আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক কি সত্যি সত্যি পরীক্ষার জন্য বের করে নেয়া হয়েছিল
১৯৫৫ সাল। যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যালি রোড স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলছেন স্কুল শিক্ষক মিসেস শেফার। সাম্প্রতিক সময়ের কোনো ঘটনা নিয়ে কেউ কিছু বলতে চায় কি না, তা জানতে চাইলেন শিক্ষার্থীদের কাছে। হাত তুলল সামনের সারিতে বসা একটি মেয়ে। দাঁড়িয়ে জানাল, ‘আইনস্টাইন মারা গেছেন।’ কথাটি বলার সময় তার চোখেমুখে কোনো দুঃখ বা হতাশা ছিল না। বরং এ রকম একটা গুরুত্বপূর্ণ খবর সবাইকে জানাতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে হচ্ছিল তার। কিন্তু তা নিমেষেই মাটি করে দেয় পেছনের বেঞ্চের একটি ছেলে। ছেলেটির নাম আর্থার হার্ভি। তার কণ্ঠে অবশ্য কোনো উৎসাহ ছিল না। শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক আমার বাবার কাছে।’
এই গল্প কতটুকু বাস্তব, তা জানার কোনো উপায় নেই। তবে আর্থার হার্ভির কথা ধরেই এগোনো যাক। আসলেই কি আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক আছে তার বাবার কাছে? কে তার বাবা? কেনই বা আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক সরিয়ে ফেলেছিলেন তিনি? এ প্রশ্নগুলোর উত্তরের জন্য যেতে হবে একটু পেছনে।
১৯৫৫ সালের ১৫ এপ্রিল। অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণের জন্য আইনস্টাইন ভর্তি হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির প্রিন্সটন হাসপাতালে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডাক্তাররা আইনস্টাইনকে জানালেন, বাঁচতে হলে সার্জারি করতে হবে। কিন্তু রাজি নন স্বয়ং আইনস্টাইন। কেন তিনি রাজি হলেন না? আসলে তখনকার সার্জারিবিদ্যা এখনকার মতো উন্নত ছিল না। হয়তো ভরসা করতে পারেননি আইনস্টাইন। নাকি আইনস্টাইন বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর সময় ফুরিয়ে এসেছে! সে যাই হোক, শেষ পর্যন্ত সার্জারি করতে মত দেননি বিশ্বসেরা বিজ্ঞানী। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার তিন দিন পর অর্থাৎ ১৮ এপ্রিল শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন বিশ্বখ্যাত এই বিজ্ঞানী। ঘটনাটা এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু তা হয়নি।
আইনস্টাইনের পরিবারের সম্মতি নিয়ে মৃতদেহ পাঠানো হয় মর্গে। মৃত্যুর আগেই আইনস্টাইন বলে গিয়েছিলেন, তাঁর মৃতদেহ পুড়িয়ে ছাই করে ফেলতে। সেই ছাই কোথায় ফেলা হবে, তাও যেন কেউ না জানে। আইনস্টাইন চাননি মৃত্যুর পরে তাঁর সমাধি বা দেহভষ্ম নিয়ে কেউ বাড়াবাড়ি করুক। কিংবা তাঁর কবরটি হয়ে যাক কোনো দর্শনীয় স্থান। পোস্টমর্টেমের দায়িত্বে ছিলেন প্রিন্সটন হাসপাতালের টমাস হার্ভি। তবে পোস্টমর্টেমের পাশাপাশি হার্ভির মাথায় ঘুরছিল অন্য ভাবনা। পোস্টমর্টেমের পরে আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক সরিয়ে রেখেছিলেন গোপনে। অসৎ উদ্দেশ্য ছিল না হার্ভির। আইনস্টাইনের মতো মহাবিজ্ঞানীর মস্তিষ্ক বিশ্লেষণ করে দেখতে চেয়েছিলেন, কেন তিনি এত মেধাবী!
ধরা পড়ে যান হার্ভি। এতে প্রচণ্ড বিরক্ত হন আইনস্টাইনের ছেলে হ্যান্স আলবার্ট। পরে অবশ্য তাঁকে বুঝিয়ে ঠান্ডা করেছিলেন হার্ভিই। কিন্তু প্রিন্সটন হাসপাতালের চাকরিটা হারাতে হয় হার্ভিকে। অবশ্য এটা নিয়ে কিছুটা দ্বিমতও আছে। অনেকে মনে করেন, আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক চুরির জন্য নয়, বরং একই হাসপাতালের এক নার্সের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল হার্ভির। সে জন্যই চাকরিটা হারাতে হয়েছিল তাঁকে।
ডাক্তারির চাকরি ছেড়ে হার্ভি পড়ে রইলেন আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক নিয়ে। ফরমালিনের জারের মধ্যে মগজ চুবিয়ে রেখে জারটিকে রেখেছিলেন একটি কাঠের বাক্সে। তবে খুব গোপনীয়ভাবে। নিজের স্ত্রীকে পর্যন্ত খুলে বলেননি কিছুই। একে তো চাকরি ছেড়েছেন, তার ওপর ঘরে বসে বসে স্বামীর এ তামাশা আর সহ্য হচ্ছিল না মিসেস হার্ভির। হুমকি দিলেন, ফরমালিনের জারসহ সব ফেলে দেবেন বাইরে। এতেই কপাল পোড়ে মিসেস হার্ভির।
পরের দিন উধাও হার্ভি। সঙ্গে নিয়ে গেছেন সেই কাঠের বাক্সটি। আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক নিয়ে হার্ভি ঘুরে বেরিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে। মস্তিষ্ক কেটেকুটে করেছেন ২৪০ টুকরা। তারপর বিভিন্ন গবেষকদের কাছে পাঠিয়েছেন টুকরাগুলো গবেষণার জন্য। তখনও যে হার্ভি জানতেই পারেননি, কেন আইনস্টাইন এত মেধাবী ছিলেন।
আইনস্টাইনের মৃত্যুর পর কেটে গেছে ৪৪ বছর। ১৯৯৯ সালে আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এই গবেষণার প্রধান ছিলেন কানাডার হ্যামিল্টন ম্যাকমাস্টার ইউনিভার্সিটির নিউরোবায়োলজিস্ট সান্ড্রা উইটেলসন। হার্ভির ফটোগ্রাফগুলো পরীক্ষা করে দেখেছেন সান্ড্রা ও তাঁর দল। সে সময় ৩৫ জন সাধারণ মানুষের মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা করেন তাঁরা। তারপর ফলাফল মিলিয়ে দেখেন আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের সঙ্গে। ফলাফল, সাধারণ সেসব মস্তিষ্কের তুলনায় আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের ওজন ছিল কম। তবে আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক আলাদা ছিল অন্য জায়গায়।
সাধারণত মানুষের মস্তিষ্কে প্যারাইটাল ওপারকুলাম ও ইনফিরিয়র প্যারাইটাল লোব নামে দুটি অংশ থাকে। আইনস্টাইনের মস্তিষ্কে ছিল না প্রথমটি। অর্থাৎ প্যারাইটাল ওপারকুলাম নেই। এই দুটি অংশের পরিবর্তে তাঁর ছিল একটি। ফলে তাঁর ইনফিরিয়র প্যারাইটাল লোব সাধারণ মানুষের তুলনায় ১৫ শতাংশ প্রশস্ত ছিল। ব্যাপারটা আরেকটু বুঝিয়ে বলি। মস্তিষ্কের ওই দুটি অংশ যতটুকু জায়গা দখল করবে, একটি থাকলে নিশ্চই সেটা বেশি জায়গা পাবে। আইনস্টাইনের ক্ষেত্রে এ ব্যাপারটিই ঘটেছিল। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, এ কারণেই আইনস্টাইন এত মেধাবী ছিলেন। তবে দ্বিমতও আছে। কেউ কেউ আবার এই গবেষণা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
২০১৪ সালে আরও একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন যুক্তরাষ্ট্রের পেস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. হিনস। ডিসকভার ম্যাগাজিনে তা প্রকাশিত হয়। ২৮ বার আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক নিয়ে পরীক্ষা করেও সাধারণ মানুষের মস্তিষ্ক থেকে আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক আলাদা করতে পারেননি হিনস। অর্থাৎ আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক নিয়ে নানা মুনির নানা কথা। কারণ, মানুষের মস্তিষ্কের রহস্য এখনো পুরোপুরি আমরা জানি না। ভবিষ্যতে মস্তিষ্কের রহস্যের জট খুললে হয়ত আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের রহস্যের সমাধান মিলবে।
তবে এসব সম্ভব হয়েছে টমাস হার্ভির কারণে। ২০০৭ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আর আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের টুকরা এবং ফটোগ্রাফগুলো এখন সংরক্ষিত আছে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব হেলথ অ্যান্ড মেডিসিনে। তাই আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক চুরির অপরাধে হার্ভিকে হয়তো ঘৃণা করতে পারবে না তুমিও।