্নের এই বইটিতে ক্যাপ্টেন নিমোর সাবমেরিন চলত বিদ্যুতের সাহায্যে। সাবমেরিনের অন্য সব যন্ত্রাংশ দ্রুত আর সহজভাবে চলার জন্য বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হতো।
নাটিলাস সাবমেরিনে আধুনিক সাবমেরিনের মতো সব সুযোগ–সুবিধা ছিল। ছিল ডাইনিং রুম। বাস্তবে ১৮৮৮ সালে প্রথম একটি বৈদ্যুতিক সাবমেরিন সমুদ্রে নেমেছিল। ১৯৬৪ সালের অ্যালভিন সাবমারসিবলে ডুব দিয়েছিলেন তিন অভিযাত্রী। সাবমেরিনের ছোট ভার্সন সাবমারসিবলটি ছিল সিসা-অ্যাসিডের ব্যাটারি বিদ্যুচ্চালিত। অ্যালভিনের মতো জুল ভার্নের কল্পনার নটিলাসও ছিল পুরোপুরি বিদ্যুতে চালিত। যখন জুল ভার্নের কল্পনার নটিলাস তখনকার দিনের জন্য অভাবনীয়। এখন এই প্রযুক্তি খুব স্বাভাবিক। বাংলাদেশ নৌবাহিনীরও আছে দুটি সাবমেরিন। পৃথিবীর বহু দেশের সামরিক বাহিনী সাবমেরিন ব্যবহার করে। তবে সমুদ্রের তলদেশে ঘুরে বেড়ানোর জন্য অত্যাধুনিক কোনো ডুবোজাহাজের কল্পনা অভাবনীয় বটে।
লাইভ সংবাদ প্রচার
১৮৮৯ সালের একটি লেখা ইন দ্য ইয়ার ২৮৮৯–এ জুল ভার্ন সংবাদপত্রের বিকল্প কল্পনা করেছিলেন। ছাপার পরিবর্তে আর্থ ক্রনিকল নামে একটি সংবাদ প্রচার করা মাধ্যম প্রতিদিন সকালে গ্রাহকদেরকে খবর জানায়। সে এই খবর সংগ্রহ করেছে সাংবাদিক, রাষ্ট্রপ্রধান আর বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলে।
বাস্তবে টেলিভিশনে সংবাদ প্রচার ১৯২০ সাল পর্যন্ত শুরু হয়নি। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের তথ্য অনুযায়ী, জুল ভার্ন এটি কল্পনা করার প্রায় ৩০ বছর পরে টেলিভিশনে খবর প্রচারিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সিবিএস নিউজ প্রথম নেটওয়ার্ক টেলিভিশন কেব্লের মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছে লাইভ সংবাদ প্রচার করেছিল। অবশ্য এ জন্য আরও ২৮ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। ১৯৭৪ সাল লাখো মানুষ মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের পদত্যাগ টিভিতে দেখেছেন।
আকাশে লেখা
জুল ভার্ন চারপাশের জগৎ খুব মন দিয়ে দেখতেন। যেসব বিষয়ে তিনি মনোযোগ দিয়েছিলেন, তার মধ্যে একটি বিজ্ঞাপন। ইন দ্য ইয়ার ২৮৮৯-এ তিনি ধারণা দিয়েছেন বায়ুমণ্ডলীয় বিজ্ঞাপনের, যা এখনকার বিমান বা ড্রোনের সাহায্যে আকাশে লেখার মতো। আশি-নব্বইয়ের দশকে যুক্তরাষ্ট্রে আকাশে ধোঁয়ার সাহায্যে লেখা বিজ্ঞাপন বেশ জনপ্রিয় ছিল। বিমানের সাহায্যে সাধারণত এই লেখা হতো। এখন বিশ্বজুড়ে বহু অনুষ্ঠানে ড্রোনের মাধ্যমে আলো ফেলে আকাশে লেখা হয়।
জুল ভার্নের সায়েন্স ফিকশনে লেখা ছিল, ‘সবাই মেঘ থেকে প্রতিফলিত সেই বিশাল বিজ্ঞাপন দেখেছে। লেখা এত বড় ছিল, পুরো শহর, এমনকি পুরো দেশর সবাই দেখতে পেরেছে।’ বাস্তবেও এখন দূর থেকে আকাশে বিজ্ঞাপন দেখা যায়।
টিজার
জুল ভার্নের কল্পনার প্রিয় বিষয় ছিল যানবাহন। তবে তিনি এমন অস্ত্র নিয়েও লিখেছেন যা তখন বাস্তবে ছিল না। যেমন টোয়েন্টি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার দ্য সি-তে তিনি একটি বন্দুকের বর্ণনা দিয়েছেন। যেটি খুব শক্তিশালী বৈদ্যুতিক ঝাঁকুনি (ইলেকট্রিক শক) দেয়, অনেকটা যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশের ব্যবহার করা টিজারের মতো। পুলিশ হুমকি মনে করলে বা কারও দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হলে টিজার ব্যবহার করে। টিজার ইলেকট্রিক শক দিয়ে ব্যক্তিকে অবশ করে ফেলতে পারে কিছু সময়ের জন্য।
জুল ভার্ন লিখেছিলেন, ‘এই বন্দুক দিয়ে ছোড়া গুলি সাধারণ গুলির মতো নয়। কাচের ছোট ছোট বল এই বন্ধুক দিয়ে ছোড়া যায়। এই বল ইস্পাত দিয়ে আবৃত। গুলি ভারী করার জন্য ব্যবহার করা হয় সিসা। বন্দুকটি আসলে লেইডেনের বোতল। আঠারো শতকে স্থির তড়িৎ সংরক্ষণ করতে কাচের বোতল ব্যবহার করা হতো। বোতলে বিদ্যুৎ জমা করতে বিভব পার্থক্য তৈরি করা হতো। চার্জের এই পার্থক্যের কারণে খুব জোরে ধাক্কা বা শক দেওয়া সম্ভব ছিল। জুল ভার্নের সেই বন্দুকের গুলির সামান্য ধাক্কাতেই ইলেকট্রিক শক বের হয়। এর আঘাতে প্রাণী যত শক্তিশালীই হোক, মরে যায়।
সোলার সেইল
জুল ভার্ন ১৮৬৫ সালের সায়েন্স ফিকশন ফ্রম আর্থ টু দ্য মুন-এ আলো-চালিত মহাকাশযান কল্পনা করেছিলেন। বর্তমানে এই প্রযুক্তির নাম সোলার সেইল বা সৌর পাল। নৌকার পাল আকারের এক পালে সোলার প্যানেল থাকে। যেখানে সূর্যের আলোকশক্তি সংগ্রহ করা হয়। এর সঙ্গে থাকে প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ। পৃথিবীর কক্ষপথে এটি স্থাপন করা হয়।
জুল ভার্নকে ভবিষ্যদ্বক্তা হিসেবে ধরা হয়। কারণ, কোনো কিছু উদ্ভাবনের কয়েক দশক আগেই তিনি অনুমান করেছিলেন। অনেক আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে তাঁর তখনকার কল্পনা মিলে যায়। জানা যায়, জুল ভার্ন প্রতিদিন সকালে কয়েক ঘণ্টা লাইব্রেরিতে সময় কাটাতেন। প্রচুর পড়াশোনা করতেন। গবেষক ও বিজ্ঞানীদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল। দীর্ঘ সময় আলাপ করেছেন। তিনি জানতেন, তাঁর চারপাশে পৃথিবীতে কী ঘটছে। এটা জাদুর মতো কিছু না। তিনি সবকিছুর দিকে মনোযোগ দিয়েছিলেন।
ভিডিও কনফারেন্স
ইন দ্য ইয়ার ২৮৮৯-এ জুল ভার্ন ফোনোটেলিফোটের বর্ণনা দিয়েছেন। বর্তমানের ভিডিও কনফারেন্সিং প্রযুক্তির ধারণার সঙ্গে এর মিল আছে। এখন যেমন ভিডিও কলে কথা বলা একদম ডালভাত, ইন্টারনেট জনপ্রিয় হওয়ার শুরু দিকে তেমন ছিল না। যেমন ২০০৫ সালে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ায় বিচ্ছিন্ন হওয়া পরিবারের সদস্যরা যোগাযোগ করতে ভিডিও কল ব্যবহার করেছিল। বড় বড় ভিডিও ক্যামেরা দরকার পড়েছিল এই ভিডিও কলে যোগাযোগের জন্য। প্রযুক্তির উন্নয়নে এখন সবার মুঠোফোনে এক ক্লিকেই ভিডিও কল করা যায়।
ফোনোটেলিফোটটির বর্ণনায় জুল ভার্ন ভিডিও কলের বর্ণনায় লিখেছিলেন, তার দিয়ে যুক্ত সংবেদনশীল আয়নার মাধ্যমে ছবি পাঠানো সম্ভব হয়। বিজ্ঞান কল্পকাহিনি থেকে উদ্ভাবন এবং ধারণার তালিকাভুক্তি করে এমন একটি ওয়েবসাইট technovelgy.com-এর মতে, জুল ভার্নের ফোনোটেলিফোট প্রাচীনতম না হলেও সায়েন্স ফিকশনে এটিই প্রথম ভিডিও কনফারেন্স।
লুনার মডিউল
মানুষের অগ্রগতির উদাহরণ হিসেবে মানুষের চাঁদে যাওয়াকে একটি মাইলফলক ধরা হয়। জুল ভার্ন চাঁদে মনুষ্যবাহী যান পাঠানোর কল্পনা করেন। তিনি লুনার মডিউল নিয়ে লিখেছিলেন। লুনার মডিউল হলো চাঁদে পাঠানোর মহাকাশযান, যার ভেতরে মানুষ থাকে। মহাকাশ গবেষণাপ্রতিষ্ঠান নাসা রকেটে করে ১৯৬৯-এ চাঁদে প্রথম মানুষ পাঠায়। জুল ভার্ন পৃথিবী থেকে চাঁদে মানুষ পাঠানোর জন্য ফ্রম আর্থ টু দ্য মুন-এ ‘প্রজেক্টাইল’-এর বর্ণনা দিয়েছিলেন। তাঁর কল্পনার প্রজেক্টাইল যাত্রী নিয়ে চাঁদে যেত।
জুল ভার্ন কল্পনা করেছিলেন, ‘একটি বড় কামানের গোলা বেরিয়ে যাচ্ছে। এর গতির কারণে মহাকর্ষ ভেদ করার জন্য যথেষ্ট শক্তি পাওয়া যাবে।’ জুল ভার্নের কল্পিত আবিষ্কার বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। লেখক এইচজি ওয়েলসের মতো তাঁর কল্পনা না। লেখক ওয়েলসেরও চাঁদে যাওয়ার কল্পনা ছিল। তবে একটি বিশেষ খাবার তৈরি করে খেলে তুমি চাঁদে চলে যাবে।
পানিতে স্পেসশিপের অবতরণ
ফ্রম আর্থ টু দ্য মুন সায়েন্স ফিকশনে জুল ভার্ন কল্পনা করেছিলেন, একটি মহাকাশযান সমুদ্রে অবতরণ করছে ও ভাসছে। ইলন মাস্ক স্পেসএক্স প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই প্রতিষ্ঠান থেকে মহাশূন্যে মহাকাশযান পাঠানো হয়। এ রকম এক মহাকাশযান স্পেসএক্স মহাকাশে রকেট পাঠিয়ে পৃথিবীতে আবার রকেট ফেরত আনার প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছে। এ ছাড়া মহাকাশচারীরা পৃথিবীতে ক্যাপসুলে করে ফিরে এসে সমুদ্রে অবতরণ করেন। ঠিক জুল ভার্নের সায়েন্স ফিকশনের কল্পনার মতো।
মনে রাখা দরকার, কোনো লেখক উপন্যাসে কোনো প্রযুক্তি কল্পনা করেছেন আর সেটা পড়ে বিজ্ঞানীরা প্রযুক্তি আবিষ্কার করে ফেলেছেন, এমন কখনো হয় না। অনেক বিজ্ঞানীর দীর্ঘদিনের গবেষণা, চেষ্টা আর আবিষ্কারের জন্য পরিশ্রমে কোনো প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হয়। লেখকেরা শুধু বর্তমান প্রযুক্তির গবেষণার খোঁজখবর রাখেন, কল্পনা করেন সামনে কী প্রযুক্তি আসতে পারে।