সবচেয়ে উঁচুস্বরে ডাকা ৭ প্রাণী

পাখী-সব করে রব, রাতি পোহাইল

কাননে কুসুমকলি, সকলি ফুটিল।

মদনমোহন তর্কালঙ্কারের এই কবিতার লাইন দুটি তোমার হয়ত জানা আছে। এই লাইনের সারমর্ম হলো, পাখিরা ডাকলেই বোঝা যায় সকাল হয়েছে। যারা গ্রামে বাস করো বা মাঝেমধ্যে গ্রামে যাও, তারা নিশ্চয়ই জানো, সকালে পাখি কিচিরমিচির করে ডাকে। এই পাখিদের ডাক শুনেই ঘুম ভাঙে অনেকের। তবে পাখির ডাক না শুনলেও মোরগের ডাক কিন্তু শুনতে পারো। ভোর হলে মোরগও ডেকে ওঠে কুকুড়ুকু কুকুড়ুকু। তবে তোমার যদি ভোরে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস না থাকে, তাহলে সকালে পাখির ডাক শোনার কথা নয়। তবে তুমি হয়তো সকালে ঘুম থেকে উঠেই বিড়ালের ডাক শুনতে পারো। বাসায় কুকুর থাকলে মাঝেমধ্যেই এর ডাক শোনা যায়। এই যে এত এত প্রাণীর ডাক শোনার কথা বললাম, এর কোনোটা শুনে কি হঠাৎ বিরক্ত হও? মনে হয়, এত জোরে চিৎকার করে কেন? যদি এমন মনে হয়, তাহলে প্রাণীর চিৎকার আরও কত জোরে হতে পারে, সে সম্পর্কে তোমার জানা আছে কি? এই লেখায় সেই ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করবো। সঙ্গে জানবো, সবচেয়ে উচ্চস্বরে ডাকা ৭ প্রাণী নিয়ে।

তবে মূল প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে একটুখানি বিজ্ঞান না জানলে এই লেখাটির মর্ম হয়ত পুরোপুরি উদ্ধার করতে পারবে না। কারণ, ফ্রিকোয়েন্সি ও তীব্রতা সম্পর্কে তোমাদের একটু ধারণা থাকতে হবে। মানুষের শ্রবণশক্তি দুইভাবে মাপা হয়। ফ্রিকোয়েন্সি ও তীব্রতা দিয়ে। ফ্রিকোয়েন্সি মানে কোনো শব্দ কত দূর থেকে শোনা যায়। মানুষের শ্রবণশক্তি হলো ২০ থেকে ২০ হাজার হার্জ। এর মানে কোনো শব্দ যদি এই ফ্রিকোয়েন্সির মধ্যে থাকে, তাহলে তুমি সেই শব্দ শুনতে পারবে। ২০ হার্জের কম হলেও শুনতে পারবে না, আবার ২০ হাজার হার্জের বেশি হলেও তা শুনতে পারবে না। 

আর তীব্রতা মানে হলো, কত উচ্চস্বরের আওয়াজ সহ্য করা যায়। মানুষ সর্বোচ্চ ১২০ ডেসিবল পর্যন্ত আওয়াজ সহ্য করতে পারে। শব্দের তীব্রতা পরিমাপের একক ডেসিবল। অনেক রক কনসার্টের শব্দের তীব্রতা ১২০ ডেসিবলে পৌঁছে যায়। 

এখানে আমরা যে ৭টি প্রাণী নিয়ে আলোচনা করবো। সেগুলো এই শব্দের তীব্রতা বিচারে। মানে কোন প্রাণী কতটা তীব্র শব্দ করতে পারে বা কত ডেসিবলের শব্দ করতে পারে, তা হিসেব করেই এই তালিকা তৈরি করা হয়েছে। বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সময় প্রাণীদের শব্দের তীব্রতা রেকর্ড করেছেন। সেউ রেকর্ডের বিচারেই করা হয়েছে এই তালিকা। 

আরও পড়ুন

১. নীল তিমি

নীল তিমি শুধু বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রাণী নয়, এটি সবচেয়ে জোরে আওয়াজও করতে পারে। এই আওয়াজকে বলা হয় তিমির গান। ওরা গানের তীব্রতা প্রায় ১৮৮ ডেসিবল পর্যন্ত হতে পারে। একটা জেট ইঞ্জিনের চেয়েও এদের গানের আওয়াজ বেশি। সুস্থ মানুষের কানের পর্দা ক্ষতিগ্রস্থ করার জন্য শুধু নীল তিমির গানই যথেষ্ট। এরা সাধারণত একা থাকে। তবে সঙ্গীকে ডাকতে হলে প্রায় ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার দূর থেকেও সংকেত পাঠাতে পারে। তবে নীল তিমি কীভাবে এত উচ্চস্বরে আওয়াজ করে, তা এখনো বিজ্ঞানীরা জানতে পারেনি।

২. স্পার্ম তিমি

১০ হাজার ফুট গভীরে ডুব দিয়েও স্পার্ম তিমি শব্দ করতে পারে। এদের শব্দের তীব্রতা ২৩০ ডেসিবলেও পৌঁছে যেতে পারে। হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছ। নীল তিমির চেয়েও স্পার্ম তিমির শব্দের তীব্রতা বেশি। তবে দুটি কারণে একে দ্বিতীয় স্থানে রাখা হয়েছে। প্রথমত, নীল তিমির মতো অনেক দূর থেকে এদের শব্দ শোনা যায় না। আর দ্বিতীয়ত, এরা সবসময় ২৩০ ডেসবিলে শব্দ উৎপন্ন করতে পারে না। এমন উচ্চস্বরে শব্দ উৎপন্ন করতে পারে খুব অল্প সময়। 

আরও পড়ুন

৩. বোহেড তিমি

এটিও একটা সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী। এদের বেলিন তিমিও নবলা হয়। প্রায় ১৫ ফুট দৈর্ঘ্য এ তিমিগুলো প্রায় ১৫৯ ডেসিবলে শব্দ উৎপন্ন করতে পারে। তবে অল্প সময় পরেই এদের শব্দের তীব্রতা ও ফ্রিকোয়েন্সি কমতে থাকে। এদের মাথা অনেক বড়, তা হয়তো নাম দেখেই বোঝা যায়। প্রায় ২০০ বাঁচে এই প্রজাতির তিমিরা। 

৪. গ্রেটার বুলডগ বাদুড়

বাদুড় প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে উচ্চস্বরে ডাকে এই গ্রেটার বুলডগ বাদুড়। ১৪০ ডেসিবল পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে এদের শব্দের তীব্রতা। সাধারণত বাদুড় ভালো চোখে দেখে না। তাই শব্দের সাহায্যে সামনে এগিয়ে যায়। এরা প্রায়ই মাছ শিকার করে খায়। তাই এ বাদুড় ফিশারম্যান বাদুড় নামেও পরিচিত। বন্দুক থেকে গুলি বের হলে যেমন তীব্র শব্দ হবে, এই বাদুড়ের ডাকের তীব্রতা অনেকটা তেমন। 

আরও পড়ুন

৫. আফ্রিকান সিকাডা

পোকামাকড়ের মধ্যে সবচেয়ে উচ্চস্বরে ডাকতে পারে আফ্রিকান সিকাডা। ওদের ডাকের তীব্রতা ১০৭ ডেসিবল। সিকাডা সাধারণত গ্রীষ্মকালে সক্রিয় হয়ে উঠে এবং প্রজনন চক্রের অংশ হিসেবে গান গায়। এদের শরীরে একটা বিশেষ অঙ্গ থাকে, যা টিমবাল নামে পরিচিত। এই টিমবাল দ্রুত কাঁপিয়ে এরা জোরে শব্দ তৈরি করে। ওদের শব্দ শুনলে মনে হবে, একসঙ্গে অনেকগুলো ড্রাম বাজছে। 

৬. সিনালফিয়াস পিংকফ্লয়ডি

কিংবদন্তি রকম ব্যান্ড পিংক ফ্লয়েডের নামানুসারে এই চিংড়ির নামকরণ করা হয়েছে সিনালফিয়াস পিংফ্লয়ডি। এ প্রজাতির চিংড়ি প্রথম খুঁজে পাওয়া গেছে ২০১৭ সালে। ছোট মাছ শিকার করার সময় এরা এক ধরণের শব্দ করে। সেই শব্দের তীব্রতা প্রায় ২১০ ডেসিবলে পোঁছায়। কিন্তু এটাও ওই স্পার্ম তিমির মতো একই কারণে তালিকার ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে। 

আরও পড়ুন

৭. সিংহ

সিংহের গর্জন নিশ্চয়ই শুনেছ। বাস্তবে না শুনলেও মুভি, ইউটিউব—কোনো না কোনো মামধ্যে শোনার কথা। হাড় হিম করা গর্জন করে ওঠে এরা। বিড়ালজাতীয় প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে জোরে শব্দ করতে পারে এই সিংহ। এদের শব্দের তীব্রতা প্রায় ১১৪ ডেসিবল। ৮ কিলোমিটার দূর থেকে শোনা যায় সিংহের গর্জন। পুরুষ সিংহ সাধারণত নিজেদের আধিপত্যের সংকেত দেওয়ার জন্য গর্জন করে। মাঝেমধ্যে মহিলা সিংহ অনুপ্রবেশকারীদের ভয় দেখানোর জন্য গর্জন করে। আবার পুরুষ সিংহ মহিলা সিংহের সঙ্গে যোগাযোগ করতেই ওদের উচ্চ শব্দের গর্জন করে থাকে। তবে  কোন গর্জন কীসের সংকেত, তা ওরাই ভালো জানে। হয়তো কোনো প্যাটার্ন আছে যা দেখে ওরা বুঝতে পারে কোন স্বরের মানে কি। 

সূত্র: লাইভ সায়েন্স ও হাউ স্টাফস ওয়ার্কস

আরও পড়ুন