ধরো, তুমি সমুদ্রে ডুব দিতে চাও। কক্সবাজার গিয়ে সৈকতে নামলে। একটু ভিজেটিজে ডুব দিয়ে এলে। এটুকু করলে তোমার ভালো লাগবে। তবে তুমি চাও, সমুদ্রের একটু বেশি গভীরে ডুব দিতে। এই ধরো, দশ হাত পানির নিচে ডুব দিতে চাও। শুধু ডুব দিয়ে উঠে এলে তোমার মন ভরবে না, তুমি জানো। দশ মিনিট ধরে ডুবে থাকতে চাও তুমি। কিন্তু পানির নিচে দশ মিনিট অক্সিজেন ছাড়া শ্বাস ধরে রাখতে পারে না মানুষ। তুমি চাও অক্সিজেন নিয়ে পানির নিচে যাবে। ঘুরে ঘুরে রঙিন কোরাল ও মাছ দেখবে। ছবি তুলবে। তারপর উঠে আসবে। এ রকম পরিকল্পনা করার সময় হয়তো তোমার মাথায় প্রশ্ন আসবে, কতটা গভীরে ডুব দিতে পারে মানুষ?
ওপর থেকে দেখলে সমুদ্রের গভীরতা টের পাওয়া যায় না। কক্সবাজার সৈকতে গিয়ে চট করে গভীরতা আন্দাজ করতে পারবে না তুমি। গভীরতা নিয়ে প্রশ্ন অনেক দিনের। একজন মানুষ কতটা গভীরে ডুব দিতে পারে, এই প্রশ্ন দীর্ঘ সময় ধরে বিজ্ঞানী এবং অনুসন্ধানকারীদের কৌতূহলী করে রেখেছে। এই প্রশ্নের উত্তর তেমন একটা সহজ নয়। কত গভীরে ডুব দেওয়া যাবে, এটি নির্ভর করে ডুবুরির শারীরিক অবস্থা, ব্যবহৃত সরঞ্জাম, ডাইভের উদ্দেশ্যসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর।
অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদের কাছে সমুদ্রে ডুব দেওয়া খুবই জনপ্রিয়। পানির নিচে অনুসন্ধান করতেও সমুদ্রে ডুব দেন অনেকে। কেউ শখ করে, কেউ পেশার কারণে। ব্যাপারটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণও বটে। ভুল করার সুযোগ নেই। সঠিকভাবে উপকরণ ব্যবহার না করলে সমুদ্রের গভীরে ডুব দেওয়া খুব বিপজ্জনক হতে পারে। পানির গভীরতার সঙ্গে চাপ বাড়তে থাকে। ভুল করলে চাপজনিত অসুস্থতায় ভুগতে হতে পারে। এমনকি বিষয়টি জীবনের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ।
কক্সবাজারের মতো জায়গায় শখের বসে যাঁরা স্কুবা ডাইভিং করেন, তাঁদের পক্ষে বিশেষ সরঞ্জাম বা প্রশিক্ষণ ছাড়াই নিরাপদে ৪০ মিটার পর্যন্ত ডুব দেওয়া সম্ভব। পেশাদার ডুবুরিরা বিশেষ সরঞ্জাম এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এর চেয়ে বেশি গভীরেও ডুব দিতে পারেন।
ভূপৃষ্ঠে বায়ুর চাপ এক অ্যাটমস্ফিয়ার। পানির নিচে এই চাপ গভীরতার সঙ্গে বাড়ে। যেমন ১০ মিটার গভীরতায় চাপ ভূপৃষ্ঠের দ্বিগুণ। ২০ মিটার গভীরতায় চাপ ভূপৃষ্ঠের তিন গুণ। ৩০ মিটারে চার গুণ। এভাবে বাড়তে থাকে। প্রযুক্তি ও আধুনিক উপকরণের সাহায্য নিয়ে ডুবুরিরা নিরাপদে ১০০ মিটার বা তার বেশি গভীরতায় ডুব দিতে পারেন। এর জন্য অবশ্য ব্যাপক প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা প্রয়োজন।
ডুব দিতে হলে ডাইভিং গভীরতা সম্পর্কে জানতে হবে। ভূপৃষ্ঠ থেকে সমুদ্রের তল পর্যন্ত দূরত্ব হলো ডাইভিং গভীরতা। এই গভীরতা সমুদ্রের একেক জায়গায় একেক রকম। সমুদ্রের কিছু এলাকায় ১০ হাজার মিটারের বেশি গভীরতা পাওয়া যায়।
ডুব দিলে পানির চাপ বৃদ্ধি পায়। ফুসফুস সংকুচিত হয়। শ্বাস নিতে অসুবিধা হতে পারে। চাপ হঠাৎ বেড়ে গেলে বা কমে গেলে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারো। এ কারণে ডুবুরিরা দ্রুত ভূপৃষ্ঠে ফিরে আসেন না। যাকে আমরা ভুস করে ভেসে ওঠা বলি। তাঁরা ধীরে ধীরে ওপরে ওঠেন। যেন ধীরে চাপের পরিবর্তন ঘটে। ডুব দেওয়ার আরেকটি প্রভাব হাইপোথার্মিয়া। বিশেষ করে ঠান্ডা পানিতে। কারণ, মানুষের শরীর বাতাসের চেয়ে পানিতে দ্রুত তাপ হারায়।
পানির নিচে শ্বাসপ্রশ্বাসের যন্ত্রপাতির সবচেয়ে সাধারণ রূপ হলো স্কুবা ডাইভিং গিয়ার। বাতাস সংকুচিত করে ট্যাংকে ভরে ডুবুরিরা একটি নিয়ন্ত্রকের মাধ্যমে শ্বাস নেন। বাতাস ছাড়া শ্বাসপ্রশ্বাসের গ্যাসের মিশ্রণও ডাইভিংয়ের জন্য ব্যবহার করা হয়। যেমন নাইট্রোক্স বা ট্রিমিক্স। এই মিশ্রণগুলোয় অক্সিজেন, নাইট্রোজেন এবং অন্যান্য গ্যাসের বিভিন্ন অনুপাত রয়েছে। এটি ডুব দেওয়ার সময় বাড়ায়। বেশি গভীরতায় অক্সিজেনের বিষাক্ততার ঝুঁকি কমায়।
এতগুলো নিরাপত্তাজনিত কথা জেনে এবার তুমি ভাবতে পারো, সাগরের নিচে আমি সরাসরি ডুব দিতে চাই না। একটি ডুবোযানে চেপে আমি সমুদ্রের গভীরে যেতে চাই। এ রকম চাইলে তোমার কাছেই জানতে চাইব, তুমি কতটা গভীরে যেতে চাও? তোমার সম্ভাব্য উত্তর অনুমান করতে পারি। তুমি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সমুদ্রতল পর্যন্ত কোনো এক গভীরতায় যেতে চাও।
তুমি যেতে পারবে। উচ্চতাভেদে তিন রকম ডুবোযান তোমার প্রয়োজন হবে। ১ মিটার থেকে ৩০০ মিটার পর্যন্ত ডুব দিয়ে চলার জন্য দরকার হবে একটি সাবমেরিন। একটি নিউক্লিয়ার পাওয়ার চালিত বড় আকারের সাবমেরিনে তুমি ১৪৭ জন ক্রু নিয়ে ডুব দিতে পারো। তোমার বন্ধুকে নিতে ভুলো না।
তুমি কি ৩০০ মিটারের থেকেও গভীরে যেতে চাও? তোমায় সাবধান করে দিচ্ছি। এর নিচে চাপ কিন্তু অনেক বেশি। গভীরতা বৃদ্ধির সঙ্গে কতটুকু চাপ বাড়ে, তুমি জানো। বাকিটা হিসাব করে নাও। ৩০০ মিটার গভীরতা থেকে শুরু করে ৪ হাজার ৫০০ মিটার পর্যন্ত ডুব দিতে চাও?
যুক্তরাষ্ট্রের উডস হোল ওশানোগ্রাফিক ইনস্টিটিউশনের ডুবোজাহাজ অ্যালভিন দুজন বিজ্ঞানী ও একজন পাইলটকে ৪ হাজার ৫০০ মিটার গভীরতা পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে। প্রতিটি ডাইভ শেষ করতে ৬ থেকে ১০ ঘণ্টা সময় লাগে। ১৯৬৪ সালে বানানো বিশ্বের প্রথম গভীর সমুদ্র ডুবোজাহাজ হিসেবে নির্মিত অ্যালভিন এ পর্যন্ত পাঁচ হাজারের বেশি ডাইভ দিয়ে ফেলেছে। সমুদ্রের প্রায় ৬৫ শতাংশ গভীরে অ্যালভিন যেতে পারে। অ্যালভিনে চেপে চলে যাও।
তোমাকে এর থেকে বেশি গভীরতায় ডুব দিতে পরামর্শ দেওয়া ঠিক হবে না। কারণ, জুন মাসের মাঝামাঝি একটি সাবমারসিবল গভীর সমুদ্রে ডুব দিয়ে আর ফিরে আসেনি। পাঁচ যাত্রীসহ বিস্ফোরিত হয়ে সবাই মারা গেছেন। সাবমারসিবলটির নিরাপত্তাত্রুটি ছিল। তুমি যেতে চাইলে একটি নিরাপদ ডুবোযান বেছে নাও।
তুমি নিশ্চয়ই অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়। তুমি আরও গভীরে ডুব দিতে চাও। দিতে পারো। চলে যাও চ্যালেঞ্জার ডিপ নামে মারিয়ানা ট্রেঞ্চের সবচেয়ে গভীরতম পরিচিত বিন্দুতে। এটিকে এখনো বিশ্বের মহাসাগরের গভীরতম বিন্দু বলে মনে করা হয়। ১৯৬০ সালে বাথিস্কাফ ট্রিয়েস্ট নামের একটি সাবমারসিবল দুজন আরোহী নিয়ে ডুব দিয়ে বিশ্ব রেকর্ড তৈরি করেছিল। চাইলে তুমিও একদম গভীরে ডুব দিতে পারবে।