জানালার পাশে এক ছোট্ট মেয়ের গল্প

একনজরে

জানালা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট মেয়েটি তোত্তো-চান | লেখক: তেৎসুকো কুরোয়ানগি | অনুবাদ: প্রত্যাশা ইসলাম | প্রকাশক: সাহিত্য কুটির

বড় হয়ে কী হতে চাও—ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, খেলোয়াড় না বিজ্ঞানী? হয়তো এমন কিছু হওয়ার ইচ্ছাই তোমার হবে। কিন্তু  তোমার কি কখনো চানাচুর বিক্রেতা হতে ইচ্ছে করেছে? ইচ্ছে করেছে রেলের টিকেট কাটতে বা রোদের মধ্যে ঘুরে ঘুরে আইসক্রিম বিক্রি করতে? ভাবতে পারো, এমন ইচ্ছা আবার কারো হয় নাকি? আসলে হয়। তোত্তোচানের এমনই ইচ্ছা ছিল। একটা বইয়ের গল্প ভেবে ভুল করে বসো না কিন্তু। এই বইয়ের গল্প সত্য ঘটনা নিয়েই। তোত্তোচান নিজেই বইয়ের লেখক। বড় হয়ে সে তাঁর স্মৃতি থেকে এই বই লিখেছে। চলো, তোত্তোচানের সঙ্গে আরেকটু ভালোভাবে পরিচিত হয়ে নিই। 

তোত্তোচান এক চঞ্চল, কৌতূহলী আর প্রাণবন্ত মেয়ে। সে সবসময় নতুন নতুন জিনিস জানার চেষ্টা করে। অনেক কৌতূহল তার। কিন্তু স্কুলের নিয়মকানুনের সঙ্গে তার স্বভাব একেবারেই মিলছিল না। তাই তাকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়। তারপর তার মা তাকে ভর্তি করিয়ে দেন ‘তোমোই’ নামে এক অদ্ভুত সুন্দর স্কুলে। এই স্কুল আর পাঁচটা সাধারণ স্কুলের মতো নয়—এখানে ক্লাস হয় পুরনো ট্রেনের কামরার ভেতরে, বাচ্চারা ইচ্ছেমতো যে কোনো বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করতে পারে, একই ক্লাসে বসে কেউ গান গাইতে পারে, কেউ পারে ছবি আঁকতে। শিক্ষকেরা শুধু দেখেন, শিশুরা যা করছে তা ঠিক হচ্ছে কি না। 

আরও পড়ুন

তোমোই স্কুলের প্রধান শিক্ষক সোসাকু কোবায়াশি ছিলেন এক অসাধারণ মানুষ। তিনি বিশ্বাস করতেন প্রতিটি শিশুর মাঝে বিশেষ এক শক্তি আছে। সেই শক্তি বের করার চেষ্টা করতেন তিনি। তিনি শিক্ষার্থীদের স্বাধীনভাবে ভাবতে শেখাতেন, তাদের স্বপ্ন দেখতে বলতেন। তার দৃষ্টিভঙ্গি শুধু শিক্ষাব্যবস্থাকে নতুন রূপ দেয়নি, বরং শিশুদের জীবনকেও আনন্দময় করে তুলেছিল।

তোত্তোচান এই স্কুলে এসে এক নতুন পৃথিবী আবিষ্কার করে। এখানে সে যেমন স্বাধীনভাবে শিখতে পারে, তেমনি প্রকৃতির সঙ্গে মিশতে পারে, আনন্দ করতে পারে বন্ধুদের সঙ্গে। এই স্কুলে কোনো শিশুকে খারাপ বলা হয় না, কেউ দুষ্টুমি করলেও তাকে বোঝানো হয় ভালোভাবে। শিক্ষার আনন্দটা এখানেই যা তার আগের স্কুলে ছিল না!

বইটির সবচেয়ে সুন্দর দিক হলো, এটি আমাদের শেখায়। প্রকৃত শিক্ষা মানে শুধু বই পড়া নয়, বরং চারপাশের জীবন থেকে শেখাও গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, তোত্তোচানকে আগের স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল কারণ সে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকত। বাইরের মানুষদের দেখত। কিন্তু তার মা তাকে এ কথা জানাননি। তোত্তোচানকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে শুনলে এটা তার শিশু মনে প্রভাব ফেলত। তোত্তোচান যখন যা দেখত, তাই হতে চাইত। কখনো টিকিট চেকার, কখনো স্পাই আবার কখনো বাদ্যকার। তার মা এই সবই মেনে নিতেন। আসলে বড় হয়ে সে কি হবে, তা বড় হলেই বুঝবে। এখনই তাকে হতাশ করার কিছু নেই। তোত্তোচানের স্কুলে প্রতিদিন শিক্ষার্থীরা নিজেরাই খাবার আনত। এতে নিজেরা খাবার বানাতে শিখত। যে যা পড়তে চাইত তাকে তাই পড়তে দেওয়া হতো। কখনো কোনো শিশুর স্বপ্নকে ছোট করে দেখতেন না ওই স্কুলের শিক্ষকেরা। 

আরও পড়ুন

এই বইয়ের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি, প্রতিটি শিশুই আলাদা, তাদের চিন্তাভাবনাও আলাদা। সবার জন্য এক নিয়মের শিক্ষা উপযোগী নয়। আমাদের এমন শিক্ষাব্যবস্থা দরকার, যেখানে শিশুরা আনন্দের সঙ্গে শিখতে পারবে, কল্পনাকে উড়তে দিতে পারবে, আর নিজেদের মতো করে বড় হতে পারবে।

তবে বইটি আসলে শিশুদের চেয়ে শিক্ষক ও অভিভাবকদের জন্যও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অভিভাবকদের জানা দরকার কীভাবে শিশুদের চিন্তার স্বাধীনতা দিতে হয়। কীভাবে তাদের কৌতূহলকে প্রশ্রয় দিয়ে শেখাতে হয়। তোত্তোচানের গল্প আমাদের সেই শিক্ষাই দেয়। এই বই তোমাকে হাসাবে, ভাবাবে, এমনকি মাঝেমধ্যে আবেগে ছুঁয়ে যাবে। আর সবশেষে তুমি বুঝতে পারবে, সত্যিকারের শিক্ষা মানে কেবল পরীক্ষার ভালো ফল নয়, বরং জীবনকে ভালোভাবে জানা, অনুভব করা।

দারুণ এই বইটি লিখেছেন জাপানি লেখিকা তেৎসুকো কুরোইয়ানাগি। বইটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন প্রত্যাশা ইসলাম। তাঁর অনুবাদ ঝরঝরে, ভাষা প্রাঞ্জল। তাই বইটি পড়ে আরও বেশি আনন্দ পাওয়া যায়। সুন্দর এই বইটি প্রকাশ করেছে সাহিত্য কুটির। অফলাইন ও অনলাইনে বইটি কেনা যাবে। 

আরও পড়ুন