যোদ্ধা ভালুক ওয়েটেক

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। মিত্রবাহিনীর হয়ে ব্রিটিশ সেনাদের সঙ্গে লড়াই করার জন্য তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন একদল পোলিশ সেনা। পোল্যান্ডের সেনাদলে এক যোদ্ধাকে দেখে অবাক হয়ে যায় ব্রিটিশরা। যুদ্ধে পোলিশ সেনাদের হাতে বিশাল বিশাল কামানের গোলা তুলে দেওয়া সেনাটি আর কেউ নয়, এক ভালুক। সাধারণ কোনো ভালুক ছিল না সে, ওয়েটেক নামের ভালুকটি ছিল পোলিশ সেনাদলের এক বীর সৈনিক। পোলিশ শব্দ ‘ভয়েচেক’ থেকে ব্রিটিশদের দেওয়া এই নামের মানে ‘সুখী এক যোদ্ধা’।

ওয়েটেক ছিল সিরিয়ান ব্রাউন বিয়ার বা সিরিয়ার বাদামি প্রজাতির ভালুক। মাঝারি আকৃতির ভালুক এগুলো। মধ্য এশিয়ার ককেশাস অঞ্চলের পাহাড়ে এগুলোর বেশি দেখা মেলে।

পোলিশ সেনাবাহিনীর একজন নিয়মিত সেনা ছিল ওয়েটেক। তার বেতন বই ছিল। ছিল পদবি। এমনকি সেনাসদস্য হিসেবে একটা সিরিয়াল নম্বরও ছিল তার। সৈনিক হিসেবে স্যালুট দিতে শিখে গিয়েছিল সে। যুদ্ধের অবসরে অন্যান্য সেনাসদস্যের সঙ্গে কুস্তি লড়ত ওয়েটেক। সেনাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড অনুসরণ করত ভালুকটা। লড়াইয়ের পর সেনাদের সঙ্গে আনন্দেও যোগ দিত। সৈনিক হিসেবে ফল, জ্যাম, মধু ও বিভিন্ন ফলের সিরাপ তার রেশন হিসেবে বরাদ্দ ছিল। সকালে কফি খেতে ভালোবাসত ওয়েটেক। রাতে ভীষণ শীত পড়লে সৈনিকদের সঙ্গে তাঁবুতে রাত কাটাত বাদামি ভালুকটা।

মিত্রবাহিনীর সেনারা তাকে ‘প্রাইভেট ওয়েটেক’ নামে ডাকতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইতালিতে সংঘটিত মন্টি ক্যাসিনোর যুদ্ধের সময় ওয়েটেকের ওজন ছিল ৯০ কেজি। সাধারণত কামানের গোলা বহনকারী বাক্স বহন করত ওয়েটেক। সৈনিকদের হাতে তুলে দিত কামানের গোলা। চারজন সৈনিক যে বাক্স টানতে পারতেন, সেটা একাই বয়ে নিয়ে যেত ওয়েটেক। এই কাজে সে এতই দক্ষ ছিল যে তার হাত থেকে কোনো দিন কোনো গোলা মাটিতে পড়েনি।

ওয়েটেকের জন্ম ও বেড়ে ওঠার কাহিনি আর পোলিশ সেনাদলের কাহিনি যেন এক সূত্রে গাঁথা। ১৯৪২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে গঠিত হয় পোলিশ বাহিনী আন্দের’সের সেনাদল। পরে এই বাহিনী পূর্ব পোল্যান্ড থেকে বিতাড়িত হয়ে পালিয়ে যায় ইরানে। ১৯৪২ সালের ৮ এপ্রিল ইরানের হামাদান রেলস্টেশনে মসেই সেনাদলের সদস্যরা একটা রেলগাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এমন সময় তাঁরা দেখেন, এক ইরানি বালক এক ভালুকশাবক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুদিন আগে এক শিকারির হাতে নিহত হয় শাবকটির মা। ভালুকশাবকটিকে ইরানি ছেলেটি আশ্রয় দিলেও খাবার জোটাতে পারছিল না। সে সময় পোলিশ সেনাদলের সঙ্গে ছিল ইরেনা নামের এক মেয়ে। ভালুকশাবকটিকে কিনতে চাইল সে। তখন সেনাদলের এক সৈনিক আনাতোল তারানোওয়েকি ভালুকটিকে কিনে নেন। ইরানের রাজধানী তেহরানের কাছে পোলিশ এক উদ্বাস্তু শিবিরে তিন মাস ইরেনার যত্নে বেড়ে ওঠে ওয়েটেক। তাকে ‌‌‌‘দ্বিতীয় পরিবহন সেনাদল’ নামের এক পোলিশ বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। এরপর পোলিশ ২২তম আর্টিলারি সাপ্লাই কোম্পানিতে যুক্ত হয় ওয়েটেক। সেখানেই শুরু হয় তার সৈনিক জীবন।

এই সেনাদলের সঙ্গে ইরাক, সিরিয়া, প্যালেস্টাইন ও মিসরে গিয়ে শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ওয়েটেক। মিসরে যাওয়ার পর পোলিশ এই বাহিনী যুক্ত হয় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে। ব্রিটিশ বাহিনী সে সময় তাকে দেখে অবাক হয়ে যায়। ১৯৪২ সালে ব্রিটিশ সেনাদল ইতালি আক্রমণ করে। তখন পোলিশ সেনাদলের সঙ্গে ব্রিটিশ সেনাদের এই আক্রমণে যুক্ত হয় ওয়েটেক। আর এই যুদ্ধে বীরত্বের জন্য তাকে করপোরাল র৵াঙ্ক প্রদান করা হয়। সে সময় এই ভালুকের কাহিনি ব্রিটিশ প্রচারমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

১৯৪৫ সালে পরিসমাপ্তি ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। যুদ্ধের পর ব্রিটিশ সেনাদল ওয়েটেককে স্কটল্যান্ডে নিয়ে যায়। পোলিশ-স্কটিশ অ্যাসোসিয়েশন নিজেদের সম্মানিত সদস্য করে নেয় ওয়েটেককে।

১৫ নভেম্বর ১৯৪৭ সালে স্কটল্যান্ডের এডিনবরা চিড়িয়াখানায় এক বিশেষ আবাসস্থল তৈরি করা হয়। ওয়েটেক তার অবশিষ্ট দিনগুলো সেখানে শান্তিতে অতিবাহিত করে। মাঝেমধ্যেই তাকে দেখতে আসতেন পোল্যান্ডের সেই সেনারা, যাঁদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছিল সে। সৈন্যরা যখন পোলিশ ভাষায় তার সঙ্গে কথা বলতেন, সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দিত ওয়েটেক। পরিচিত সৈনিকদের দেখলে খুশি হতো সে। সৈনিকেরাও তার জন্য উপহার নিয়ে আসতেন।

দিন দিন ব্রিটেনে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ওয়েটেক। স্থানীয় সংবাদপত্র তাকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করত। ‘ব্লু পিটার’ নামে বিবিসির ছোটদের এক জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের নিয়মিত অতিথি ছিল সে। ১৯৬৩ সালে ওয়েটেক মৃত্যুবরণ করে। সে সময় তার বয়স ছিল ২১ বছর, ওজন হয়েছিল ৫০০ কেজি আর উচ্চতা ছিল ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি।

মৃত্যুর পরে লন্ডনের ইম্পেরিয়াল ওয়ার মিউজিয়ামে তার একটা ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়। স্কটল্যান্ডের এডিনবরার জর্ডান পার্ক, পোল্যান্ডের পোজনান শহরসহ ইতালি ও অন্য বেশ কয়েকটি স্থানে ওয়েটেকের স্মৃতিতে ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে।