আজকাল কোনো বাচ্চাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় তার প্রিয় প্রাণী কোনটি, তাহলে প্রবল সম্ভাবনা আছে উত্তর পাওয়ার—ড্রাগন! কারণ এখন যে গেম অব থ্রোনস-এর প্রিকুয়েল টিভি সিরিজ হাউস অব দ্য ড্রাগন-এর যুগ! জর্জ আর আর মার্টিনের কল্যাণে ড্রাগন ও ড্রাগনের মায়েদের জনপ্রিয়তার ঢেউ আছড়ে পড়েছে পদ্মাপারের এই বাংলাদেশেও!
তবে শুধু মার্টিন মশাইকে দোষ দিয়েই–বা লাভ কী! বর্তমান পপ কালচারে ড্রাগনের আরও ঢের দৃষ্টান্ত রয়েছে। জে আর আর টোলকিনের ‘হবিট’-এর সুবাদে স্মাওগ নামের ড্রাগনটি সাড়ে আট দশক ধরে বেশ জনপ্রিয়। জে কে রাওলিংয়ের সৃষ্টি করা হ্যারি পটার–এর জাদুর জগতেও দেখা মিলেছে হরেক রকম ড্রাগনের। হাঙ্গেরিয়ান হর্নটেইল, চায়নিজ ফায়ারবল, সুইডিশ শর্ট-স্নাউট কিংবা ওয়েলশ গ্রিনের মতো বাহারি নামও আছে তাদের। আছে হাউ টু ট্রেইন ইয়োর ড্রাগন নামের জনপ্রিয় অ্যানিমেশন। এদিকে ড্রাগন বল অথবা নেটফ্লিক্সের স্ট্রেঞ্জার থিংস সিরিজের সুবাদে ডানজনস অ্যান্ড ড্রাগনস নামের ফ্যান্টাসি টেবলটপ রোল-প্লেয়িং গেমের কথাও নিশ্চয়ই কারও অজানা নয়।
সুতরাং ছোটবেলা থেকে বারবার ড্রাগনের গল্প-কাহিনি শুনতে শুনতে কেউ যদি এটিকে নিজের সবচেয়ে প্রিয় প্রাণীর আসনে বসিয়ে দেয় এবং মা–বাবার কাছে জন্মদিনের উপহার হিসেবে একটি পোষা ড্রাগনের আবদার করে বসে, তাতে আর আশ্চর্যের কী আছে!
এটা বিস্ময়কর যে বাস্তবে ড্রাগন বলে কোনো প্রাণীর অস্তিত্ব নেই, কিন্তু তারপরও যুগের পর যুগ ধরে সর্পসম এই কিংবদন্তি জীবটিকে ঘিরে লোককথা-উপকথার কোনো অন্ত ছিল না। কোথাও এটিকে দেখানো হয়েছে ভীষণ ও ভয়ংকরদর্শন দানব হিসেবে, আবার কোথাও ড্রাগন এসেছে মানুষের পরম বন্ধু হয়ে। সবখানেই যে তারা মুখ থেকে অগ্নিশ্বাস ছাড়ে, তা-ও কিন্তু নয়। কোনো কোনো ড্রাগন বিড়ালছানার মতোই লোমশ তুলতুলে; বৃষ্টি ও সৌভাগ্যের বাহক।
স্বভাবতই তোমাদের মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক—বিশ্বের নানা প্রান্তের ড্রাগনদের মধ্যে মিল কোথায়, অমিলই-বা কোনগুলো? তাদের কি কোনো অভিন্ন পূর্বপুরুষ ছিল?
ড্রাগন কিংবদন্তির উৎপত্তি
অনেক পণ্ডিতই বিশ্বব্যাপী ড্রাগনীয় মিথের ভেতর কিছু সাধারণ সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন। একে তো তারা আকারে প্রকাণ্ড, সেই সঙ্গে আবার উড়ে বেড়াতে সক্ষম। পূর্ব এশিয়া থেকে শুরু করে অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ থেকে আমেরিকা—সবখানেই কমবেশি এমন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ড্রাগনের কথা এসেছে। বাস্তবে এমন কোনো প্রাণী না থাকা সত্ত্বেও কেন বারবার ঘুরেফিরে এদের কথা এসেছে? ড্রাগন মিথের সেই সুলুক সন্ধান করতে গিয়ে প্রধান দুটি তত্ত্ব উঠে এসেছে।
প্রথম এবং সম্ভবত সর্বজনস্বীকৃত তত্ত্বের মূলে রয়েছে ডাইনোসরের হাড়। এখন আমরা ডাইনোসরের কথা জানি, হামেশাই জুরাসিক পার্ক সিরিজের মুভি দেখি। কিন্তু আদিম পৃথিবীর মানুষের তো ডাইনোসর-জ্ঞান ছিল না। তারা জানত না সাড়ে ছয় কোটি বছর আগেকার সরীসৃপ প্রাণীটির কথা। তাই ডাইনোসরের সুবিশাল হাড় ও বুকে কাঁপন ধরানো কঙ্কালের দিকে তাকিয়ে তাদের কল্পনাপ্রবণ মন হয়তো ড্রাগনের ছবিই এঁকে নিয়েছে!
অন্য আরেকটি তত্ত্ব বলছে, ড্রাগনকেন্দ্রিক কিংবদন্তির আবির্ভাব ঘটেছে শ্বাপদসংকুল পৃথিবীতে মানবসভ্যতার সর্বজনীন, সামষ্টিক ভীতির ওপর ভিত্তি করে। ওই তাত্ত্বিকদের মতে, আদিম সমাজের মানুষ স্বভাবতই সাপ, চিতাবাঘ ও ইগলের মতো প্রাণীর ভয়ে কুঁকড়ে থাকত। তাই পৃথিবীর নানা অঞ্চলের মানুষই অবচেতন মনে ড্রাগনসদৃশ প্রাণীকে কল্পনা করে নিয়েছে। যার ভেতর সাপ, চিতাবাঘ ও ইগলজাতীয় সব প্রাণীর বৈশিষ্ট্যই কমবেশি বিদ্যমান। যেসব অঞ্চলে কুমির কিংবা বড় বড় সাপের আধিক্য ছিল, সেখানকার ড্রাগন চিত্রায়ণে ওই সব প্রাণীরও অবদান ছিল বলে ধরে নেওয়া যায়।
তবে এই দ্বিতীয় তত্ত্বের একটি দুর্বলতা হলো, যেসব কিংবদন্তিতে ড্রাগনকে সৌভাগ্যের প্রতীক কিংবা মানবজাতির রক্ষাকর্তার ভূমিকায় দেখানো হয়েছে, সেগুলোর পক্ষে কোনো যুক্তি এখানে মেলে না।
সে যা-ই হোক, এবার চলো চোখ বোলানো যাক পৌরাণিক সবচেয়ে বিখ্যাত কিছু ড্রাগনের ইতিবৃত্তে!
দ্য লং অব চায়না
চীনা ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে তাদের ড্রাগনগুলো। ইউরোপীয় ড্রাগনদের সঙ্গে যেখানে হিংসা-দ্বেষ, লোভ-লালসা কিংবা সর্ববিধ্বংসী আগুনের যোগসাজশ রয়েছে; সেখানে লং অব চায়নার সুনাম দয়াদাক্ষিণ্য ও মহানুভবতায়, প্রাণসঞ্চারী জলের প্রতীক হিসেবে। খরা কাটিয়ে বৃষ্টির সুখবারতা বয়ে আনে তারা, ফুলে-ফসলে ভরিয়ে দেয় বাগান-মাঠ, বাঁচিয়ে রাখে মানবকুলকে। শতসহস্র বছর ধরে তাই তো তারা চীনদেশে ক্ষমতা ও প্রাচুর্যের প্রতীক বলেও গণ্য হয়ে আসছে। চীনা জ্যোতির্বিজ্ঞানেও আছে ড্রাগনের বছর বলে একটি বিশেষ বছরের কথা, যে বছর জন্মগ্রহণ করা খুব মঙ্গলজনক।
চীনা ড্রাগনকে প্রধানত বর্ণিত করা হয়েছে এভাবে, তাদের রয়েছে উটের মতো মাথা, হরিণের মতো শিং, ষাঁড়ের মতো কান, সাপের মতো শরীর, মাছের মতো আঁশ, ইগলের মতো পা এবং বাঘের মতো থাবা। অন্য অনেক বর্ণনায় ভিন্ন ভিন্ন প্রাণীর তালিকাও এসেছে বটে, তবে সব মিলিয়ে চীনা শিল্পের ইতিহাসে ড্রাগনের উপস্থাপনে বেশ একটা ধারাবাহিকতার আভাস পাওয়া যায়।
পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য ড্রাগন
জাপান, কোরিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভুটান, ফিলিপাইনের মতো দেশগুলোর কিংবদন্তিতেও একই ধরনের ড্রাগনের উল্লেখ পাওয়া যায়। চীনের ড্রাগনের মতো এসব দেশের ড্রাগনও সাধারণত জল ও জীবনেরই বার্তাবাহক।
প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার ড্রাগন
মেসোপটেমিয়ার প্রাচীন সভ্যতাও ড্রাগন কিংবদন্তির আরেক উল্লেখযোগ্য উৎস। মেসোপটেমীয় পূজা-পার্বণ ও পুরাণে বেশ কিছু সরীসৃপ ও সিংহজাতীয় ড্রাগনের দেখা মিলেছে।
যেমন তিয়ামাত হলো একজন দেবী, যে প্রতিনিধিত্ব করছে সাগরে সংঘাত ও সৃষ্টিশীলতার। অনেক সময় তাকে দেখানো হয়েছে সমুদ্র-সরীসৃপ হিসেবে। এদিকে তার স্বামী, আবজু ছিল বিশুদ্ধ পানির প্রতীক এক পরম উপকারী সরীসৃপ। দুজন মিলে তারা জন্ম দিয়েছে দেব-দেবীদের একটি নতুন প্রজন্মের।
মুশুশু বলে আরেকটি ড্রাগনের কথা জানা যায়, যে ছিল ‘সূর্যের শাবক’ দেবতা মারদুকের দাস। সাপ, সিংহ, ইগল ও কাঁকড়াবিছার মিশেলে স্বভাব ছিল তার। বিখ্যাত ইশতার গেটে দেখা মেলে মুশুশুর একটি দৃষ্টান্তের।
প্রাচীন মিসরীয় ড্রাগন
প্রাচীন মিসরের পুরাণেও একটি বড় জায়গা দখল করে আছে সরীসৃপজাতীয় দানব ও দেবতারা। তাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো আপেপ, যার নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অন্ধকার ও পানি। সূর্য দেবতা রা-র পরম শত্রু ছিল আপেপ। বলা হয়ে থাকে, তার জন্ম নাকি হয়েছিল রা-র নাভিরজ্জু থেকে। পাতাল পৃথিবীর গভীর জলে বিচরণ করত আপেপ। আর সেই জল ডিঙিয়ে রোজ সূর্য উদয়ের ব্যবস্থা করত রা। প্রাচীন মিসরীয় পুরোহিতদের একটি প্রধান দায়িত্ব ছিল রাতভর উপাসনা করা যেন পরদিন আপেপকে পরাহত করে রা নতুন দিনের সূর্য নিয়ে আসতে পারে।
অস্ট্রেলীয় রংধনু সাপ
রংধনু সাপ রয়েছে আদিবাসী অস্ট্রেলীয় সংস্কৃতির ধর্মীয় আচার ও কিংবদন্তিতে। এই রংধনু সাপ নিয়ে অনেক গল্প-কাহিনিই প্রচলিত আছে, যদিও একেক জায়গায় তাদের বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতি দেখানো হয়েছে একেক রকম। তবে সাধারণভাবে ধরে নেওয়া যায়, এই রংধনু সাপেরা হলো স্রষ্টা দেবতা, যাদের সংশ্লিষ্টতা পানি ও বায়ুর সঙ্গে। রংধনু রেখার মধ্যখানের পথ দিয়ে বিচরণ বলে তাদের এমন নামকরণ।
প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী রংধনু সাপ একটিও হতে পারে, আবার অনেকগুলোও হতে পারে। তাদের আনাগোনা কোনো নির্দিষ্ট সময়কে আবর্তন করে নয়। একাধারে তারা অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবখানেই থাকতে পারে। এভাবে আদিবাসী অস্ট্রেলীয়দের কাছে তাদের অস্তিত্ব ও উপস্থিতি চিরন্তন। তারা জল ও জীবনের প্রতিনিধিত্ব যেমন করে, তেমনই নিজেদের চলাচলের মাধ্যমে নির্ধারণ করে দেয় পৃথিবীর আকৃতি।
গ্রেকো-রোমান ড্রাগন
আধুনিক ইংরেজিতে ‘dragon’ শব্দটি এসেছে লাতিন ‘draco’ এবং প্রাচীন গ্রিক ‘drakon’ থেকে। ‘draco’ অর্থ সরীসৃপ বা ড্রাগন দুই-ই হতে পারে। গ্রেকো-রোমান জগতের ড্রাগনগুলো ছিল মূলত সমুদ্র-সরীসৃপ কিংবা প্রকাণ্ড সাপ, যাদের নিশ্বাস ছিল বিষাক্ত।
উদাহরণস্বরূপ, কোলচিয়ান ড্রাগন জেসন ও তার আর্গোনটদের কাছ থেকে সুরক্ষিত রাখত গোল্ডেন ফ্লিস। কোলচিয়ান ড্রাগনকে ছলে-বলে-কৌশলে ঘুম পাড়িয়েই কেবল হারানো সম্ভব ছিল। এদিকে আরেক দৈত্যাকার সাপ, পাইথন, তার কুণ্ডলী দিয়ে ঘিরে রেখেছিল ডেলফি নামক পবিত্র স্থান। শেষ পর্যন্ত অ্যাপোলোর হাতে নিহত হয় সে। বহুমস্তক হাইড্রা আরেক গ্রিক ড্রাগনের উদাহরণ। তার মৃত্যু হয় হেরাকলসের হাতে।
আমেরিকার ড্রাগন
উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার হাজারো সংস্কৃতিতেও পাওয়া যায় সরীসৃপ ড্রাগনের উল্লেখ। যেমন আজ যেটি যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চল, সেখানে একসময় প্রচলিত ছিল শিংওয়ালা সাপের কাহিনি। অঞ্চলভেদে শিংওয়ালা সাপের বিবরণে ভিন্নতা থাকলেও প্রধানত এটি ছিল একটি প্রকাণ্ড সমুদ্র-সরীসৃপ, যার ছিল হরিণের মতো শিং, বড় বড় পাল্লা এবং কপালে খোদাই করা বৃহদাকার একটি রত্ন বা স্ফটিক। শিংওয়ালা সাপ সরাসরি মানুষের জন্য ক্ষতিকর ছিল না বটে, তবে কেউ একে দেখলে হয় পাগল হয়ে যেত, নয়তো শনির দশা নেমে আসত তার কপালে।
এদিকে প্রথাগতভাবে ড্রাগন বলা না গেলেও মেসো আমেরিকার পালকযুক্ত সরীসৃপ সঙ্গেও কিংবদন্তির প্রাণীটির বেশ ভালো রকম সাদৃশ্য বিদ্যমান। কেটজাকোয়াটল ও কুকুলকান এমন দুই পালকযুক্ত সরীসৃপ, যারা বায়ু ও বৃষ্টির দেবতা।
মধ্যযুগের ইউরোপীয় ড্রাগন
আজকের দিনে পশ্চিমা বিশ্বে ড্রাগনের সবচেয়ে পরিচিত প্রতিকৃতি হলো সারা গায়ে আঁশ বা কাঁটাযুক্ত, মুখ দিয়ে আগুনে নিশ্বাস ফেলা একধরনের ড্রাগনের, যাদের উৎস নিহিত আছে মধ্যযুগের ইউরোপীয় কিংবদন্তিতে। এই বিশাল সরীসৃপেরা চার-পাবিশিষ্ট, এদের ডানা বাদুড়ের মতো এবং এদের রয়েছে লম্বা ঘাড় ও লেজ। ধারণা করা হয়, এরা মেসোপটেমীয়, গ্রেকো-রোমান ড্রাগন এবং বাইবেলের বেহেমথসদৃশ দৈত্যের বংশধর।
খ্রিষ্টসমাজে ইউরোপীয় ড্রাগনদের বড্ড দুর্নাম। শয়তান প্রতিপন্ন হয় তারা। একসময় বলা হতো, স্বর্ণভান্ডারের ওপর জেঁকে বসে থাকে এই ড্রাগনরা এবং কায়েম করে ত্রাসের রাজত্ব। কেবল গুণবান ও পরম সাহসী যোদ্ধারাই পারত এই ড্রাগনদের পরাস্ত করে মূল্যবান ধনসম্পদ জয় করতে।
বিখ্যাত ইউরোপীয় ড্রাগনদের তালিকায় রয়েছে বেউলফের ড্রাগন এবং নর্স কিংবদন্তির ফাফনির। কিং আর্থার ও তার পরামর্শদাতা মারলিনের নিয়মিত কাজকারবার ছিল ড্রাগন নিয়ে, যা পরে ইউরোপজুড়েই জনপ্রিয় আভিজাত্যের প্রতীকে পরিণত হয়। বিশেষত কিংডম অব ওয়েলসে ব্যাপারটি বেশি দেখা যায়। সম্ভবত সবচেয়ে আইকনিক ইউরোপীয় ড্রাগন হলো সেন্ট জর্জের হাতে খুন হওয়া ড্রাগনটি, যেটি নিয়ে মধ্যযুগ ও রেনেসাঁযুগে বহু চিত্রকর্ম অঙ্কিত হয়েছে।