অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন লর্ড কার্নারভন। দরজাটা খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল বেশ আগেই। কিন্তু দরজা পর্যন্ত পৌঁছানোই যাচ্ছিল না। যে দেয়াল খুঁড়ে দরজাটা পাওয়া গেছে, সরানোই যাচ্ছিল না সেগুলোর ধ্বংসাবশেষ। ছোট সুড়ঙ্গটির এক মাথা থেকে আরেক মাথা কতক্ষণ যে পায়চারি করেছেন কার্নারভন, তার কোনো হিসাব নেই। শান্ত হয়ে বসতে পারছে না তাঁর মেয়েও।
ভাবলেশহীনভাবে দাঁড়িয়ে আছেন শুধু হাওয়ার্ড কার্টার। ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করলেন শেষ পাথরটুকু সরানো পর্যন্ত। তবে ভেতরে ভেতরে তিনি যে কতটা উত্তেজিত, তা বুঝতে পারলেন দরজার সামনে যাওয়ার পর। আস্তে আস্তে ভাঙার সময় দেখলেন, দুহাতই কাঁপছে তাঁর। তবে এত কিছুর ভিড়েও দায়িত্বে কোনো ছাড় দিলেন না হাওয়ার্ড কার্টার। দরজা ভাঙার পর প্রথমে একটা মোমবাতি ঢুকিয়ে দেখলেন, জ্বলছে কি না। না জ্বললে বুঝতে হবে ভেতরে অক্সিজেন নেই। প্রবেশ করলেই নিশ্চিত মৃত্যু। মোমবাতি না নেভায় কার্টার বুঝতে পারলেন, ভেতরটা নিরাপদ। তারপর মোমবাতি হাতে নিয়ে আস্তে আস্তে কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করলেন।
হাতে মোমবাতি। তারপরও ঘুটঘুটে অন্ধকার চোখে সয়ে আসতে কিছুটা সময় লাগল কার্টারের। ততক্ষণে গুমোট একটা গন্ধ এসে ধাক্কা দিচ্ছে তাঁর নাকে। বুঝিয়ে দিচ্ছে, বহু বছর কারও পা পড়েনি এই কক্ষে। আস্তে আস্তে ভেতরের অবয়ব পরিষ্কার হয়ে এল। তারপর কার্টার যা দেখলেন, তাতে আবারও চোখ ঝলসে যাওয়ার জোগাড় হলো তাঁর। প্রথমেই দেখলে অদ্ভুত আকৃতির প্রাণীদের ভাস্কর্য, যা আগে কখনো দেখেননি তিনি। আর দেখলেন স্বর্ণ। যেদিকে চোখ যাচ্ছে, সেদিকেই স্বর্ণ! অন্ধকার থেকে ছিটকে বের হচ্ছে স্বর্ণের ছটা। মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকতে বাধ্য হলেন কার্টার। তুতেনখামেন নিয়ে এত দিন যা শুনেছেন, সবই তাহলে সত্য!
ওদিকে বাইরে কার্নারভনের অবস্থা শোচনীয়। উত্তেজনায় কথাও বের হচ্ছে না মুখ দিয়ে। কোনোভাবে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিছু কি দেখা যাচ্ছে?’
কম্পিত কণ্ঠে কার্টার জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ। দারুণ, অবিশ্বাস্য সব জিনিস দেখছি আমি!’
প্রাচীন মিসরের রহস্যে মানুষ মন্ত্রমুগ্ধ যুগ যুগ ধরে। সর্বজয়ী আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট থেকে শুরু করে জুলিয়াস সিজার, রোমান সম্রাট হাদ্রিয়ান—সবাই ছুটেছেন মিসরের রহস্যের পেছনে। পিরামিড থেকে শুরু করে ফারাওদের মমি—সবকিছুর প্রতিই মানুষের আগ্রহ ছিল তুঙ্গে।
প্রথম মিসরের প্রাচীন সভ্যতার কাছাকাছি যেতে পেরেছিলেন নেপোলিয়ন। ১৭৮৯ সালের ১৯ মে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত প্রায় ১৭ হাজার যোদ্ধা নিয়ে মিসরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন নেপোলিয়ন। সঙ্গে নেন ১৫০ জনের মতো বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, স্থপতি, সার্ভেয়ার আর কার্টোগ্রাফার (যাঁরা মানচিত্র বানাতে পারেন)। লক্ষ্য ছিল একটাই—উদ্ঘাটন করতে হবে মিসরের সব রহস্য!
খুব দ্রুতই সাফল্য পান নেপোলিয়ন। ফরাসি এই কমান্ডার আর তাঁর সঙ্গীদের প্রাচীন মিসরের প্রতি প্রবল আগ্রহই ছিল এর অন্যতম কারণ। একে একে বেশ কয়েকজন ফারাও রাজার সমাধি খুঁজে পান নেপোলিয়ন। যে জায়গায় সমাধিগুলো পাওয়া যায়, তার বর্তমান নাম ‘ভ্যালি অব দ্য কিংস’। বাংলায় যার অর্থ, ‘রাজার উপত্যকা’। ফারাওরা মৃত্যুর পর নিজেদের কবর দেওয়ার জন্য এই স্থানকেই বেছে নিয়েছিলেন।
নেপোলিয়নের দেখানো পথে হেঁটে পরবর্তী ১০০ বছরে বহু প্রত্নতত্ত্ববিদেরা এমন ডজনখানেকের বেশি সমাধি আবিষ্কার করেছেন। পাশাপাশি খুঁজে পেয়েছেন বিভিন্ন ঘর, সভাকক্ষ, এমনকি অনেক গুপ্তঘরও। চেনা প্রায় সব ফারাওয়ের সমাধি পাওয়া গেলেও পাওয়া যাচ্ছিল না কেবল একজনের সমাধি। যিনি রাজা হয়েছিলেন সবচেয়ে কম বয়সে, রাজত্বও করেছেন মাত্র ১০ বছর। মানুষের মুখে মুখে যার নাম ঘুরতে ঘুরতে নিয়েছে কিংবদন্তির রূপ—রাজা তুতেনখামেন।
তুতেনখামেনের সমাধি খোঁজার জন্য সে সময় উঠেপড়ে লেগেছিল মানুষ। এর পেছনে প্রধান কারণ ছিল গুপ্তধন। ফারাওদের যতগুলো সমাধি পাওয়া গিয়েছিল, প্রতিটিতেই কোনো না কোনো দামি জিনিস থাকতই। তবে তুতেনখামেনের বেলায় গুজব রটে যায়, এই সমাধিতেই আছে অমূল্য সব স্বর্ণালংকার। অন্যান্য সমাধিতে পাওয়া জিনিসগুলোর চেয়েও বহুগুণ দামি। ফলে ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ ছুটে আসে তুতেনখামেনের সমাধি খুঁজে বের করার জন্য। কিন্তু বিধি বাম, অল্প বয়সী রাজাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না কিছুতেই।
এমনই একটা সময়ে সবাই যখন ভাবা শুরু করল যে তুতেনখামেন বলতে হয়তো কিছুই নেই, সবই গুজব—তখনই আবির্ভাব ঘটে হাওয়ার্ড কার্টারের।
ছোটবেলায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় খুব বেশি দূর যেতে পারেননি কার্টার। মিসর সম্পর্কে যা যা জেনেছেন, সবটাই বলা যায় নিজ আগ্রহে আর কাজ করতে গিয়ে। ১৭ বছর বয়সে সমাধির দেয়ালে আঁকা বিভিন্ন দৃশ্য আর লেখার প্রতিলিপি করার দায়িত্ব পান কার্টার। কাজ করতে করতে পরিচিত হন ফ্লিন্ডার্স পেত্রির সঙ্গে। মিসর সম্পর্কে পেত্রির ছিল অগাধ জ্ঞান, পাশাপাশি খননকাজেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ। পেত্রির সঙ্গে থাকা অবস্থায়ই আস্তে আস্তে তুতেনখামেন নিয়ে আরও খোঁজখবর নিতে শুরু করেন কার্টার। চেষ্টা করতে থাকেন, রহস্যময় এই ফারাও সম্পর্কে আরও সূত্র সংগ্রহ করার। তখন পর্যন্ত কার্টার ভালোমতো জানতেনই না যে তুতেনখামেন আসলে কে। কিন্তু চারদিকে এ নিয়ে প্রবল আগ্রহ দেখে কৌতূহলী হয়ে পড়েন তিনিও।
নিজ গুণেই খুব অল্প দিনেই পদোন্নতি পেয়ে যান কার্টার। তা সত্ত্বেও একগুঁয়ে স্বভাবের জন্য চাকরি করা তাঁর জন্য মুশকিল হয়ে পড়ে। একদিন কিছু ফরাসি পর্যটক বিনা কারণে চড়াও হন কয়েকজন মিসরীয়র গার্ডের ওপর। বিষয়টি ভালোভাবে নিলেন না কার্টার। ওই গার্ডদের তিনি বললেন, পর্যটকদের ওপর পাল্টা হামলা করার জন্য। এ ঘটনা নিয়ে অনেক কাদা–ছোড়াছুড়ি হবে বুঝতে পেরে কিছুদিন পরই প্রতিষ্ঠানটি ছেড়ে দেন কার্টার।
কার্টার যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন, সে প্রতিষ্ঠানের একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন থিওডর ডেভিস নামের এক ব্যক্তি। নিজ উদ্যোগে খোঁজাখুঁজি করার সময় তিনি মিসরের ওই উপত্যকা থেকে বেশ কিছু জিনিস (Artefact) উদ্ধার করেন। ডেভিস অবাক হয়ে দেখেন, সেগুলোতে খোদাই করে লেখা তুতেনখামেনের নাম!
যদিও তুতেনখামেনের সমাধি আসলেই আছে কি না, তা প্রমাণের জন্য এগুলো যথেষ্ট ছিল না। কিংবা থাকলেও ডেভিস নিশ্চিত ছিলেন, তুতেনখামেনের সমাধির খুব কাছেই আছেন তিনি। নতুন উদ্যমে আবারও ঝাঁপিয়ে পড়েন। কিন্তু অনেক চেষ্টার পরও সমাধিটি আর খুঁজে পাননি তিনি। শেষ পর্যন্ত ১৯১৪ সালে ব্যর্থ হয়েই অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা করেন ডেভিস। এক প্রকাশনায় নিজের আবিষ্কারের কথা জানিয়ে বলেন, নিজে না পেলেও তুতেনখামেনের কবর খুঁজে পেতে হয়তো আর বেশি দিন বাকি নেই।
তবে ডেভিসের কথা বিশ্বাস হয়নি কার্টারের। অবশ্য বিশ্বাস করলেও তেমন লাভ হতো না। কারণ, তুতেনখামেনের সমাধি খোঁজার জন্য যে পরিমাণ অর্থের দরকার, তার ছিটেফোঁটাও ছিল না কার্টারের কাছে। তবে টাকা না থাকলেও কার্টারের সৌভাগ্য, ডেভিসের আবিষ্কারের কথা কানে গেছে অনেক সম্পদশালী ব্যক্তিদের কানেও। তেমনই একজন ছিলেন হার্বার্ট কার্নারভন। তুতেনখামেনের সমাধি আসলেই আছে কি না, তা বের করার জন্য কার্টারের দরকার ছিল টাকা, আর কার্নারভনের দরকার ছিল একজন দক্ষ প্রত্নতত্ত্ববিদের। দুজনেরই চাওয়া মিলে যাওয়ায় সিদ্ধান্ত নেন, খুঁজে বের করবেন রহস্যময় ওই ফারাওয়ের সমাধি।
ডেভিসের অভিযান চলাকালেই তাঁর আবিষ্কারের কথা জানতে পারেন কার্টার আর কার্নারভন। কিন্তু ডেভিসের অভিযান তখনো শেষ না হওয়ায় কার্টারের পক্ষে অভিযান শুরু করার সম্ভব হচ্ছিল না। কারণ, একই জায়গায় একজন অভিযান চালাতে থাকলে অন্য কারও পক্ষে সেখানে অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব নয়। অবশেষে ১৯১৪ সালে হাল ছেড়ে দেন ডেভিস। তখনই নিজের দলবল নিয়ে নেমে পড়েন কার্টার আর কার্নারভন। অনেকে সাবধান করেন কার্নারভনকে। তুতেনখামেনের সমাধি তো পাওয়া যাবেই না, উল্টো পকেটের সব টাকা যাবে গচ্চা। কারও কথায় কান না দিয়ে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন কার্নারভন। তুতেনখামেনকে এবার বের করেই ছাড়বেন!
কাজ শুরু করার কিছুদিন পরেই বাধে বিপত্তি। শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। কাজ বন্ধ রাখতে হয় বেশ কিছুদিন। যুদ্ধ শেষে ১৯১৭ সালে আবারও ফিরে আসেন কার্টার আর কার্নারভন। দিনরাত খাটতে থাকেন কার্টারের দলের সদস্যরা। ধারণা করা হয়, উপত্যকা খুঁড়ে সমাধি পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য পুরো দলকে প্রায় দেড় থেকে দুই লাখ টন মাটি-পাথর সরাতে হয়েছে। এত কিছু করতে করতে কেটে গেছে প্রায় এক বছর। কার্টারদের সাফল্য তখনো শূন্য। ওদিকে কার্নারভনের টাকা খরচ হচ্ছে জলের মতো। তত দিনে তিনিও ভাবতে শুরু করেছেন, আসলেই হয়তো তুতেনখামেনের সমাধি বলতে কিছু নেই। সবই বানানো।
অধৈর্য কার্নারভন মিটিংয়ে বসেন কার্টারের সঙ্গে। জানতে চান, এর ভবিষ্যৎ কী। তেমন একটা আশার কথা শোনাতে না পারলেও শেষবারের মতো আরও কিছু সময় চান কার্টার। এবার যদি কিছু না হয়, তাহলে তল্পিতল্পা গুটিয়ে বিদায় নিতে কোনো আপত্তি থাকবে না বলে জানিয়ে দিলেন। কার্টারের মুখের দিকে তাকিয়ে মেনে নেন কার্নারভন।
নতুন উদ্যমে আবারও কাজ শুরু করেন কার্টার আর তাঁর দল। এবার অন্য পদ্ধতিতে এগোবেন বলে ঠিক করেন কার্টার। এখন পর্যন্ত যে জায়গাগুলোতে হাত দেওয়া হয়নি, সিদ্ধান্ত নেন খোঁজা শুরু করবেন সেখানে। সেই ভেবেই ফারাও রাজা পঞ্চম রামেসেসের সমাধির দরজার নিচ থেকে খোঁড়া শুরু করেন।
ফারাওরা সব সময়ই ছিল মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে। ফলে যখনই কোনো ফারাও রাজার সমাধি আবিষ্কৃত হতো, পর্যটকেরা পড়তেন হুমড়ি খেয়ে। এ জন্যই পঞ্চম রামেসেসের সমাধির আশপাশে ঘেঁষতে পারতেন না প্রত্নতত্ত্ববিদেরা। কোনো উপায়ান্তর না দেখে এবার পর্যটকদের তোয়াক্কা করলেন না কার্টার। ১৯২২ সালের ১ নভেম্বর থেকে খোঁড়া শুরু করেন, আর মাত্র তিন দিনের মধ্যে পাথরের মধ্যে একটি সিঁড়ি দেখতে পান। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে কার্টার একটি প্লাস্টার করা দরজা আবিষ্কার করেন। প্লাস্টারের ওপর ছিল অদ্ভুতদর্শন একটি সিল।
কার্নারভন তখন উপস্থিত ছিলেন না। কার্টার চাইলেন তাঁকে সঙ্গে নিয়েই দরজা ভাঙতে। এই ভেবে কাজ বন্ধ রেখে সঙ্গে সঙ্গেই টেলিগ্রাম করেন কার্নারভনকে। টেলিগ্রামটি ছিল এমন,
‘অবশেষে দারুণ একটা কিছু আবিষ্কার করতে পেরেছি। সমাধিটির নিচে একটা অক্ষত দরজা পেয়েছি, যার ওপরে একটি সিলও মারা আছে। তোমার আসার অপেক্ষা করছি। অভিনন্দন।’
এই টেলিগ্রামের পর থেকে শুরু হয় কার্টারের জীবনের দীর্ঘতম অপেক্ষার পালা। ভেতরে ভেতরে উত্তেজনায় ফেটে পড়লেও কোনোক্রমে নিজেকে সংযত রাখলেন তিনি। তখন পর্যন্ত নিজেকে বলছিলেন, এটা আসলে তেমন কোনো আবিষ্কার নয়। সাধারণ কিছু একটা। এমনকি পুরো দরজা পরিষ্কার করার পর যখন দেখা গেল, সিলটির মধ্যে লেখা ‘তুতেনখামেন’, তখনো বিশ্বাস করতে চাননি। ভাবছিলেন, হয়তো রাজা তুতেনের কোনো সভাকক্ষ হবে।
মোমবাতি হাতে কক্ষের ভেতরে ঢুকতেই কার্টারের সব অবিশ্বাস উবে গিয়ে বিশ্বাসে পরিণত হলো। ভেতরে কী আছে, কার্নারভনের ব্যাকুল জিজ্ঞাসার উত্তরে কার্টার কম্পিত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘দারুণ, অবিশ্বাস্য সব জিনিস!’ আসলেই তাই। কক্ষটির দেয়ালে থরে থরে সাজানো ছিল স্বর্ণের সুদৃশ্য সব বস্তু, ঘোড়ার গাড়ি, পশুর আকৃতির বিছানাসহ আরও অনেক মূল্যবান জিনিস।
কার্টারের সঙ্গে ততক্ষণে ঘরের ভেতর চলে এসেছেন কার্নারভন আর তাঁর মেয়ে লেডি এভেলিন। এত কিছু থাকলেও ঘরটির কোথাও তুতেনখামেনের কফিনটা তাঁরা দেখতে পেলেন না। তবে আরও কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে ঘরের পশ্চিম আর উত্তর দেয়ালে আরও দুটি সিল দেওয়া দরজা পেলেন। একটা দরজার দুই পাশে প্রহরীর মতো করে দাঁড়িয়ে আছে রাজা তুতেনখামেনেরই দুটো মূর্তি।
তখন নিয়ম ছিল, নতুন কোনো ফারাওয়ের সমাধি আবিষ্কৃত হলে, কর্তৃপক্ষ আর গণমাধ্যমকে সামনে রেখে তার ভেতর প্রবেশ করতে হবে। কিন্তু সেই লম্বা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে ইচ্ছা করল না তিনজনের কারোরই। সিদ্ধান্ত নেন, গোপনে ঘুরে আসবেন তুতেনখামেনের শয্যাস্থান। যে–ই ভাবা, সেই কাজ। অতি সন্তর্পণে সিল আর প্লাস্টার খুলে তাঁরা ভেতরে যান, তুতেনখামেনের কফিনসহ দেখে আসেন পুরো ভেতরটা। এরপর বের হয়ে আবার আগের মতো প্লাস্টার আর সিল করে দেন সম্পূর্ণ চেম্বার, যেন কেউ বুঝতে না পারে যে আগে এখানে কেউ ঢুকেছিল।
অবশেষে ২৯ নভেম্বর সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হলো। সবার সামনে তুতেনখামেনের সমাধি ‘প্রথমবারের মতো’ খোলার জন্য কার্টার আর কার্নারভন ছিলেন তৈরি। অবশ্য সবার বুকে একটু দুরু দুরু উত্তেজনা কাজ করছিল। এই বহু পুরোনো সমাধির ভেতর কেউ যদি আনকোরা নতুন প্লাস্টার দেখে সন্দেহ করে বসে, তাহলে কী হবে—এই ভেবে ঘামছিলেন কার্টার। যদিও এমন কোনো ঝামেলায় পড়তে হয়নি তাঁদের। নতুন এক ফারাও রাজার সমাধি পাওয়া গেছে—এতেই সবাই ছিল মন্ত্রমুগ্ধ। প্লাস্টার, সিল ভেঙে তুতেনখামেনের ঘরে ঢুকতেই অভ্যর্থনা জানায় প্রায় ৯ ফুট লম্বা স্বর্ণের ভাস্কর্য। রাজা তুতেনের স্মৃতির উদ্দেশ্যেই এই ভাস্কর্য বানানো হয়েছিল, তা বোঝা যাচ্ছিল সহজেই। পুরো ঘর উপচে পড়ছিল স্বর্ণে। যেদিকে চোখ যাচ্ছিল, সেদিকেই ছিল স্বর্ণ। আর ঠিক মাঝখানেই ছিল রাজা তুতেনখামেনের কফিন। ভেতরে পাওয়া যায় আরও একটি ঘর—একই দৃশ্য সেখানেও! কার্টার আর কার্নারভন মিলে এমনই একটি জিনিস আবিষ্কার করে ফেললেন, যা আগে কখনো কেউ দেখেনি, ভবিষ্যতেও এমন কিছু খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
তত দিনে সবার মুখে ছড়িয়ে পড়েছে তুতেনখামেনের নাম। বিক্রি হচ্ছিল তুতেনখামেনের নাম বা ছবিসদৃশ ক্রিসমাস কার্ড।
কিন্তু সমস্যা দেখা দিল কয়েক দিন পর।
১৯২৩ সালের ৫ এপ্রিল, হুট করেই মারা যান লর্ড কার্নারভন। ইনফেকশনকে মৃত্যুর কারণ হিসেবে দাবি করেন চিকিৎসকেরা। কিন্তু গুজব ছড়িয়ে পড়ে, কার্নারভনের গায়ে লেগেছে তুতেনখামেনের অভিশাপ। প্রাচীন মিসরকে জড়িয়ে এমন যেকোনো গুজবই তখন গোগ্রাসে গিলত মানুষ। চিকিৎসকেরা যতই ব্যাখ্যা দিন না কেন, সবাই ধরে নিল যে তুতেনখামেনের সমাধিটি ছিল অভিশপ্ত। আর সে জন্যই মৃত্যু ঘটেছে কার্নারভনের। মানুষের মুখে মুখে তখন ঘুরত, তুতেনখামেনের সমাধির দরজায় নাকি লেখা ছিল, ‘এই ফারাওয়ের সমাধিতে যে হাত দেবে, তার মৃত্যু হবে খুব দ্রুত।’ এই আগুনে আরও ঘি ঢালে সাপের কামড়ে কার্টারের পোষা পাখির মৃত্যু। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে নেয় সবাই। বদ্ধমূল ধারণা হয়ে যায় সবার মধ্যে, তুতেনখামেনের অভিশাপ একে একে নেমে আসছে সবার ওপর।
তবে এ ধরনের গুজব ছড়ানোর সময় স্বাভাবিকভাবেই মানুষ এড়িয়ে যেত অনেক কিছু। কার্নারভনের মৃত্যু তাঁর কাছের মানুষের জন্য খুব বেশি অবাক করার মতো কোনো ঘটনা ছিল না। কারণ, বেশ কিছুদিন ধরেই তিনি ছিলেন অসুস্থ। বয়স কম ছিল না তার—৫৭। এ বয়সে এমন মৃত্যু যে অস্বাভাবিক কিছু না, একটু ভাবলে যে কেউই তা বুঝতে পারতেন।
আর কার্টার এ ধরনের অভিশাপের কথা বরাবরই অস্বীকার করে এসেছেন। বারবার বলতেন, এসব অভিশাপ বলতে কিছু নেই, সবই মানুষের বানানো। এমনকি এটাও বলেন যে ওই সমাধির চেয়ে নিরাপদ জায়গা পৃথিবীতে আর কিছুই হতে পারে না। কিন্তু সাধারণ মানুষকে বলে কি আর বোঝানো যায়, এখনো মানুষের মুখে ঘুরে ঘুরে আসে তুতেনখামেনের সমাধির অভিশাপের কথা।
অভিশাপ থাকুক না থাকুক, তুতেনখামেনের সমাধি আবিষ্কার প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতা নিয়ে কাজ করা মানুষদের কাছে অনবদ্য এক ব্যাপার! সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ পর্যটকদের কাছেও। সেদিন তুতেনখামেনের সমাধি আর কক্ষে যা পাওয়া গিয়েছিল, সবই রক্ষিত আছে মিসরের কায়রো জাদুঘরে। কবর থেকে আবিষ্কার করা সব গুপ্তধন নিয়ে ১৯৬০ সালে একটি বৈশ্বিক ভ্রমণের আয়োজন করে করা হয় কায়রো জাদুঘরের পক্ষ থেকে। উদ্দেশ্য ছিল, পৃথিবীর আরও অনেক মানুষ যেন দেখতে পারে তুতেনখামেনের সমাধি থেকে উদ্ধার করা অবিশ্বাস্য সব সম্পদ। ব্রিটিশ জাদুঘরে আনার পর হুমড়ি খেয়ে পড়ে সবাই। ধারণা করা হয়, আট ঘণ্টা ধরে প্রায় ১৬ লাখ মানুষ ঘুরে দেখেছেন তুতেনখামেনের গুপ্তধন।
এখনো সবাই শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন হাওয়ার্ড কার্টার আর কার্নারভনকে। এ দুজনের দৃঢ়তাই খুঁজে বের করেছে তুতেনখামেনকে। না হলে হয়তো এখনো মাটির নিচের কোনো অন্ধকার ঘরে পড়ে থাকতেন সবচেয়ে কম সময় রাজত্ব করা এই ফারাও, সঙ্গে নিয়ে অমূল্য সব সম্পদ!