মেঘ–জোছনা–বৃষ্টির দেশে

ভরা শ্রাবণের মেঘকালো হয়ে আসা আলসে দুপুরবেলা। পাহাড়ের খাদে বানানো কাঠের বাড়ির ঝুলবারান্দায় বসে আছি। আমার ঠিক নিচে মাইলখানেক দূরে মেঘে মেঘে ধাক্কা লেগে চোখধাঁধানো আলোর ঝলকানিতে ঝালাপালা শব্দে বাজ পড়ল হঠাৎ। যেন মেঘ ফুঁড়ে মিয়োনির হাতে থর নেমে গেল থ্যানোসের খোঁজে! বজ্রপাত সব সময় দেখে এসেছি আকাশ থেকে নিচে পড়তে। পাহাড়ের ওপর বসে জীবনে প্রথমবারের মতো দেখলাম আমার ঠিক নাক বরাবর উচ্চতা থেকে বাজ পড়ল নিচে! এ এক অপার্থিব অভিজ্ঞতা! বজ্রবিদ্যুতের আলোর দ্যুতির সঙ্গে বজ্রনিনাদ যে কত ভয়াবহ জোরালো হতে পারে, তা পাহাড় থেকে এই বজ্রপাত না দেখলে বোঝা শক্ত। বজ্রপাতকে আজীবন বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আসা এই আমারও কলজে কাঁপিয়ে দেয় পাহাড়ি এসব বজ্রপাত। তবে এই বজ্রপাতের সৌন্দর্যের কাছে বজ্রনিনাদের ধমক অল্পতেই ম্লান হতে বাধ্য!

আরও পড়ুন

ঝুলবারান্দার ঠিক সামনে থেকেই নেমে গেছে গভীর খাদ, খাদের ওধার থেকে আবার আস্তেধীরে আয়েশ করে খাঁজ কেটে কেটে উঠে গেছে পাহাড়, বেশ দূরে, আকাশের কাছাকাছি! দেখলে মনে হয় অতিকায় কোনো বাটির ভেতর গাছপালা লাগিয়ে কেউ আলগোছে ফেলে দিয়েছে। সেই বাটির একধারের কিনারায় বসে বসে দেখছি আমি।

শ্রাবণের গাঢ় মেঘ যেন গিলে খেয়েছে ওপারের পাহাড়, নিচের গভীর খাদ। ঝুলবারান্দায় বসে সেই মেঘ দেখছিলাম আমি, ঝমঝমিয়ে কীভাবে বৃষ্টি নামে সেটা দেখার আশায়। ঠিক এ সময়েই ওই চোখধাঁধানো বজ্রকাণ্ড ঘটল চোখের সামনে। এ রকম কাণ্ড যে সব বৃষ্টির দিন হয়, তা নয়। ভাগ্যগুণে দেখা মেলে এ রকম বজ্রপাতের। আমার ভাগ্য এদিন একটু বেশিই পক্ষে ছিল!

বজ্রপাত, রংধনু আর বৃষ্টির মোহে পড়েছিলম সাজেকে

এই মেঘ কিন্তু আমরা সচরাচর যেভাবে দেখি, মোটেই সেই রকম মাথার ওপরে না, এটাকে বরং পায়ের তলার মেঘ বলা চলে। পাহাড়ের উচ্চতার কারণে এখানে মাঝেমধ্যেই বৃষ্টির মেঘ জমে খাদের দিকে, পায়ের নিচে; ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হয়ে ঝরে আরও নিচের এলোমেলো পাহাড়ের গায়ে, কী অদ্ভুত!

আরও পড়ুন

অপার্থিব এই জায়গার নাম হচ্ছে রুইলুই পাড়া। রাঙামাটির সাজেক ইউনিয়নের একটি পাহাড়ি এলাকা। জায়গাটা মূলত সাজেক ভ্যালি নামে পরিচিত। যদিও ভ্যালি বা উপত্যকা বলতে পাহাড়ের নিচের সমতল ভূমিকে বোঝায়, কিন্তু ঠিক কীভাবে প্রায় ১ হাজার ৮০০ ফুট উঁচু পাহাড়ি চূড়ার একটা জায়গা ভ্যালি নামে বিপুল পরিচিত পেয়ে গেল, সেটা আমি ঠিক ধরতে পারি না। একটি ভুল বিষয় যে অধিক প্রচারের কারণে আস্তে আস্তে প্রতিষ্ঠিত সত্য হয়ে যেতে পারে, সেটা সাজেকের এই ভ্যালি নামে প্রতিষ্ঠিত হওয়া দেখলেই প্রমাণ পাওয়া যায়।

সাজেক মূলত একটি নদের নাম। মিজোরামের লুসাই পাহাড় থেকে উৎপত্তি হওয়া কর্ণফুলী নদী থেকে উদ্ভূত সাজেক নদের নাম থেকেই সাজেক ইউনিয়নের নামকরণ করা হয়েছে। এই সাজেক ইউনিয়ন হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন। রুইলুই পাড়া আর কংলাক পাড়ার সঙ্গে চারদিক পাহাড়কে সঙ্গী করে গঠিত ‘রাঙামাটির ছাদ’ সাজেক।

এ বছর শ্রাবণের মাঝামাঝি ছবি আঁকতে এসে সৌভাগ্যবশত সাজেকের রুইলুই পাড়ায় মাস তিনেক ছিলাম আমি। এ এক অপূর্ব মায়াবী সময় যেন! এই মায়া জগতে আমার দেখা কিছু অন্য রকম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা জানাতেই মূলত এ আয়োজন।

এ এক অপূর্ব মায়াবী সময়

এই মায়াবী জগৎ আমাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল শ্রাবণ মাসের দুর্দম পাহাড়ি বৃষ্টি সাজিয়ে! পাহাড়ের বৃষ্টির কথা ভাবলেই অন্য রকম রোমাঞ্চে উত্তাল হয়ে ওঠে মন, চোখ হয়ে ওঠে স্বপ্নালু। এই বৃষ্টি শহরের নাগরিক বৃষ্টি নয়, কিংবা সাগরের উত্তাল বর্ষাও নয়, এ হলো পাহাড়ের আয়েশি স্নিগ্ধ মন কেমন করা বর্ষণ!

আরও পড়ুন

তবে আমি এসেই যে বৃষ্টি পেলাম, সেটা যেন একটু বেশি বেশিই, যাকে বলে বাড়াবাড়ি পর্যায়ের! পাহাড়ি খাদের কাঠের ঘরটাতে একপ্রকার বৃষ্টিবন্দী হয়ে ঠুঁটো জগন্নাথ হতে বসলাম প্রায়, ছবি আঁকা উঠল লাটে। দিন নেই রাত নেই নোটিশবিহীন যখন-তখন ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে তরতাজা ঠান্ডা মেঘ, হিমের তোড়ে মিহি শিরশিরানি ওঠে শিরদাঁড়ায়।

ঘর থেকে চোখ মেলে তাকালেই যেখানে ছড়ানো–ছিটানো পাহাড়চূড়ায় ইতিউতি সাদা মেঘের ছোটাছুটি দেখতে পাওয়ার কথা, সেখানে বৃষ্টির ফ্যাকাশে চাদর ছাড়া কিছুই চোখে পড়ে না সারা দিনেও, মাথার ওপরের টিনের চালে বৃষ্টির দাপাদাপির সঙ্গে তক্ষকের ডাকে রাত হয় আরও ঘন!

টানা ১০ দিন ধরে বৃষ্টি ঝরছে তো ঝরছেই, থামার কোনো নাম নেই, শরীর-মন-বাতাসে বৃষ্টি ছাড়া অন্য কোনো গন্ধও নেই! যেন বৃষ্টির বার্ষিক পরীক্ষা শেষ, তার মা সব চোখরাঙানি ঝেড়ে ফেলে বৃষ্টিকে বলে দিয়েছে, যা ইচ্ছে কর, তোকে আমি স্বাধীন করে দিলাম! বৃষ্টির সেই লাগামছাড়া উৎসাহে তো শুরুর ১০ দিন একপলকের জন্যও সূর্যের দেখা পেলাম না।

বৃষ্টির ফ্যাকাশে চাদর ছাড়া কিছুই চোখে পড়ে না সারা দিনে

কখনোবা যদি বৃষ্টি একটু থামেও তখনো পুরো সাজেক ঢাকা থাকে মেঘের নিচে, মাঝশ্রাবণেও মাঘের কুয়াশার মতো ঝাপসা থাকে চারদিক। রাস্তায় হাঁটতে গেলে গায়ে মাথায় পরশ বুলিয়ে যায় মেঘ, ঘরের ভেতর যখন-তখন হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে মেঘ, নিশ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসে ঢুকে যায় মেঘ। এ এক মেঘাচ্ছন্ন মায়ানগর!

আরও পড়ুন

পাড়া দাপানো কিশোরের মতো দাপিয়ে দিনমান বৃষ্টি পড়ছে তো পড়ছেই, যেন পণ করেছে আর কখনো থামবে না। সূর্য বলে সৌরজগতে যে কোনো নক্ষত্র আছে, সেটা পুরোপুরি ভুলিয়ে দেবে সবাইকে! নক্ষত্রেরও যেমন একসময় মরে যেতে হয়, তেমনি সপ্তাহ দুয়েক পর বৃষ্টিও মরে এল ধীর পায়ে।

আর তাতেই যেন পাহাড়ি প্রকৃতি এক নবসৌন্দর্যের বাগান সাজিয়ে আমার সামনে মেলে ধরল অপার্থিব এক জগৎ। সামনে বৃষ্টিধোয়া চকমকে নতুন পাহাড়, ওই দূরে পাহাড়ের গায়ে ঝলমলিয়ে ওঠা জুম, পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে ছোটাছুটি করা ধবল মেঘ, মেঘের গা ফুঁড়ে বের হওয়া জোড়া রংধনু, রংধনু চিরে উড়ে যাওয়া সবুজ টিয়া পাখির ঝাঁক। টানা ১০ দিনের বিরক্তিকর বৃষ্টির সব অপরাধ যেন ঝলমলে সৌন্দর্য দিয়ে শোধ করে দিতে শুরু করল প্রকৃতি!

পরের টানা দেড় মাস নিয়মিত পাহাড়ি বৃষ্টি দেখলাম এবং পাহাড়ি বৃষ্টি কতটা আয়েশের, কতটা স্নিগ্ধতার, কতটা অনুভবের হতে পারে, তা কড়ায়-গন্ডায় আমাকে বুঝিয়ে দিল পাহাড়। এই বৃষ্টিমুখর দিনগুলো আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর বৃষ্টিযাপন হিসেবে জায়গা করে দিতে আমি একরত্তি দোনোমনা করব না।

পরের টানা দেড় মাস নিয়মিত পাহাড়ি বৃষ্টি দেখলাম

রুইলুই পাড়ায় আমার থাকার কাঠের ঘরটার সামনে দুহাত মেলা পাহাড়, ছড়ানো আকাশ। এখানে বসে দূরে মিজোরামের পাহাড়ে অদ্ভুত সুন্দর বৃষ্টির দেখা মেলে। আমি কোনো কোনো দিন রোদঝলমলে বারান্দায় বসে থাকি, আর দেখি ওদিকে সামনের পাহাড়ে তখন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। দেখলে মনে হয়, পানিভর্তি একটা বিরাট প্লাস্টিকের ব্যাগের নিচটা কেউ একজন ছুরি দিয়ে এক পোঁচে ফেড়ে দিয়েছে, ব্যাগভর্তি পানি ঝপাস করে আছড়ে পড়ছে নিচের পাহাড়ের সবুজে, নিঃসঙ্গ জুমঘরের চালায়। আবার কখনো আমি ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে দেখতে পাই—দূরের পাহাড়ে বিকেলের রোদ ঝলমল করছে, পেঁজা মেঘ ছু্ঁয়ে দিচ্ছে পাহাড়ের কপাল! কখনো কখনো বিরাট এক খণ্ড মেঘকে দেখি বৃষ্টি ঝরাতে ঝরাতে এক পাশ থেকে আরেক পাশে দুলকি চালে এগিয়ে যাচ্ছে, একেবারে চোখের সামনে দিয়েই।

সবচেয়ে অদ্ভুত লাগে যখন দেখি, একটা পাহাড়ের একপাশ তীব্র রোদে জ্বলে যাচ্ছে, আর তার সামান্য পাশেই ভেজা চড়ুইছানার মতো জবুথবু হয়ে ঝুমবৃষ্টিতে তিরতির করে কাঁপছে পাহাড়ি বনজঙ্গল! এ রকম অপার্থিব বৃষ্টির দেখা পাহাড় ছাড়া আর কোথায় মেলে!

বৃষ্টি শেষের পাহাড় হয়ে ওঠে অদ্ভুত স্নিগ্ধ, মোলায়েম আর নরম নরম। এ সময় পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকতেও আরাম!

বৃষ্টি ফুরাতেই বেশির ভাগ দিনই মেঘ ফুঁড়ে ঝলমল করে ওঠে রংধনু, পাহাড়কে চিরে দেয় সপ্তরঙের তরবারির কোপে! কখনো কখনো একত্রে জোড়া রংধনু ওঠে আকাশে, একটার সঙ্গে আরেকটা যেন রঙের জেল্লা ছড়ানোর পাল্লা দেয়। পাহাড় থেকে উঠে মেঘ ছুঁয়ে আবার পাহাড়েই নেমে পড়ে অর্ধবৃত্ত আঁকে সেই রঙের ফিতা, অদ্ভুত সুন্দর লাগে দেখতে! একদিন ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে খাদের নিচের দিকে অদ্ভুত ছোট আকারের একটা রংধনু দেখলাম। দোতলা বাস আকারে যতটুকু হয়, এই রংধনুর আকার তার চেয়ে বড় নয়! খাদের নিচের বাঁশঝাড়ের মাথায় লেপটে থাকা সাদা মেঘের জমিনে ফুটফুটে মাছরাঙার মতো রং বিলাচ্ছে এই এত্তটুকু একটা রংধনু। মনে হচ্ছিল, এটা অন্য জগতের কোনো দৃশ্য।

কুকুরটার সঙ্গে দারুণ বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল আমার

পাহাড়ের এই অপার্থিবতায় বুঁদ হয়ে থাকতে থাকতেই একটা সুন্দর ঘটনা ঘটল একদিন। জীবনে প্রথমবারের মতো তক্ষক ধরতে পারলাম। তক্ষক নামের সরীসৃপ এই প্রাণী হাতে ধরে দেখার ইচ্ছা আমার বহুদিনের ছিল! কিন্তু দিনে দিনে দুর্লভ হতে থাকা তক্ষক যেখানে চোখে দেখাটাই বিরাট ভাগ্যের ব্যাপার, সেখানে ধরে দেখাটা তো অতিকল্পনা।

আরও পড়ুন

এবার এই সৌভাগ্য হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কৃতজ্ঞতাটা দিতে হয় গুপ্ত ত্রিপুরা নামের পাহাড়ি এক কিশোরকে। মাসভর পাহাড়ে থাকতে থাকতে গুপ্ত ত্রিপুরা অনেকটা ছোট ভাইয়ের মতোই হয়ে গিয়েছিল আমার। হাতে ধরে তক্ষক দেখার ইচ্ছে আমার বহুদিনের, এটা ওকে কথায় কথায় বলেছিলাম একদিন। শুনে সে আমাকে ভরসা দিয়েছিল, ‘আমি তাকতে কোনো চিন্তা কোরবে না বায়া, তক্কা আমি দরে দেকাব আপনাকে!’

তক্ষককে গুপ্তরা ওদের ভাষায় তক্কা ডাকে। এবং গুপ্ত একদিন সত্যিই তক্ষক ধরে দিল আমাকে!

গুপ্তর হাত থেকে নিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে তক্ষক ধরে প্রথমবারের মতো দেখলাম আমি। মনের বিরাট একটা স্বপ্নপূরণ হলো! ছোট্ট একটা প্রাণী, খসখসে চামড়ার সরীসৃপ। রাতভর পোকা, টিকটিকি খায় আর অতি সুন্দর করে ‘তক্-ক্কা’ ‘তক্-ক্কা’ স্বরে ডাকাডাকি করে। এর বাইরে তেমন কোনো বিশেষত্ব নেই এটার। কিন্তু মোটা অঙ্কের টাকার লোভে কতক গুজব আর কতক কুসংস্কারে এই নির্ভেজাল প্রাণীকে দিনের পর দিন কিছু মাথামোটা মানুষ ধরে-মেরে একেবারে বিলুপ্তির কাছাকাছিই নিয়ে চলে গেছে! খুবই হতাশাজনক ব্যাপার এটা।

তক্ষক ডাকলে রাত আরও ঘন হয়, পাহাড়ি এই পাড়ায় নিয়মিত তক্ষক ডাকে। তক্ষকের ডাকে আমার ঘুম হয় গভীর সুন্দর! মাঝেমধ্যেই ভাবি, ঘরভরা যদি তক্ষক থাকত আমার, কী দারুণই না কাটত জীবন!

তক্ষককে গুপ্তরা ওদের ভাষায় তক্কা ডাকে

দু-একটা ছবি তুলে তক্ষকের মাথায় হাত বুলিয়ে সেটাকে আবার ছেড়ে দিয়েছিলাম তখনই। ছেড়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে হড়বড় করে কয়েক মিটার দৌড়ে গিয়ে দু-এক সেকেন্ডের জন্য থেমে আমার দিকে তাকিয়ে ‘কক্‌কক্‌’ আওয়াজের একটা হুমকি দিয়ে পালিয়েছিল। সেটা দেখেও মনের ভেতর বেশ পুলক অনুভব করেছিলাম!

সারা বছর সাজেকে লাখো পর্যটক যে জন্য আসে, তার সবচেয়ে বড় কারণ হলো মনজুড়ানো মেঘ। সাজেককে কেউ কেউ মেঘের রাজ্য নামেও সম্বোধন করেন। কোনো কোনো দিনে সাজেকের ভোরের মেঘ এক অপার্থিব স্বর্গ রচনা করে পাহাড়ের কোলজুড়ে। মাঝরাতের শেষ ভাগে যে মেঘ জমতে থাকে, তা ভোর হতে হতে গাঢ় হয়। সূর্য ওঠার ঠিক আগে এক মায়াপুরীতে পরিণত হয় সাজেকের আকাশ-পাহাড়।

মেঘ জমলে আমি দাঁড়িয়ে থাকি পাহাড়ের ওপর, আমার অনেক নিচে ভেসে বেড়ায় ধবল মেঘের দল। কোনো কোনো দিন হাওয়ায় ভেসে এসে মেঘ ধাক্কা মারে আমার গায়ে, নিশ্বাসের সঙ্গে আমি নাক দিয়ে ফুসফুসে টেনে নিই তাজা মেঘ। মুহূর্তে মোলায়েম আবেশে শান্ত হয়ে যায় শরীর ও মন।

জোছনা রাতে মেঘের দেখা মিললে সাজেকের পাহাড় এক অন্য মায়ায় সাজে

নিচের পাহাড়, ঘরবাড়ি, পাহাড়ি বনাঞ্চল—সব ঢেকে দিয়ে বন্যার তোড়ের মতো সবকিছু গ্রাস করে নেয় মেঘ। চট করে এই মেঘ দেখলে নিটোল শান্ত সমুদ্র বলে ভ্রম হয় কখনো কখনো। এই মেঘের ওপর জালিকাটা রোদ ছুটিয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে দেখা দেয় সূর্য, বকের পালকের মতো ধবধবে সাদা মেঘকে নিমেষেই মাছরাঙার পেটের মতো স্বর্ণাভ বানিয়ে ফেলে। সাদা মেঘের ওপর তরল স্বর্ণ ঢেলে ঢেলে সূর্য যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে ধীরে ধীরে। অন্য কোনো দুনিয়ার একখণ্ড অংশ ভুলে সামনে ছিঁড়ে পড়েছে বলে মনে হয় তখন। সূর্যের তেজ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেন টিকতে না পেরে ফুড়ুত করে ব্যস্ত পায়ে ইতিউতি মিলিয়ে যায় মেঘের সমুদ্র। ঝলমলে হাসিতে ভোরকে স্বাগত জানায় মেঘচাপা থেকে সদ্য মাথাতোলা পাহাড়ের দল! ভাবটা এমন যে আরামের একটা ছান্দিক ঘুম শেষে মাত্রই ঘুম ভাঙল পাহাড়ের। সাজেকের ভোরের মেঘ মানেই অন্য দুনিয়া! ভোরের এই মেঘ সূর্যের রংখেলা দেখার লোভেই কত কত রাত আমি নির্ঘুম কাটিয়েছি এখানে, সেটার হিসাব নেই।

আরও পড়ুন

জোছনা রাতে মেঘের দেখা মিললে সাজেকের পাহাড় এক অন্য মায়ায় সাজে। মাথার ঠিক ওপরে চাঁদ, নিচে পালকের মতো ভেসে বেড়ায় মেঘ, কখনো ঢেকে দেয় সামনের পাহাড়ের চূড়া। জোছনায় ধবধব করে ওঠে পুরো প্রকৃতি। অদূরেই গাছের পাতায় বিলি কেটে সরসর তান তোলে শীতল বাতাস। তখন এই পাহাড়ি দুনিয়াটাকে আমার কেন যেন সমুদ্র সমুদ্র মনে হয়। মনে হয় গভীর সমুদ্রে কোনো পালতোলা জাহাজের মাস্তুলে বসে দুলছি আমি, সামনে সীমানাহীন মেঘের রাজ্য!

ভোর কিংবা জোছনার চেয়েও রুইলুই পাড়ায় আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর মেঘ হলো বিকেলের বৃষ্টি–পরবর্তী মেঘ! এর চেয়ে শান্ত, স্নিগ্ধ, সুন্দর পরিবেশ আমি আর কখনো কোথাও দেখিনি। বৃষ্টি–পরবর্তী এই মেঘ পাহাড়ের আকাশে কালেভদ্রে জমে, নিয়মিত এর দেখা পাওয়া যায় না। যেদিন এই মেঘের দেখা মেলে, সেদিন যেন পাহাড়ি প্রকৃতি অন্য আয়োজনে নিজেকে সাজিয়ে নেয়। অজগর যেভাবে তার বিরাট শরীরকে টেনে নিয়ে যায়, সেভাবেই বিকেলের এই মেঘ এক পাশ থেকে আরেক পাশে পাহাড়ময় আয়েশ করে নিজেকে ভাসিয়ে নিতে থাকে। সেই সঙ্গে ঝাঁক বেঁধে মেঘে গা ভাসিয়ে উড়ে যায় পাহাড়ি সবুজ টিয়ার দল। উড়তে উড়তে কখনো তারা মেঘের ভেতর ঢুকে পড়ে টুপ করে, আবার বেরিয়ে আসে পরক্ষণেই। ঠিক যেভাবে শান্ত পুকুরের টলটলে পানিতে পড়ে টুপ করে মিলিয়ে গিয়ে হঠাৎই আবার মাথা তোলে কাঁচা নিমফল, অনেকটা সে রকম লাগে দেখতে!

আরও পড়ুন

মেঘ–জোছনা–বৃষ্টির দেশে থাকার কালে কখনো কখনো পাহাড় বেয়ে ঝিরির খোঁজে নেমে পড়তাম। রুইলুই পাড়ার মূল রাস্তা থেকে খাদ বেয়ে মিনিটখানেক নিচের দিকে নামলেই মনে হয় অন্য জগতে চলে এসেছি। গাড়ির শব্দ, মানুষের হইচই, ছাগল-কুকুরের হাঁকডাক মিলিয়ে গিয়ে হুট করে মনে হয়, পোকার রাজ্যে এসে পড়েছি। এখানে পোকার ডাক যেন গিলে খায় পুরো দুনিয়ার শব্দ!

পাহাড়ের নানান পোকা তারস্বরে ডাকাডাকিতে নিমেষেই কান ঝালাপালা হয়ে যায়। তাদের ডাকের আওয়াজে এতই তীব্রতা যে মগজ পর্যন্ত নাড়িয়ে দেয়। নিচে নামতে নামতে এই পোকার ডাক ছাপিয়েই পাহাড়ি ঝিরির ঢল নামার আওয়াজ শোনা যায়। এই ঝিরির তোড়ই অনেক নিচে গিয়ে ঝরনা হয়ে পরিচয় বদলায়! এসব হাঁটু ডোবানি ঝিরির পানি ছুঁলেই মনে হয়, ডিপ ফ্রিজে হাত ঢুকে গেছে, এত ঠান্ডা! ঝিরিতে মাছ মেলে, কাঁকড়া মেলে, শামুক মেলে। ঝিরি থেকে এসব ধরে ধরে স্থানীয় পাহাড়িরা রান্না করে খায়। আমি কয়েকবার ঝিরির এই শামুক রান্না খেয়েছি, মুরগির মাংসের মতোই স্বাদ।

আশপাশে মেঘ–পাহাড় আর নিবিড় গাছপালা ছাড়া জুমঘরের কোনো সঙ্গী নেই

নামতে নামতে পাহাড়ের ঢালে জঙ্গলের ভেতর দেখা মেলে অতিকায় প্রাচীন কোনো বটগাছের। সেই গাছে আবার জড়িয়ে থাকে রাজ্যের লতা, পরগাছা। গাছভর্তি থাকে নানান পাখির বাসা, বিষধর সাপও হয়তো লুকিয়ে থাকে প্রাচীন গাছের খোঁড়লে। পাহাড়ে কোথাও কোথাও দেখা মেলে বাঁশ–কাঠের জুমঘরের। জুমচাষের জমির পাশে সঙ্গী হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে একটামাত্র জুমঘর। আশপাশে মেঘ–পাহাড় আর নিবিড় গাছপালা ছাড়া জুমঘরের কোনো সঙ্গী নেই। এই জুমঘর সকালে হয়তো মেঘের নিচে চাপা পড়ে, দুপুর হতেই ঝলমলিয়ে ওঠে আবার রোদের আমন্ত্রণে।

মাঝেমধ্যে সাধ জাগে এমন কোনো জুমঘরে পূর্ণ চাঁদের জোছনা রাত কিংবা শ্রাবণের ঘনঘোর এক বর্ষাদুপুরে এক বাটি চালতা মাখা নিয়ে বসতে। খুব ভোরে যখন মেঘ গিলে খায় আস্ত জুমঘর, শ্বাস টেনে ফুসফুস ভরিয়ে ফেলতে মন চায় তাজা মেঘে।

এমন কোনো জুমঘরে এভাবেই কাটানো একটা নির্ভার জীবন টিকে থাক ঘরের চালায় নরম পরশ বুলিয়ে দেওয়া মেঘের মতো সম্ভ্রম হয়ে, সমগ্র অস্তিত্বে!

ছবি: লেখক