আলবার্ট আইনস্টাইন ভর্তি হলেন পলিটেকনিকে। শুরুতেই গণিতের অনেকগুলো বিষয় নিয়ে পড়া শুরু করলেন। কিন্তু যা ভেবে গণিত পড়তে শুরু করেছেন, তেমনটা হলো না। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখার ব্যাপারে হয়তো তোমরা অনেকেই জানো। তারপরও একটু সংক্ষেপে বলি। নির্দিষ্ট যেকোনো একটা বিষয় যেমন গণিত, বাংলা বা ইংরেজির মতো একটা বিষয় নির্দিষ্ট করে শুধু ওই বিষয় নিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে গণিত পড়তে চাইলে, বেশির ভাগ পড়াশোনাই থাকবে গণিত বিষয়ে। অবশ্য গণিতের বাইরেও কিছু বিষয় পড়তে হয়। চাইলে গণিতে পড়ার সময় বাছাই করে অন্য কোর্সও নেওয়া যায়।
যা-ই হোক, আইনস্টাইন বেছে নিলেন গণিত। কিন্তু গণিতের শিক্ষকদের পড়ানো তাঁর ভালো লাগছে না। ভাবলেন, বিষয় বদল করলে অন্য বিষয়ের শিক্ষকদের পড়ানো ভালো লাগবে। তাই গণিত পরিবর্তন করলেন। শুরু করলেন পদার্থবিজ্ঞান। কিন্তু বিষয় পরিবর্তন করেও কোনো লাভ হলো না। কোনো শিক্ষকের পড়ানোই ভালো লাগছে না। আইনস্টাইন হতাশ হয়ে পড়লেন। তবে আশা ছাড়লেন না। নিজেই পড়তে শুরু করলেন। যেসব শিক্ষকের পড়ানো ভালো লাগে না, তাঁদের ক্লাসে যান না। এভাবে কেটে গেল একটা বছর। পরের বছর নতুন শিক্ষকের ক্লাস। শিক্ষক হিসেবে পেলেন হেনরিখ ওয়েবারকে। তাঁর পড়ানোর ধরন আইনস্টাইনের ভালো লাগল। দারুণ পড়ান। গবেষণাও করেন। আইনস্টাইন ভাবলেন, ওয়েবারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে থাকলে ভবিষ্যতে ওয়েবারের সহকারী হতে পারবেন। এ স্বপ্নের পাশাপাশি আইনস্টাইনের মনে আরও একটা স্বপ্ন উঁকি দিল। দ্বিতীয় স্বপ্নটাই তাঁর পড়ালেখার কিছুটা ক্ষতি করল।
আইনস্টাইনের সঙ্গে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়েন আরও চারজন। তাঁদের মধ্যে মাত্র একজন মেয়ে। নাম মিলেইভা। আইনস্টাইনের সঙ্গে তাঁর গভীর বন্ধুত্ব। কিন্তু পলিটেকনিকে ভর্তির কিছুদিন পর মিলেইভা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান। তখন তাঁরা চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ করতেন। মিলেইভা চলে যাওয়ার কিছুদিন পর আবার ফিরেও আসেন। এত দিনের চিঠি চালাচালিতে তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্বটা আরও বেড়েছে। আইনস্টাইন মিলেইভাবে পড়াশোনার ব্যাপারে সাহায্য করার জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। মিলেইভাকে সব শিখতে সাহায্য করতে করতে ভুলে গেলেন নিজের পড়ার কথা। হঠাৎ পরীক্ষার তারিখ পড়ায় আইনস্টাইন যেন আকাশ থেকে পড়লেন। বান্ধবীকে নিজের মতো কিছুদিন পড়া চালিয়ে যেতে বলে নিজের পড়ায় মন দিলেন।
কিন্তু পড়বেন কী? ক্লাসে তো বেশি যাননি। কোনো নোটও নেই আইনস্টাইনের কাছে। গ্রোসম্যান নামে তাঁর এক বন্ধু ছিলেন। আইনস্টাইন বন্ধুর কাছ থেকে নোট নিলেন। পরীক্ষা দিলেন। এখানে একটা মজার ঘটনা ঘটে। পরীক্ষায় আইনস্টাইন প্রথম হন। আর যাঁর থেকে নোট নিয়েছেন, সেই গ্রোসম্যান হন দ্বিতীয়। এতে অবশ্য আইনস্টাইন নিজেই কষ্ট পেয়েছিলেন। তাই এবার নিজের পড়াশোনা শুরু করলেন। নিয়মিত ওয়েবারের ক্লাসে যাচ্ছেন। আশায় আছেন, কবে ওই শিক্ষকের সুন্দর ল্যাবে তিনি গবেষণা করতে পারবেন।
তৃতীয় বর্ষে আইনস্টাইন সেই সুযোগও পেয়ে গেলেন। ক্লাস বাদ দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটান ওয়েবারের ল্যাবে। একদিন ওয়েবারের সঙ্গেও তাঁর বিরোধ দেখা গেল। আসলে ওয়েবার কিছুটা পুরোনো বিষয় নিয়ে গবেষণা করতেন। তা ছাড়া নতুন আবিষ্কৃত বিষয় সম্পর্কে তিনি খোঁজও রাখতেন না। আইনস্টাইন চাইতেন সাম্প্রতিক বিষয়গুলো নিয়েও গবেষণা করতে। এতে ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। ওয়েবার মনে করছেন, আইনস্টাইন তাঁর কথা শুনছেন না। তাই ধীরে ধীরে আইনস্টাইন হয়ে উঠছেন ওয়েবারের অপ্রিয় ছাত্র। অন্য শিক্ষকদের সঙ্গে আগে থেকেই বনিবনা হচ্ছিল না আইনস্টাইনের। বাকি ছিলেন এই শিক্ষক। তিনিও এখন অপছন্দ করতে শুরু করেছেন। ফলে আইনস্টাইনের আর তেমন কোনো প্রিয় শিক্ষক রইল না। তিনি একা একা আগের মতো পড়তে শুরু করলেন। বইয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন বিজ্ঞানীর লেখা গবেষণাপত্র পড়েন। নতুন নতুন বিষয় সম্পর্কে জানেন।
এদিকে মিলেইভার সঙ্গে সম্পর্ক ভালোই এগিয়েছে। তাঁকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আইনস্টাইন। মিলেইভারও কোনো আপত্তি নেই। আপত্তি শুধু আইনস্টাইনের মা পলিনের। একে তো আইনস্টাইনের খারাপ সময় যাচ্ছিল, তার ওপর তাঁর মায়ের রাজি না হওয়া আইনস্টাইনকে চিন্তায় ফেলে দিল। পরীক্ষা হলো খারাপ। পাঁচজনের মধ্যে আইনস্টাইন হলেন চতুর্থ। তাঁর চেয়ে খারাপ করেছেন শুধু মিলেইভা। আইনস্টাইন কোনোভাবে পাস করতে পারলেও মিলেইভা পারলেন না। তাঁকে আরও এক বছর পলিটেকনিকে পড়তে হবে।
পাস করে আইনস্টাইন মিলেইভাকে বিয়ে করতে চাইলেন। কিন্তু মা–বাবা কেউ রাজি হলেন না। ফলে আইনস্টাইন একটা চাকরি খোঁজা শুরু করলেন। কিন্তু চাকরি কোথায় পাবেন? প্রথমে ভেবেছিলেন, পলিটেকনিকে কোনো অধ্যাপদের সহকারী হবেন। কিন্তু খুঁজে দেখলেন এমন মানুষ একজনই আছেন। তিনি হলেন হেনরিখ ওয়েবার। চাকরি চেয়ে চিঠি লিখলেন তাঁকে। আইনস্টাইন ভেবেছিলেন, ওয়েবারের সঙ্গে যে সামান্য মনোমালিন্য হয়েছে, তাতে তিনি কিছু মনে করবেন না। শেষ পর্যন্ত চাকরিটা তাঁর হয়ে যাবে।
কিন্তু কথায় আছে, মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। ওয়েবার আইনস্টাইনকে চাকরিটা দিলেন না। এখন আইনস্টাইন কী করবেন? বাধ্য হয়ে পিএইচডি করার সিদ্ধান্ত নিলেন। জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক তাঁকে ছাত্র হিসেবে গ্রহণ করলেন। তিনি নিশ্চয়ই জানতেন না, আইনস্টাইন ছাত্র হিসেবে কতটা বেপরোয়া। পলিটেকনিকে তাঁকে পছন্দ করেন এমন কোনো শিক্ষক ছিলেন না। কারণ, আইনস্টাইন নিজের মতো করে পড়তেন। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকদের চেয়ে বেশি জানাটাও তাঁর জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
যা-ই হোক, আইনস্টাইন নতুন উদ্যমে আবার পড়াশোনা শুরু করলেন। অল্প দিনের মধ্যেই একটা গবেষণাপত্র লিখলেন। সেটা প্রকাশিত হলো একটা নামকরা জার্নালে। আইনস্টাইন ভাবলেন, এবার আর চাকরি পেতে নিশ্চয়ই সমস্যা হবে না। যখন তিনি নতুন চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছেন, তখন সামনে এল এক নতুন বিপদ। মাত্র কিছুদিন আগেই সুইজারল্যান্ডের নাগরিকত্ব পেয়েছেন আইনস্টাইন। এখন সুইজারল্যান্ড সরকার তাঁকে মিলিটারি সার্ভিসের জন্য বাধ্য করছে। কিন্তু এই সার্ভিস যাতে দেওয়া না লাগে, তাই জার্মানি ছেড়ে এসেছিলেন তিনি। এখন পড়লেন আরেক বিপদে। বাধ্য হয়ে সার্ভিস দিতে রাজি হলেন। আসলে রাজি না হয়ে কোনো উপায় ছিল না। তা ছাড়া কাজও তেমন ছিল না তাঁর। ভাবলেন, কাজ যেহেতু নেই, দেশকে সার্ভিস দিই।
কিন্তু এবার তাঁর ভাগ্য খুলে গেল। মেডিকেল টেস্টে আইনস্টাইন ‘আনফিট’ হলেন। কারণ, তাঁর পায়ে একটা সমস্যা হচ্ছিল। মূলত অতিরিক্ত পা ঘামানোর কারণেই এই সমস্যা। আর এই সমস্যাই তাঁকে বাঁচিয়ে দিল। এখানে বলি রাখি, আইনস্টাইন কখনো পায়ে মোজা পরতেন না। মোজা ছাড়া শুধু জুতা পরতেন।
আইনস্টাইন আবার হতাশায় পড়লেন। চাকরি না পাওয়ার হতাশা। প্রকাশিত প্রবন্ধসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির জন্য আবেদন করছেন। কিন্তু কেউ তাঁকে সুযোগ দিচ্ছেন না। বসে বসে শুধু নতুন গবেষণাপত্র পড়েন। মাঝেমধ্যে নিজের গবেষণাপত্র লিখেও প্রকাশ করেন। যত বেশি নিজের গবেষণাপত্র হবে, চাকরি পাওয়া তত সহজ হবে। কিন্তু কিছুতেই কোনো লাভ হচ্ছিল না। এ সময় আলো হয়ে এলেন গ্রোসম্যান। আগেও একবার আইনস্টাইনকে তিনি বিপদের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন। নিজের নোট পড়তে দিয়েছিলেন আইনস্টাইনকে। আর সেই নোট পেয়ে আইনস্টাইন পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন। গ্রোসম্যান হয়েছিলেন দ্বিতীয়। সেই গ্রোসম্যান বন্ধুর বিপদের সময় তাঁর বাবার পেটেন্ট অফিসে আইনস্টাইনের জন্য সুপারিশ করলেন। সম্ভবত চাকরিটা আইনস্টাইনের হয়ে যাবে। অবসান ঘটবে বেকার জীবনের।
সেই পেটেন্ট অফিসে চাকরির গল্প বলব অরেক দিন। হয়তো আইনস্টাইনের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলো কেটেছে সেখানে। ওই অফিসে বসেই তিনি বদলে দেবেন পদার্থবিজ্ঞানের অনেক কিছু। মানুষ নতুন করে ভাবতে শুরু করবে বিজ্ঞান নিয়ে। পরের পর্বে বলব সেই গল্প।
সূত্র: ডি কে প্রকাশনীর লাইফ স্টোরিস সিরিজের ‘আলবার্ট আইনস্টাইন’ বই ও প্রদীপ দেবের ‘আইনস্টাইনের কাল’ বই অবলম্বনে।