এলিয়েনের খোঁজে নেমেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় রেডিও টেলিস্কোপ
মহাবিশ্বে শুধু পৃথিবীতেই প্রাণ আছে কি না, এই প্রশ্ন ইতিহাসজুড়ে অনেক মানুষই জানতে চেয়েছে। পৃথিবীর বাইরে প্রাণ কল্পনা করে বলা হয়েছে এলিয়েন। এর অস্তিত্ব প্রমাণ করার জন্য বিজ্ঞানীরা মহাকাশে অসংখ্য তারা এবং গ্রহ পর্যবেক্ষণ করছেন। এই অনুসন্ধানে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার রেডিও টেলিস্কোপ। এই টেলিস্কোপগুলো বিশাল অ্যানটেনা ব্যবহার করে মহাকাশ থেকে আসা রেডিও তরঙ্গ গ্রহণ করে। এই তরঙ্গগুলো গ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সি এমনকি সম্ভাব্য এলিয়েন সভ্যতার বিষয়ে মূল্যবান তথ্য দিতে পারে বিজ্ঞানীদের।
বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম একক প্যারাবোলিক বা পরাবৃত্ত প্রতিফলক রেডিও টেলিস্কোপ হলো এফএএসটি বা ফাইভ হানড্রেড মিটার অ্যাপারচার স্ফেরিক্যাল টেলিস্কোপ। অ্যাপারচার স্ফেরিক্যাল টেলিস্কোপ হলো একধরনের রেডিও টেলিস্কোপ, যাতে একটি বৃহৎ, গোলাকার প্রতিফলক থাকে। এই প্রতিফলক রেডিও তরঙ্গগুলোকে চিহ্নিত করে এবং এটিকে একটি অ্যানটেনায় প্রেরণ করে। অ্যানটেনাটি তরঙ্গগুলোকে বিদ্যুৎ-সংকেতে রূপান্তর করে, যা বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্ব সম্পর্কে তথ্য অর্জনের জন্য বিশ্লেষণ করেন।
এই টেলিস্কোপ সবার কাছে ‘ফাস্ট’ নামে পরিচিত। এটি চীনের পিংডং প্রদেশে দক্ষিণাঞ্চলের পাহাড়ের ওপর নির্মাণ করা হয়েছে। এটি ৫০০ মিটার ব্যাসের একটি বিশাল গোলাকার রিফ্লেক্টর বা প্রতিফলক নিয়ে গঠিত, যা প্রায় ৩০টি ফুটবল মাঠের সমান। তিন বছর ধরে বিশাল কর্মযজ্ঞের পর ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকল্পটি তৈরির কাজ শেষ হয়। আর ২০২০ সালের শুরুতেই এর কার্যক্রম শুরু হয়। প্রকল্পটি শুরুতে এর বিশালতার জন্য সবাই মনে করেছিল পৃথিবীর বাইরে এলিয়েনদের অস্তিত্ব খুঁজতে এই টেলিস্কোপ ব্যবহার করা হবে। এটি অসম্ভব বলে মনে হলেও এটি একটি বাস্তব সম্ভাবনা ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের আরেসিবো অবজারভেটরি ৫৩ বছর ধরে বিশ্বের বৃহত্তম রেডিও টেলিস্কোপের খ্যাতি ধরে রেখেছিল। পুয়ের্তোরিকোতে অবস্থিত পর্যবেক্ষণকেন্দ্রটি ২০২১ সালে নভেম্বর মাসে যান্ত্রিক ত্রুটি ও ধসে পড়ার পর বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ ঘটনার ফলে চীনের ‘ফাস্ট’ বিশ্বের বৃহত্তম রেডিও টেলিস্কোপে পরিণত হয়েছে। ‘স্কাই আই’ নামেও পরিচিত এই টেলিস্কোপ। ‘ফাস্ট’ কর্তৃপক্ষ এ উপলক্ষে বিশ্বের সব জ্যোতির্বিজ্ঞানীর জন্য তাঁদের দরজা খুলে দিচ্ছে। তারা আশা করছে যে নতুন গবেষক এবং প্রতিষ্ঠানগুলো এই শক্তিশালী টেলিস্কোপ ব্যবহার করে মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচনে অবদান রাখবে।
যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানী টিম ও’ব্রায়েন চীনের ‘স্কাই আই’ রেডিও টেলিস্কোপ সম্পর্কে তাঁর মতামত জানায়। তিনি বলেন, ‘এই টেলিস্কোপের আকারই বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার ক্ষমতা মূল চাবিকাঠি।’ ‘টেলিস্কোপের আকার যত বড় হবে, তত বেশি রেডিও তরঙ্গ সংগ্রহ করতে পারবে এবং ক্ষুদ্র ও ক্ষীণ বস্তুগুলোকে পর্যবেক্ষণ করতে পারবে’। এটি বর্তমানে চালু থাকা যেকোনো টেলিস্কোপের চেয়ে ২ দশমিক ৫ গুণ বেশি সংবেদনশীল।
এই অসাধারণ টেলিস্কোপের চারপাশে ৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে রেডিও সাইলেন্স জোন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এই অঞ্চলে মুঠোফোন, কম্পিউটার এবং ল্যাপটপ অর্থাৎ এ ধরনের ইলেকট্রনিকস যন্ত্রাংশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কারণ, সামান্যতম ইলেকট্রনিক ফ্রিকোয়েন্সি ‘স্কাই আই’-এর সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণগুলোকে ব্যাহত করতে পারে। এই নিষেধাজ্ঞা কঠোর হলেও এটি বিজ্ঞানীদের মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচনের জন্য অভূতপূর্ব সুযোগ প্রদান করে। এই শক্তিশালী টেলিস্কোপ ব্যবহার করে তাঁরা লাখো বছর আগে ঘটা মহাজাগতিক ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম। এটি নির্মাণে ১৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হয়েছে।
‘স্কাই আই’ ৪ হাজার ৪০০টি অ্যালুমিনিয়াম প্যানেল দিয়ে তৈরি, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। এই প্যানেলগুলো একসঙ্গে একটি বিশাল প্রতিফলক হিসেবে কাজ করে, যা আকাশের বিভিন্ন দিকে তাক করা যায়। এই নমনীয়তা ‘স্কাই আই’কে মহাবিশ্বের যেকোনো বিন্দু পর্যবেক্ষণ করতে দেয়।
এলিয়েনের খোঁজে এ ধরনের প্রকল্প এটি প্রথম নয়। এর আগে ১৯৭৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আরেসিবো অবজারভেটরিতে ‘সার্চ ফর এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ (SETI) প্রকল্পের অংশ হিসেবে একই ধরনের কাজ শুরু করা হয়েছিল। এই প্রকল্পে বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল সেগান আরেসিবো টেলিস্কোপ ব্যবহার করে হারকিউলিস নক্ষত্রপুঞ্জে একটি রেডিও বার্তা প্রেরণ করেছিলেন। এই বার্তার মাধ্যমে পৃথিবীর বাইরে বুদ্ধিমান প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে বের করার আশা করা হয়েছিল। যদিও এসইটিআই প্রকল্প থেকে এখন পর্যন্ত কোনো স্পষ্ট ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া যায়নি। তবু এটি মহাকাশে বুদ্ধিমান জীবনের সন্ধানের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল। ‘স্কাই আই’-এর অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এসইটিআই গবেষণাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে বলে ধারণা চীনা জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের।
সূত্র: নিউ সায়েন্টিস্ট ও স্পেস ডট কম