ইন্টারনেট ঠিক কীভাবে কাজ করে (শেষ পর্ব)
মামা থামতেই রাফি যেন বিরক্ত হলো। তীব্র উত্তেজনা কাজ করছে ওর মধ্যে। আর মামাটাও না, একদম জায়গামতো থেমে গেল।
মামা ওর মুখভঙ্গি দেখে হাসলেন। বললেন, ‘তোকে একটু উত্তেজনাটা বোঝার সময় দিলাম।’
আচ্ছা, এবার প্রথমে L টাইপ করা হলো। গেছে কি না, জানবে কীভাবে? সে জন্য দেওয়া হলো ফোন! জানা গেল, পৌঁছেছে। যাক!
এবার টাইপ করা হলো O। আবারও জানা গেল, পৌঁছেছে।
এপাশে তারপর টাইপ করা হলো G। কিন্তু ওপাশ থেকে জানা গেল, সিস্টেম ক্র্যাশ করেছে!
এত দিনের চেষ্টায় বিজ্ঞানীরা পাঠালেন শুধু দুটি অক্ষর—‘LO।’
‘ইশ্!’ রাফির কথা শুনে বোঝা গেল, খুব কষ্ট পেয়েছে।
মামা বললেন, ‘কষ্টের কিছু নেই। এখন তো দেখ, বিশ্বজুড়ে ইন্টারনেট। আসলে, বিজ্ঞানীরা তো সেবারই সিস্টেমটা শিখে ফেললেন। এখন শুধু কাজটা আরও ভালোভাবে, বড় পরিসরে করা।’
‘এবার তোকে একটা মজার কথা বলি। সব ওয়েবসাইটের শুরুতে একটা ডব্লিউডব্লিউডব্লিউ (www) থাকে, দেখেছিস না?’
‘হ্যাঁ।’
প্যাকেটের শুরুতে যেমন বিশেষ ঘর থাকে, শেষে এ রকম একটা বিশেষ ঘর থাকে। এই ঘরে বলা থাকে পরের প্যাকেট কোনটা হবে। এই ঘর দেখে দেখে সবগুলো প্যাকেট জিগস পাজলের মতো করে জোড়া দেয় ব্রাউজার। জোড়া দিলে—ওই যে আগে বললাম না এইচটিএমএল, এ রকম একটা এইচটিএমএল পেজ পাওয়া যায়।
‘এটা হলো ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব। অনেকে মনে করে, ইন্টারনেট আর ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব এক জিনিস। আসলে কিন্তু তা নয়।’
‘পার্থক্যটা কী, মামা?’
‘ইন্টারনেট মানে জালের মতো—পুরো নেটওয়ার্ক কাঠামোটা। আর ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব একটা সিস্টেম। অনেকগুলো তথ্য, বিভিন্ন জিনিসের একটা সংগ্রহশালা বলতে পারিস। এখানে তোকে আরেকটা বিজ্ঞানীর কথা বলতে হবে। টিম বার্নার্স লি। এই ভদ্রলোকই ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব আবিষ্কার করেন। তারপর দেখলেন, ইন্টারনেট দিয়ে তথ্য পাঠানো যায়, কিন্তু একজনের তথ্য আরেকজন সরাসরি দেখতে পারে না, আলাদা করে পাঠাতে হয়। সেটা একটা ঝামেলা। আরেকটা ঝামেলা হলো, জানিসই তো, অনেক ধরনের প্রোগ্রামিং ভাষা আছে। এগুলোর একেকটা একেকভাবে কাজ করে। তখন একজনের কম্পিউটার আরেকজনের কম্পিউটার থেকে আসা তথ্য আর বুঝতে পারে না। এসব সমস্যার সমাধান করতে এই ভদ্রলোক একসঙ্গে তিনটা জিনিস তৈরি করলেন। এইচটিএমএল (HTML), ইউআরএল (URL) আর এইচটিটিপি প্রটোকল (HTTP)।’
‘এগুলো আবার কী!’ রাফি চেঁচিয়ে ওঠে। এত জটিল জটিল শব্দ ওর মাথা গুলিয়ে দিচ্ছে। ‘একটু সহজ করে বলো না, মামা।’
‘বলছি, দাঁড়া।’ বলে মামা ল্যাপটপটা আবার ওপেন করলেন। তারপর ক্রোম ব্রাউজার দেখিয়ে বললেন, ‘ব্রাউজার তো চিনিস?’
‘হ্যাঁ।’
‘এখন আমি এই যে ব্রাউজারের এখানে একটা সাইটের নাম-ঠিকানা লিখব। এটাকে বলে ইউআরএল বার। ইউআরএল মানে, সাইটের ঠিকানা। তার মানে, এই জায়গাটা হলো সাইটের ঠিকানা লেখার ঘর। এখন ধর… আচ্ছা আগে বল, তুই কিশোর আলো পড়িস?’
‘হ্যাঁ।’
‘ওদের ওয়েবসাইটের ঠিকানাটা লিখব, দেখ। www.kishoralo.com—এই যে লিখলাম। এটা ঠিক ঠিকানা না, কিন্তু একধরনের ঠিকানা বলতেই পারিস। মানে, ঠিকানার ইংরেজি রূপ। এখন এন্টার মারলেই সাইটটা লোড হবে। কিন্তু এখানে কী হচ্ছে আসলে?’
‘কী হচ্ছে, মামা?’
‘সব ওয়েবসাইটের একটা আইপি অ্যাড্রেস থাকে। এটা হলো গিয়ে কম্পিউটারের ভাষায় লেখা ঠিকানা। তুই যে কিশোর আলোর সাইটে যাবি, ওদের নাম আর ইউআরএল—মানে, মানুষের বোঝার মতো ঠিকানার বিপরীতে এই আইপি অ্যাড্রেস বা কম্পিউটারের বোঝার মতো ঠিকানাটা নোট করা থাকে। কম্পিউটার তো আর ইংরেজি বোঝে না। সে ইউআরএলের বিপরীতে সংখ্যায় লেখা এই ঠিকানা খুঁজে নেয়, সে অনুযায়ী সংযোগ তৈরির চেষ্টা করে।
আইপি অ্যাড্রেস জিনিসটা, সেই যে তোকে বললাম বাইনারি ডিজিট বা বিট, এই বিটে লেখা থাকে। বাইনারি ডিজিট মানে, এর মান শুধু ০ বা ১ হয়। সাধারণত এ রকম ৩২টা বিট ব্যবহার করে আইপি অ্যাড্রেস লেখা হয়।
‘সেটা নাহয় বুঝলাম,’ রাফি বলল, ‘কিন্তু ইউআরএল থেকে কম্পিউটার আইপি অ্যাড্রেসটা খুঁজে বের করে কীভাবে?’
মামা জবাবে বললেন, ‘হ্যাঁ, সে কথাতেই আসছি। ‘ডোমেইন নেইম সার্ভার’ নামে একধরনের ডেটাবেজ আছে, বুঝলি? ডেটাবেজ মানে, বাংলায় বলতে পারিস তথ্যশালা। এই তথ্যশালায় তালিকা আকারে সব ওয়েবসাইটের নাম (এটাকেই কম্পিউটারবিজ্ঞানীরা ডোমেইন নেম বলেন) আর ইউআরএল লিঙ্কের বিপরীতে সঠিক আইপি অ্যাড্রেসটা লেখা থাকে। কম্পিউটার এই তালিকা দেখে সঠিক আইপি অ্যাড্রেস খুঁজে নেয়।’
‘তারপর?’
‘তারপরের ধাপে কম্পিউটার সেই আইপি অ্যাড্রেসের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করতে শুরু করে। যোগাযোগটা যাতে সহজ হয়, তাই বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর সার্ভার—বলতে পারিস একধরনের ডেটাবেজ—থাকে বিভিন্ন দেশে। একটা উদাহরণ দিলে তুই বিষয়টা ভালোভাবে বুঝবি।
ফেসবুকের কথাই ধর। তোর কম্পিউটারের ব্রাউজারে ফেসবুক ডটকম লিখে এন্টার দিলি। এখন তোর কম্পিউটার থেকে রিকোয়েস্ট যাবে তোর বাসায় যারা ইন্টারনেট দিয়ে গেছে, ওদের কাছে। ওদেরকে বলে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার। এত বড় নাম তো ডাকা যায় না, সংক্ষেপে বলতে পারিস আইএসপি। তো, এই যে আইএসপির সার্ভারে রিকোয়েট গেল, এর মানে তুই ওদেরকে জানালি আমি ওই ওয়েবসাইট বা ওয়েবপেজে ঢুকতে চাই। ওদের কাছ থেকে রিকোয়েস্টটা কোথায় যাবে, বল তো?’
‘ওরা যাদের কাছ থেকে নিয়েছে, তাদের কাছে, তাই না?’
‘এই তো ধরে ফেলেছিস! যেমন ধর, বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে সরাসরি নিলে এই রিকোয়েস্ট যাবে বিটিসিএলের সার্ভারে। ওখান থেকে এই রিকোয়েস্ট যাবে ফেসবুকের এশিয়ার সার্ভারে। এখান থেকে আবার যাবে যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো অঞ্চলের সার্ভারে।
‘রিকোয়েস্ট তো গেল, মানে তুই আবেদন করলি। সেই আবেদন তো মঞ্জুর হতে হবে। মানে, সেই সার্ভার অনুমতি দিলে তারপর সংযোগ তৈরি শুরু হবে। এই পুরো কাজটা হবে দুটি বিষয় মাথায় রেখে। কোন পথে সংযোগ দিলে সবচেয়ে কম সার্ভার বা ধাপের মাধ্যমে তথ্য আদান–প্রদান করা যায়। আর ভুল কীভাবে সবচেয়ে কম হবে। এই দুটি জিনিস খেয়াল রেখে সংযোগ তৈরি হবে। তখন তোর কম্পিউটার কাঙ্ক্ষিত সার্ভারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। সার্ভারকে বলে, আমি এই ওয়েবপেজটা দেখতে চাই। সেটা হতে পারে ফেসবুক বা ইউটিউব ভিডিও কিংবা অন্য কিছু। এই পুরো কথাবার্তাটা একটা নিয়ম মেনে হয়, ইন্টারনেটের ভাষায়। এই নিয়মটার আবার একটা ভারিক্কি নাম আছে, টিসিপি/আইপি। মানে, ট্রান্সমিশন কন্ট্রোল প্রটোকল/ইন্টারনেট প্রটোকল।
‘এই এত কিছু যে তোকে বললাম, এর কারণ কী, জানিস? কারণ, এই টিসিপি/আইটি সিস্টেমে ইন্টারনেট তথ্য আদান–প্রদান করে সেই যে তোকে বললাম প্যাকেট সুইচিং—এই প্যাকেট সুইচিং পদ্ধতিতে।’
‘আচ্ছা! এবার বুঝলাম। কিন্তু কম্পিউটার ভুল-শুদ্ধ কীভাবে বোঝে, মামা?’
‘এই বিষয়টা একটু জটিল। একদম সহজ করে যদি বলি, প্যাকেটের শুরুতে একটা ঘর থাকে আলাদা করা। এই ঘরের শূন্য বা এক দেখে বোঝা যায়, তথ্যটা ঠিক আছে কি না।’
‘আচ্ছা! তার মানে, এখন ওই সার্ভার থেকে আমার কম্পিউটারে ডাটার প্যাকেটগুলো আসবে, তাই তো?’
‘হ্যাঁ। এই প্যাকেটগুলো জোড়া দেবে ব্রাউজার।’
‘কিন্তু প্যাকেটগুলোর কোনটার পরে কোনটা বুঝবে, এটা বোঝে কীভাবে?’
‘এটাও আরেকটা জটিল ব্যাপার। এর মধ্যে অনেক ঘটনা আছে। সহজ করে বললে, প্যাকেটের শুরুতে যেমন বিশেষ ঘর থাকে, শেষে এ রকম একটা বিশেষ ঘর থাকে। এই ঘরে বলা থাকে পরের প্যাকেট কোনটা হবে। এই ঘর দেখে দেখে সবগুলো প্যাকেট জিগস পাজলের মতো করে জোড়া দেয় ব্রাউজার। জোড়া দিলে—ওই যে আগে বললাম না এইচটিএমএল, এ রকম একটা এইচটিএমএল পেজ পাওয়া যায়। আর সব প্যাকেট এসে না পৌঁছালে কী হবে, তা তো বুঝতেই পারছিস?’
‘হ্যাঁ! লোড হতে থাকবে, তাই না?’
‘ঠিক তাই!’
‘একপলকে এত কিছু হয়ে যায়! অবিশ্বাস্য ব্যাপার, মামা!’
‘হ্যাঁ। পুরো পৃথিবীর বিজ্ঞানী আর প্রকৌশলীরা এত দিন ধরে চেষ্টা করে ইন্টারনেটকে আজকের অবস্থায় নিয়ে এসেছেন। এখন ওনারা ইন্টারনেট আরও উন্নত করতে চাইছেন।’
‘ফ্যান্টাবুলাস ব্যাপার, মামা!’
মামা হেসে ফেললেন। তারপর বললেন, ‘তুই তো ধীরে ধীরে টেক-এক্সপার্ট হয়ে যাচ্ছিস! এখন যা, তোকে যে গল্প শোনালাম, সে জন্য আপাকে বলে আমাকে এক কাপ চা এনে দে।’
রাফি উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘আমার জন্যও এক কাপ আনব। তারপর তোমার কাছে আরও গল্প শুনতে হবে।’