টাইটান অভিযাত্রীদের শেষ মুহূর্ত
ডুবে যাওয়া সাবমার্সিবল টাইটান নিয়ে এখনো আলোচনা হচ্ছে। গত জুন মাসের শেষ দিকে মানুষ ব্যস্ত ছিল টাইটান সাবমার্সিবলের খবর নিয়ে। টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখার জন্য পাঁচজন যাত্রী নিয়ে ডুব দেয় টাইটান। ৩ হাজার ৫০০ মিটার গভীরে যাওয়ার পর বিস্ফোরিত হয় এটি। ঠিক কীভাবে এই ডুবোযান ধ্বংস হলো, এ নিয়ে মানুষের আগ্রহ কমেনি এখনো। যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমস এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন ছেপেছে। যেখানে বলা হয়েছে, টাইটানের যাত্রীরা তাঁদের শেষ মুহূর্তগুলো কাটিয়েছেন অন্ধকারে। প্রিয় গান শুনতে শুনতে হঠাৎ কিছু বুঝে ওঠার আগেই মারা গেছেন তাঁরা।
টাইটানের পাঁচজন যাত্রীর একজন পাকিস্তানি ব্যবসায়ী শাহজাদা দাউদ ও তাঁর ছেলে সুলেমান দাউদ। শাহজাদা দাউদের স্ত্রী ক্রিস্টিন নিউইয়র্ক টাইমসে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। তিনি জানান, শাহজাদা দাউদ টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখার জন্য খুব আগ্রহী ছিলেন। ২০১২ সালে সিঙ্গাপুরে একটি প্রদর্শনী দেখে ধ্বংসাবশেষ দেখার আগ্রহ তৈরি হয় তাঁর। একসময় জানতে পারেন, টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখার সুযোগ করে দেয় ওশানগেট নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ক্রিস্টিনেরও যাওয়ার কথা ছিল এই অভিযানে। কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারির কারণে যেতে দেরি হয় তাঁর।
২০১৯ সালে গ্রিনল্যান্ড ভ্রমণ করেন দাউদ। এরপর টাইটানিকের প্রতি মুগ্ধতা বাড়ে তাঁর। বরফের দিগন্ত আর হিমবাহ থেকে বরফ ভেঙে পড়ার দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হন এই ব্যবসায়ী। ১৯১২ সালে এমনই এক হিমবাহের আঘাতে ডুবে গিয়েছিল টাইটানিক। টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের তলদেশে প্রায় ১২ হাজার ৫০০ ফুট বা ৩ হাজার ৮০০ মিটার গভীরতায় পড়ে আছে। কানাডার নিউফাউন্ডল্যান্ড উপকূল থেকে প্রায় ৩৭০ নটিক্যাল মাইল দূরে, সমুদ্র তলদেশে ডুবে আছে এর ধ্বংসাবশেষ।
ক্রিস্টিনের পরিবর্তে দাউদের ভ্রমণসঙ্গী হন তাঁদের সন্তান সুলেমান। যদিও সমুদ্রের গভীরে যেতে চাননি তিনি। বাবা দিবসে বাবার সঙ্গে গেলে বাবা খুশি হবেন, এই ভেবে যেতে রাজি হন ১৯ বছর বয়সী সুলেমান। টাইটানের যাত্রী হয়ে ডুব দেওয়ার সময় সঙ্গে একটি রুবিকস কিউব নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তাঁদের এই ভ্রমণে প্রত্যেকের জন্য আড়াই লাখ মার্কিন ডলার ফি দিতে হয়েছে।
টাইটানের অন্য তিন যাত্রী হলেন ওশানগেটের প্রধান নির্বাহী এবং টাইটানের পাইলট স্টকটন রাশ, ব্রিটিশ অভিযাত্রী হামিশ হার্ডিং এবং টাইটানিক বিশেষজ্ঞ পল-হেনরি নারজোলেত। হ্যামিশ হার্ডিং মহাকাশে গেছেন। দক্ষিণ মেরুতেও ভ্রমণ করেছেন বেশ কয়েকবার। ৭৭ বছর বয়সী পল হেনরি নারজোলেত ফরাসি নৌবাহিনীর সাবেক ডুবুরি। ১৯৮৭ সালে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষের এলাকায় যাওয়া প্রথম অভিযানকারী দলের সঙ্গে ছিলেন তিনি।
গত ১৬ জুন পোলার প্রিন্স নামের একটি কানাডিয়ান জাহাজ নিউফাউন্ডল্যান্ড থেকে টাইটানকে নিয়ে সমুদ্রে রওনা দেয়। ১৮ জুন সকালে অভিযান শুরু হয়। প্রস্তুতি নিয়ে ১০টা ৪৫ মিনিটে ডুব দেয় টাইটান। ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট পর পোলার প্রিন্সের সঙ্গে টাইটানের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। মেসেজের মাধ্যমে এই যোগাযোগ করতেন তাঁরা। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার ৮ ঘণ্টা পর জানানো হয় কোস্টগার্ডকে। পরদিন শুরু হয় উদ্ধার অভিযান। প্রথমে যাত্রীদের জীবিত উদ্ধারের চেষ্টা চালানো হলেও একসময় জানা যায়, বিস্ফোরণে টাইটান ধ্বংস হয়ে গেছে, কেউই আর বেঁচে নেই।
মার্কিন কোস্টগার্ডের একজন মুখপাত্র বলেন, ‘বিপর্যয়কর বিস্ফোরণের’ শিকার হয়েছিল টাইটান। বিস্ফোরণে পাঁচ যাত্রীর সবাই মারা গেছেন। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর মার্কিন নৌবাহিনী রোববার ‘বিস্ফোরণ বা বিস্ফোরণের মতো অবস্থা’ শনাক্ত করেছিল। ৩ হাজার ৫০০ মিটার গভীরে বাইরের চাপে ভেতরের দিকে বিস্ফোরণ হয়। খুব দ্রুত ভেতরের বাতাসে আগুন ধরে বিস্ফোরিত হয় টাইটান। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সবাই মারা যান। প্রায় এক মিলিসেকেন্ড বা এক সেকেন্ডের এক হাজার ভাগের এক ভাগ সময়ে এই বিস্ফোরণ ঘটে। কোনো ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানাতে প্রায় ১৫০ মিলিসেকেন্ড পর্যন্ত সময় নেয় মানুষের মস্তিষ্ক। তাই টাইটানের অভিযাত্রীরা গান শুনতে শুনতে বুঝে ওঠার আগেই হারিয়ে যান সমুদ্রের অতলে।